এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী
গত রোববার ঢাকা থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের দুবাইগামী উড়োজাহাজটি উড্ডয়নের পরপরই যে যুবক ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেছিলেন, তিনি পেশাদার বা সংঘবদ্ধ কোনো জঙ্গি গ্রুপের সদস্য ছিলেন বলে মনে হয় না। প্রথমে বলা হয়েছিল পলাশ আহমদ নামের ওই যুবকের হাতে পিস্তল ছিল। পরে উদ্ধার অভিযানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, ওই যুবকের হাতে থাকা পিস্তলটি আসল নয়। পরে বিমানটি বিনা বাধায় চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে অবতরণ করেছে এবং এর সব যাত্রী ও চালক-ক্রুরা নিরাপদ আছেন—এ খবর আমাদের স্বস্তি দেয়।
কিন্তু প্রথমেই প্রশ্ন ওঠে পিস্তল আসল হোক আর খেলনা হোক, একজন যাত্রী কীভাবে সেটি নিয়ে উড়োজাহাজে উঠলেন?
এখানে বিমানবন্দরের নিরাপত্তার মারাত্মক ঘাটতি ও দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়েছে। বিমানে ওঠার আগেই যাত্রীর শরীর ও ব্যাগেজ একাধিকবার পরীক্ষা করা হয়। খেলনা পিস্তল হলে মেটাল ডিটেকটরে ধরা পড়বে না। কিন্তু লাগেজ চেকিংয়ে ধরা পড়ল না কেন? এখানে যেসব কর্মকর্তা লাগেজ তল্লাশি করেছিলেন, তাঁদের গুরুতর গাফিলতি ছিল। পিস্তলটি যদি আসল হতো কিংবা ওই যুবক যদি সংঘবদ্ধ কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্য হতেন, তাহলে কী ঘটত, তা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, একজন অভ্যন্তরীণ যাত্রীকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে নেওয়া কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। এই ঘটনা যে শুধু ওই ফ্লাইটে ঘটেছে তা নয়, অনেক ফ্লাইটেই হয়ে থাকে। এখানেও বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের পেশাদারির অভাব রয়েছে। কেননা, আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের যাত্রীদের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা তল্লাশি অপেক্ষাকৃত কঠোর হয়ে থাকে। তাঁদের ইমিগ্রেশন, পাসপোর্ট ইত্যাদি পরীক্ষার বিষয় থাকে, যেটি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে থাকে না। আর যদি ওই তরুণ উড়োজাহাজে ওঠার পর কোনো সূত্রে তিনি পিস্তলটি পেয়ে থাকেন, সেটি আরও বেশি বিপজ্জনক।
ছিনতাইয়ের জন্য ওই যুবক ককপিটে গিয়ে পাইলটকে পিস্তল দেখিয়েছেন বা সেখানে গুলি করেছেন বলে যে খবর বের হয়েছে, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। ককপিটে বাইরের কারও যাওয়ার সুযোগই নেই। নাইন-ইলেভেনের পর সব বেসামরিক বিমানেই এই উন্নত ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। এখন আর বিমান ছিনতাইচেষ্টার কথা পাইলটকে কাউকে জানানোর প্রয়োজন হয় না। কোনো উড়োজাহাজ এ ধরনের আক্রমণের শিকার হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কন্ট্রোল টাওয়ারে বার্তাটি চলে যাবে। হতে পারে যুবকটি বিমানের কেবিন ক্রুদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন কিংবা তাঁদের সঙ্গে তর্ক করছিলেন। পাইলটের ককপিট পর্যন্ত তাঁর যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর যদি খেলনা পিস্তল হয়ে থাকে, গুলি হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ছিনতাইয়ের চেষ্টার খবরে যাত্রীদের মধ্যে ভয়াবহ আতঙ্ক দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। আর সে কারণে গুলি হওয়া নিয়ে তাঁদের মধ্যে বিভ্রম তৈরি হয়ে থাকতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে হয়।
কিন্তু যেভাবে ছিনতাইচেষ্টার ঘটনার অবসান হলো তাতে আমরা অনেকটা অবাক হয়েছি। যে বিমান ছিনতাইচেষ্টা কোনো সংঘবদ্ধ জঙ্গি বা সন্ত্রাসী করেনি এবং বিমানের সব যাত্রী ও ক্রু নিরাপদে নেমে আসতে পেরেছেন, সেখানে উচিত ছিল ওই যুবককে জীবিত উদ্ধার করা। যেখানে যুবকটি মানসিকভাবেই বিপর্যস্ত ছিলেন, সেখানে ট্রাঙ্কুলাইজার বা অন্য কোনো উপায়ে তাঁকে নিষ্ক্রিয় করা যেত। এখন অনেক ধরনের গুলি আছে, যাতে মানুষ মারা যায় না, কিন্তু কাবু হয়। যুবকটিকে জীবিত উদ্ধার করা গেলে জানা যেত বিমান ছিনতাইচেষ্টাটি তিনি নিজের ইচ্ছায় করেছিলেন, না অন্য কারও প্ররোচনা ছিল। জানা যেত তাঁর পেছনে কোনো সংগঠন ছিল কি না? পৃথিবীর সব দেশেই এ ধরনের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নানা কৌশল ব্যবহার করেন। যেমন নানা কথা বলে তাঁকে ব্যস্ত রাখা, সময়ক্ষেপণ করা। তবে কোনোভাবেই তাঁকে উত্তেজিত হতে দেওয়া যাবে না। তাঁকে আশ্বাস দেওয়া হয়, যাতে তিনি চরম কোনো উপায় বেছে না নেন। তাঁকে শান্ত রাখতে হবে। খ্যাপানো যাবে না। অনেক সময় ঘুম পাড়ানো ওষুধও দেওয়া হয়। কিন্তু মারা যাওয়ার পর এর পেছনের রহস্য জানা যাবে না। এখন যা বলা হবে, তার সবই আন্দাজের ওপর। অনেক প্রশ্নেরই উত্তর মিলবে না।
বিমান ছিনতাইচেষ্টার ঘটনাটি নতুন করে আমাদের বেসামরিক বিমানবন্দর ও উড়োজাহাজের নিরাপত্তার ভঙ্গুরতার বিষয়টি সামনে নিয়ে এল। বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় অনেকগুলো সংস্থা কাজ করে, সেখানে পুলিশ থাকে, আর্মড পুলিশ থাকে, বিমানবন্দরের নিরাপত্তারক্ষী থাকে, ইমিগ্রেশন, কাস্টমস থাকে। এতগুলো সংস্থা যেখানে কাজ করে, সংশ্লিষ্ট সবার কাজে সমন্বয় ও পারস্পরিক সহযোগিতা থাকা জরুরি। কিন্তু বিমানবন্দরের বহির্গমন বা আগত যাত্রীমাত্রই জানেন সেখানে পদে পদে বিশৃঙ্খল অবস্থা। একটি সংস্থার সঙ্গে আরেকটি সংস্থার সমন্বয় নেই। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে একে অপরের ওপর দায় চাপিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। আমরা প্রায়ই বিমানবন্দরের টয়লেট বা অন্য কোনো স্থান থেকে চোরাচালানের সোনা বা অন্য বস্তু উদ্ধারের খবর পাই। সব সংস্থা তাদের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করলে তো এসব পণ্য উড়োজাহাজ থেকে নামানোর পথেই আটকে দেওয়ার কথা।
আমাদের এখানে বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টার ঘটনা খুব বেশি ঘটেনি। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে জাপানি রেড আর্মির সদস্যরা তাঁদের সহযোদ্ধাদের মুক্তির দাবিতে মুম্বাই থেকে ব্যাংককগামী একটি বিমান ছিনতাই করে ঢাকায় অবতরণ করিয়েছিলেন। সেবারও বিমানের সব যাত্রী ও ক্রু অক্ষত ছিলেন। কারও কোনো ক্ষতি হয়নি। আরেকবার চট্টগ্রাম থেকে যশোরগামী একটি উড়োজাহাজ ছিনতাইয়ের চেষ্টা হয়েছিল। সেটিও সফল হয়নি।
কিন্তু অতীতে ছিনতাইয়ের চেষ্টা সফল হয়নি বলে আমরা চুপচাপ বসে থাকতে পারি না। ভবিষ্যতে দুর্ঘটনা এড়াতে বিমানবন্দর ও উড়োজাহাজ পরিচালনায় আমাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। পেশাদারি বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে বিদেশে উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় যেকোনো সময় বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
সবশেষে বলব, আমাদের বিমানবন্দরের অবকাঠামো ও প্রযুক্তি অনেকটা সেকেলে। গত চার-পাঁচ দশকে বাইরের বিমানবন্দরগুলো প্রযুক্তির দিক থেকে অনেক উন্নত হয়েছে। উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তো বটেই, প্রতিবেশী ভারতের বিমানবন্দরগুলোর সঙ্গে তুলনা করলেও আমাদের বিমানবন্দরগুলোতে নিরাপত্তার অনেক ঘাটতি ধরা পড়ে। যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য এই ঘাটতি দূর করতেই হবে। প্রয়োজনে আমাদের একটি নতুন আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর বিমানবন্দর স্থাপনের কথা ভাবতে হবে।
এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: নিরাপত্তা বিশ্লেষক
সূত্র: প্রথম আলো