হাসান রূহী
আমাদের সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফ গুলি চালিয়ে সাধারণত একজন হত্যা করে। কখনও কখনও যে একাধিক হত্যার ঘটনা ঘটেনা তা বলার সুযোগ নেই। কিন্তু সাধারণ হিসেবে দেখা যায় নিহতের সংখ্যা ১। তা যে সীমান্তেই হোক। তবে এভাবে এক এক করে হত্যা করতে করতে এ সংখ্যা ঠিক কততে পৌঁছেছে আজ তা আলোচনা করবো না। ভবিষ্যতে কখনও বিশ্লেষণ ও গবেষণার চেষ্টা করবো।
আজ বিশ্লেষণের বিষয়টা ভিন্ন। ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার বকুয়া গ্রামে গত ১২ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার চোরাচালানে আসা গরু জব্দ করতে গিয়ে আমার দেশের বিজিবি গুলি চালিয়ে আমার দেশের অন্তত চারজন মানুষ হত্যা করেছে। বৃষ্টির মত গুলি চালানোর সময় নারী ও শিশুসহ অন্তত ২০ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এদের মধ্যে এখনও ৪ থেকে ৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। সর্বমোট আহতের সংখ্যা অর্ধশত ছাড়িয়ে গেছে।
বিজিবি গতকাল ১৩ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছে যে, নিজেদের আত্মরক্ষার্থেই নাকি তারা জনগণের উপর এভাবে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। এই খবর পড়ার পর অত্যন্ত বিস্মিত হয়েছি। কারণ তাদের এই সংবাদ সম্মেলনের আগেই সামাজিক মাধ্যমে একটি ভিডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়েছিল। তাতে স্পষ্টই দেখা যায় যে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের অনেক ধরণের সুযোগ থাকার পরেও আসলে কিভাবে বিজিবি জনগণের উপর গুলি ছুঁড়েছিল। অনেক ধরনের সুযোগগুলো কি তা পরিস্কার করতে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাই।
প্রথমত: যদি বিজিবির প্রথম দাবিই সত্য ধরে নিই যে, গরুগুলো ভারতীয়। এবং এগুলো সংঘবদ্ধ চোরাকারবারীরা অবৈধ উপায়ে এনেছে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে- গরুগুলো যখন সীমান্ত অতিক্রম করেছে তখন বিজিবির এই বীর বাহাদুররা কোথায় ছিলেন? ওপাড়ের বিএসএফ বাবু আর এপাড়ের বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে কিভাবে বাংলাদেশের গ্রামে প্রবেশ করলো গরুগুলো?
দ্বিতীয়ত: তারপরও ধরে নিলাম ওনাদের কোন সুখনিদ্রার সুযোগ নিয়ে সংঘবদ্ধ চোরাকারবারীরা গোরক্ষক দাদা বাবুদের গরু পাচার করে এনেছে। এবং তা উদ্ধার করে গোরক্ষার মহান দায়িত্ব পালন করতে চায় বিজিবি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- গরু উদ্ধার করতে গিয়ে এতগুলো মানুষকে গুলি করলেন কোন সাহসে? কার ইশারায়?
তৃতীয়ত: গরুগুলো যদি চোরাকারবারীদেরই হবে, তবে তা রক্ষায় কেন পুরো গ্রামবাসী এগিয়ে এল? পুরো গ্রামের মানুষ আপনাদের দাবি অনুযায়ী চোরদের পক্ষ নিয়েছে?
চতুর্থত: মানুষের চাইতেও কি গরুর দাম এত বেশি হয়ে গেল যে, ৫ টি গরু উদ্ধার করতে গিয়ে ৪ জনকে গুলি করে হত্যা এবং ২০ জনকে গুলিবিদ্ধ করতে হলো? অবশ্য বিজিবি দাবি করেছে আত্মরক্ষার্থে তারা ফাঁকা গুলি চালিয়েছে! আর সে ফাঁকা গুলির নমুনা হচ্ছে চার চারটি লাশ!
পঞ্চমত: ধরে নিলাম আপনাদের দাবিই সত্য। আপনারা সত্যিই গোরক্ষা করতে গিয়ে এ অদ্ভূত স্টাইলে ফাঁকা গুলি চালিয়েছেন। তো আপনাদের এই ফাঁকা গুলি তখন কোথায় থাকে, যখন স্রোতের মত ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবা দেশে প্রবেশ করে?
কিংবা যখন বিএসএফ এসে এদেশ থেকে এদেশের মানুষ ধরে নিয়ে যায়, সীমান্তে লুটপাট চালায়, পুশইন করে, অন্যায়ভাবে গুলি চালায় তখন এই ফাঁকা গুলি কোথায় থাকে?
ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের দাবি অনুযায়ী গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার জন্য ব্যবহৃত অস্ত্র এসেছে ভারত থেকে। জঙ্গি হামলায় ব্যবহৃত রাইফেল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলায় তৈরি করা হয়। শুধু কি এই অস্ত্র? এখন ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত পাতিনেতাদের হাত পর্যন্ত পৌঁছে গেছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। বিভিন্ন সংঘর্ষের সময় প্রায়শই তাদের এসব অস্ত্রের ছবি পত্রিকার পাতায় ছাপা হচ্ছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এসব অস্ত্র বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে সীমান্ত পাড় হয়ে কিভাবে আসছে? কোথায় থাকে তখন তাদের এই ফাঁকা গুলি?
আমরা যারা সাংবাদিকতা করি তাদের তো কখনও একপক্ষের কথা শুনলে চলে না। আমরা বিজিবির প্রশ্নবিদ্ধ ও হাস্যকর বক্তব্য শুনেছি। এবার চলুন দেখা যাক ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুরের বহরমপুর গ্রামবাসী কি বলছেন।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত হরিপুর উপজেলার বকুয়া ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আবুল কাশেম বলেন, দুপুর ১২টার দিকে বহরমপুর গ্রামের হুকুম হাজীর ছেলে হবিবর রহমান ২টি গরু ও রুহিয়া গ্রামের নাজিম ৩টি গরু জাদুরানী হাটে বিক্রির জন্য নিয়ে যাচ্ছিলেন। ওই সময় বেতনা সীমান্ত ফাঁড়ির বিজিবি সদস্যরা গরুগুলো আটক করে ক্যাম্পে নিয়ে যাচ্ছিল। বৈধ কাগজ থাকা সত্ত্বেও কেন গরুগুলো নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা জানতে চাইলে আরিফ নামে বিজিবির এক সদস্য আমার পেটে রাইফেলের নল ঠেকায়। এ দৃশ্য দেখে গ্রামবাসী প্রতিবাদ করে। এ সময় বিজিবির সদস্যরা উত্তেজিত হয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করতে শুরু করে। এতে ঘটনাস্থলেই নবাব ও সাদেক মারা যান।
চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এরফান আলী বলেন, এলোপাতাড়ি গুলিতে ৫ম শ্রেণীর ছাত্র জয়নুলের শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায়। হরিপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।
হরিপুর উপজেলার জামুন গ্রামের গরু ব্যবসায়ী খায়রুল বলেন, কয়েকদিন ধরে বিজিবি এলাকায় গিয়ে বৈধ কাগজ থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় গরু দাবি করে ক্যাম্পে নিয়ে যাচ্ছে। সোমবার বহরমপুর গ্রামের দাদন আলীর ছেলে ফারুক ও ধুমডাঙ্গী গ্রামের মোজাম্মেলের ছেলে মহবত আলী এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে লিখিতভাবে অভিযোগও করেন। আর পরদিনই এ ঘটনা ঘটল। জামুন গ্রামের কৃষক আবদুল মতিন বলেন, আমরা চোরাকারবার করি না। আমরা অল্প বয়সের গরু কিনে পালন করার পর তা বিক্রি করি। এ দিয়েই ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াসহ সংসারের সব খরচ চালাই।
বহরমপুর গ্রামের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো: জহিরুল ইসলাম বলছিলেন, গ্রামের সাধারণ মানুষের ওপর বিজিবি উপর্যপুরি গুলি চালালে একজন এসএসসি পরীক্ষার্থীও নিহত হয়।
যে বাড়ি থেকে গরুগুলো উদ্ধার করা হয় সেই বাড়ির হবিবর রহমানের ছেলে ইয়াকুব আলী অভিযোগ করে বলেন, গরুগুলো আমরা নিলাম থেকে কিনেছিলাম। বিজিবিকে নিলাম থেকে কেনার টোকেনও দেখিয়েছি। তারপরও বিজিবি টোকেনসহ আমাদের গরু নিয়ে যায়। তাদের দাবি, টাকা আদায় করতেই দেশি গরুকে ভারতীয় বলছে বিজিবি।
যাইহোক, গোরক্ষা করতে নরহত্যা করার ঘটনা ভারতে প্রায়ই ঘটছে। তবে বাংলাদেশের এই ঘটনা ভারতের গেরুয়াদের নৃশংসতাকেও হার মানিয়েছে। কিন্তু এই ঘটনার পর সরকারের অবস্থান কি? অনেকটা ‘প্যারাসিটেমল দুই বেলা’র মত। চার জন নিহত হলেও পত্রিকায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী নিহত তিনজনের পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে লাশ দাফনের জন্য ২০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে।
গ্রামবাসীকে চোরাকারবারী আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছেন বিজিবির অধিনায়ক বীর বাহাদুর(!) লে. কর্নেল তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ। তবে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া উদ্দেশ্যমূলক গুলি চালানোর ভিডিওর ব্যাখ্যা কি তা হয়তো কখনই জানা হবে না আমাদের। হয়তো তাদের দায়ের করা মামলার কাগজ হাতে নিয়ে গ্রামকে অচিরেই পুরুষশূণ্য করবে কোতোয়াল বাহিনী। হয়তো আদালতের বারান্দায় দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে মূর্ছা যাবেন প্রতিবাদে অংশ নেয়া নিরীহ গ্রামবাসী। দিন শেষে আমার মত আপনারাও স্বীকার করে নেবেন যে, এই গোরক্ষক বীর বাহাদুরদের দেশে মানুষ না হয়ে গরু হয়ে জন্মানোই অপেক্ষাকৃত নিরাপদ।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট