অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ কুমিল্লা-১১ (চৌদ্দগ্রাম) আসনকে ঘিরে এরই মধ্যে বইতে শুরু করেছে নির্বাচনী হাওয়া।
চৌদ্দগ্রামের বুক চিরে চলে গেছে ৪২ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। তা ছাড়া জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজন নেতার নির্বাচনী এলাকা এটি।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির হেভিওয়েট প্রার্থী কাজী জাফর আহমেদ নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয় পান আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী মুজিবুল হক মুজিব নির্বাচিত হন।
২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াতের দখলে আসে আসনটি। বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য ডাঃ সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের। এরপরেই তারা চৌদ্দগ্রামকে নিজেদের দূর্গ হিসেবে গড়ে তোলে। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের মুজিবুল হক মুজিব জয় পেয়ে আসনটি আবারও আওয়ামীলীগের দখলে নেয়।
তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এ আসনে আওয়ামী লীগ পুরোপুরি নির্ভার থাকতে পারছে না। কারণ রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হক আবার এই আসনে নৌকার হাল ধরলেও তার সাথে পাল্লা দিয়ে এ আসনে মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি (এরশাদ) থেকে দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এইচ এন এম শফিকুর রহমান মহাজোট থেকে মনোনয়ন চেয়ে জোর প্রচারণা চালাচ্ছেন। মহাজোট থেকে মনোনয়ন না পেলেও তিনি নির্বাচন করবেন বলে জানা গেছে।
এছাড়াও রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক কে একা ছাড়তে নারাজ দলের অন্য চার নেতা। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য ও সাবেক ঢাবি ছাত্রলীগ নেতা তরুণদের মাঝে জনপ্রিয় জসিম উদ্দিন, আওয়ামীলীগ নেতা বাহার রেজা, আরেক আওয়ামীলীগ নেতা আবুল কাশেম এবং প্রবীণনেতা বজলুর রহমান বুলু দলীয় মনোনয়ন পত্র সংগ্রহ করে এলাকায় নেতাকর্মীদেরকে নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন। যার ধরুন, অভ্যন্তরীণ দলীয় কোন্দল এখন প্রকাশ্যরূপ ধারণ করেছে। রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের জন্য নির্বাচনের সুফল নিয়ে আসা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দলীয় কোন্দলের বিষয়ে একাধিক আওয়ামীলীগ নেতা বলেন, মুজিবুল হক সাহেবকে আমরা ২০০৮ সালে ভোট দিয়ে এমপি বানিয়েছি, ২০১৪ সালে তিনি আবার বিনা-প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নির্বাচিত হন এবং মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও পালন করছেন, কিন্তু দুঃখের বিষয় তিনি গত ১০ বছরে চৌদ্দগ্রামে আওয়ামীলীগের কোনো কমিটি গঠন করতে দেন নাই। স্থানীয় নেতাদের অবমূল্যায়ন করে নিজের সিদ্ধান্তকে সর্বশেষ এবং চুড়ান্ত বলে নেতাকর্মীদের উপর চালিয়ে দিয়েছেন। এভাবে তো একটা দল চলতে পারে না। তাই আমরা পরিবর্তন চাই। অবশ্যই এবার আমাদের সমর্থন নতুন কারোর প্রতি থাকবে, যিনি স্থানীয়দের সাথে নিয়ে কাজ করবেন।
অন্যদিকে, ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীর করার জন্য জোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী ডাঃ তাহের ও তার সমর্থকরা। তারা মরিয়া হয়ে উঠেছেন সারাদেশে জামায়াতের ঘাঁটি হিসেবে খ্যাতি পাওয়া চৌদ্দগ্রামে বিজয়ী হয়ে ২০ দলীয় জোটকে উপহার দিতে।
২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে সরকারের রোষানলে পড়ে শত শত মামলার আসামী হয়ে জামায়াতের নেতাকর্মীরা এলাকা ছাড়ে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তারা এলাকায় ফিরতে শুরু করেছে এবং পুরোদমে কাজ শুরু করেছে।
সূত্রগুলো জানিয়েছে, মনোনয়ন পত্র সংগ্রহ করার পর থেকে ডাঃ তাহেরও নিয়মিত কুমিল্লা সফর করে নির্বাচনী কার্যক্রম চালাচ্ছেন।
নির্বাচন প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে কুমিল্লা জেলা জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য সাহাব উদ্দিন বলেন, ‘নিবন্ধন বাতিল হলেও ডাঃ সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের ২০ দলীয় জোটের সমর্থন নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী কিংবা ধানের শীষ প্রতীক হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেবেন। সে জন্য প্রস্তুতি রয়েছে আমাদের। জামায়াতের ইউনিয়ন, ওয়ার্ড নির্বাচনী কমিটিও হয়েছে। নেতাকর্মীদের এলাকায় ফেরার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নেতাকর্মীরা উজ্জেবিত। সাধারণ মানুষ মুক্তি চায়, ইনশাআল্লাহ এবারের নির্বাচনে জনগন মুক্তি পাবে’
জামায়াত প্রার্থী ডাঃ তাহেরের ফেসবুক পাতায় ঘুরে দেখা যায়, চার দলীয় জোটের সময়কাল (২০০১-২০০৬) কে উন্নয়নের সোনালী সময় ট্যাগ দিয়ে ততকালীন এমপি ডাঃ তাহেরের উন্নয়ন কার্যাবলী নিয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
চৌদ্দগ্রাম (দক্ষিণ) জামায়াতের আমীর মাহফুজুর রহমান বলেন, “আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর রেলমন্ত্রী মুজিবুক হক এলাকায় সন্ত্রাসের রাজ কায়েম করেছে, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হত্যা, গুম ও হামলা-মামলা করে সুস্থ রাজনীতিকে কুলুষিত করেছে। এলাকায় উন্নয়নের কোনো ছোঁয়া লাগেনি। তাই জনগণ ডাঃ তাহেরকে চায়। যেকোনো মূল্যে এবার ২০ দলীয় জোট মনোনীত প্রার্থী ডাঃ তাহেরকে বিজয়ী করে আনবো। আমরা প্রস্তুত।”
অন্যদিকে, স্বাধীনতার পর থেকেই এই আসনে বিএনপির অবস্থা খুবই নাজুক। যদিও বিএনপির স্থানীয় নেতাদের দাবি, চৌদ্দগ্রাম আসনে বিএনপির অবস্থা এখন আগের চেয়ে ভালো। ওয়ার্ড পর্যায়েও কমিটি আছে। তবে সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, চৌদ্দগ্রাম বিএনপিতে রয়েছে কোন্দল। কমিটির বাইরে রয়েছে দলের একটি বড় অংশ। তাই কেন্দ্রীয় বিএনপিরও ভরসা ২০ দলীয় জোট সমর্থিত জামায়াত প্রার্থী ডাঃ তাহেরর উপরই।
নির্বাচন প্রস্তুতি নিয়ে জানতে চাওয়া হলে চৌদ্দগ্রাম জামায়াত নেতা বেলাল হোসাইন বলেন, “আমাদের সংগঠন ও নেতাকর্মীরা গোছানো। জনগণ যদি শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিতে পারে তবে অবশ্যই আমরা জয়লাভ করবো। সবার আগে প্রয়োজন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড।”
আর সাধারণ ভোটারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, “সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় মাদকমুক্ত ও সন্ত্রাস নির্মূলে কাজ করবেন এমন ব্যক্তিকেই বেছে নেবেন তারা। গত ১০ বছরে চৌদ্দগ্রামে মাদক ও সন্ত্রাস বেড়ে গেছে উল্লেখ করে তারা জানান, এখন আমরা ক্ষমতার পরিবর্তন চাই।”
জীবনে প্রথম ভোট দিবেন এমন কয়েকজনের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের, তারা বলেন, “যিনি দুর্নীতি দূরীকরণে ভূমিকা রাখতে পারবেন, এলাকাকে মাদকমুক্ত করতে পারবেন তাকেই আমরা ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করব।”
উল্লেখ্য, কুমিল্লা-১১ আসনে ৩ লাখ ২৮ হাজার ভোটার। তন্মধ্যে ১ লাখ ৬২ হাজার ৭০০ নারী ভোটার।