বাংলাদেশের ইতিহাস বলতে আমরা বুঝি মুক্তিযুদ্ধ। যদিও হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্যের কথা প্রায়শ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি দাবিদার রাজনৈতিক নেতারা বলে থাকে। কিন্তু কাগজে-কলমে, ইতিহাসের বুকে হাজার বছরের ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় না।
যাইহোক, মূল কথায় ফিরে আসি। সেই মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল মূলত দুটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। এক, অধিকার আদায়। দুই, গণতন্ত্র। পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করে দেশিয় শাসকদের হাতে দেশ তুলে দেওয়ার পর অধিকার কতটুকু আদায় করা সম্ভব হয়েছে, সেই হিসাব-নিকাশে না হয় অন্যদিন যাওয়া যাবে। আজ গণতন্ত্র নিয়ে একটু আলাপ করা যাক।
রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ভাষ্যনুসারে স্বাধীন বাংলাদেশে সম্ভবত গণতন্ত্র কখনোই মুক্তি পায়নি। অতীতে আমরা লক্ষ্য করেছি, দেশের শাসনক্ষমতায় যখন জাতীয়তাবাদি দল বিএনপি ছিল তখন আওয়ামী লীগ দাবি করত, দেশে গণতন্ত্র নেই। এই সরকার গণতন্ত্র হত্যা করে স্বৈরাচারি সরকার ব্যবস্থা কায়েম করেছে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ যখন দেশের শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করেছে, তখন বিএনপি বলেছে এই সরকার দেশের গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে; গণতন্ত্র হত্যা করে দেশে স্বৈরাচারি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছে।
এতো গেল দেশের কথা! আসুন একটু খেয়াল করে দেখি, এই রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই কতটা গণতন্ত্রের চর্চা করে।
দেশের সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। দেশ স্বাধীনের পূর্ব ও পরবর্তি সময়ে এই দলের সভাপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার মৃত্যুর পর বর্তমানে এই দলের সভাপতি তারই কন্যা শেখ হাসিনা। খুব সম্ভবত শেখ হাসিনার পর দলের সভাপতির আসন গ্রহণ করবে তারই পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। এখানে পরিবারতন্ত্র কায়েম হয়ে গেছে। দলের ক্ষেত্রেও গণতন্ত্রেরচর্চার লেশমাত্র অবশিষ্ঠ নেই। বরঞ্জ অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এখানে পরিবারতন্ত্রই যেন অনিবার্য নিয়ম।
অন্যদিকে জাতীয়তাবাদি দল বিএনপি দেশের অন্যতম বৃহত্তর রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগের মত এই দলের বিস্তর ইতিহাস না থাকলেও, দেশের ক্ষমতা পাওয়ার দিক থেকে তারা বেশ অগ্রসর। এই দলটির যাত্রা শুরু হয় দেশ স্বাধীনের পর থেকে। অর্থাৎ ১৯৭৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে এই দলের অঘোষিত সূচনা যাত্রা শুরু হয়।
শুরুতে এই দলের সভাপতি ছিলেন, দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তার মৃত্যুর পর দলের সভাপতির পদে বসেছেন তারই সহধর্মিনী বেগম খালেদা জিয়া। আর এ কথা চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়, খালেদা জিয়ার পর দলের প্রধান হবেন তারই পুত্র তারেক রহমান। এখানেও পরিবারতন্ত্র বিরাজমান। এই পদের ক্ষেত্রে কোনো গণতন্ত্র-টনতন্ত্র চলবে না। পরিবারতন্ত্রই শেষ কথা।
এবার আসি ইসলামি দলগুলোর ব্যাপারে। দেশের ইসলামি দলগুলোর মধ্যে প্রধান না হলেও আলোচিত দল ‘ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ’। অর্থাৎ চরমোনাই পীর সাহেবের দল।
‘ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ’ নামে পীরসাহেবের দল যখন রাজনীতিতে আসে তখন এই দলের প্রধান ছিলেন ফজলুল করীম। তার মৃত্যুর পর দলের প্রধান হয়েছেন তারই সন্তান ফজলুল করীম। আর ফজলুল করীমের পর খুব সম্ভবত দলের প্রধান হবেন রেজাউল করিম। অবস্থাদৃষ্টে এ কথা স্পষ্ট এখানেও পরিবারতন্ত্র কায়েম হয়েছে; গণতন্ত্র নিপাত গেছে।
এবার আসি বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত রাজনৈতিক দল ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি’ সম্পর্কে। দেশ স্বাধীনের পূর্ব থেকেই এই দলটির রাজনৈতিক কার্যক্রম চালু থাকলেও, স্বাধীনতার পর বেশ কয়েক বছর এই দলটি নিষিদ্ধ ছিল। নিষিদ্ধ অবস্থা থেকে জামায়াত ইসলাম পুনরায় যখন রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করে, তখন এই দলের প্রধান অর্থাৎ আমীর ছিলেন অধ্যাপক গোলাম আযম। তিনি জামায়াতের আমীরের দায়িত্ব পালন করে ২০০০ সাল পর্যন্ত। এরপর শারীরিক অসুস্থতা জনিত কারণে, তিনি দলের প্রধান থাকতে অপরাগতা প্রকাশ করেন।
এরপর দলের প্রধানের দায়িত্বপান মতিউর রহমান নিজামী। মতিউর রহমান নিজামী কিন্তু অধ্যাপক গোলাম আযমের সন্তান ছিলেন না! এমনকি তাদের মাঝে রক্তের দূরতমও সম্পর্ক ছিল না। মতিউর রহমান নিজামী দলের সদস্যদের গোপন ব্যালট ভোটের মাধ্যমে দলের প্রধান হওয়ার সুযোগ লাভ করেন।
মতিউর রহমান নিজামীর পর দলের আমীরের দায়িত্ব পান মকবুল আহমেদ। এবং মকবুল আহমেদ ও মতিউর রহমান নিজামীর মধ্যে আত্মিয়তা বা রক্তের দূরতমও সম্পর্ক ছিল না। মকবুল আহমেদও দলের সদস্যদের গোপন ব্যালট ভোটের মাধ্যমে দলের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন।
এরপর গত সপ্তাহে জামায়াতে ইসলামির নতুন আমীর হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন ডা: শফিকুর রহমান। তিনিও দলের সদস্যদের গোপন ব্যালট ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে, দলের প্রধান হয়েছেন।
সার্বিক দিক বিবেচনা করে দেখা গেল, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামির মধ্যেই গণতন্ত্রের চর্চা রয়েছে। একমাত্র এই দলটির মাঝে পরিবারতন্ত্র প্রবেশ করতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকার কারণে দলটি নিয়ে নানা সমালোচনা বিতর্ক থাকলেও, এ কথা বলতে দ্বিধা নেই রাজনীতির সুস্থধারার চর্চা জামায়াতের মধ্যেই আছে।
এখন প্রশ্ন হল, আর যারা নিজ দলের মাঝে গণতন্ত্রের চর্চা কায়েম করতে পারেনি, তারা কি করে দেশে গণতন্ত্রের চর্চা অব্যাহত রাখবে?
শাহমুন নাকীব ব্লগার