অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
রাষ্ট্রের সংবিধানকে দলীয় গঠনতন্ত্রের মতো ব্যবহার করে এবং কোনো প্রকার আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে বিগত ১০ বছর ধরে দেশ শাসন করছেন শেখ হাসিনা। ক্ষমতা ধরে রাখতে খুন-হত্যা, গুম, অপহরণ, দমন-পীড়িন, নির্যাতন, চুরি-ডাকাতি, দুর্নীতি, লুটপাট, সন্ত্রাস, বিরোধীদলসহ জনগণের মতপ্রকাশের অধিকার হরণসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যা তারা করেনি। বিগত দিনগুলোতে রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্য থেকে শেখ হাসিনার শুভাকাঙ্খী হিসেবে যারা পরিচিত ছিলেন, দুঃশাসনের কারণে তারাও আওয়ামী লীগের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ক্ষমতার শেষ প্রান্তে এসে ইতিহাসের আরেকটি সংকটের মুখে পড়েছে আওয়ামী লীগ।
অতীতের দিকে তাকালে দেখা যায়, বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক ভুখন্ডে আওয়ামী লীগের নব্য শাসকরা সেবা, ভালবাসা ও সম্প্রীতির বন্ধনে সর্বস্তরের মানুষকে না বেঁধে শুধুমাত্র ঘৃনা, আক্রোশ ও প্রতিশোধের বহ্নি জালিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল এবং সাড়ে তিন বছর লুণ্ঠন, শোষণ, হত্যা ও দুঃশাসন চালিয়ে ৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট তারিখে অনাকাঙ্খিত ও নির্মম এক পরিণতির শিকার হয়। এরপর ছিটে ফোটা যে অস্তিত্বটুকু ছিল তাও ৭৫’র ৭ নভেম্বরের সিপাহী জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এর পরই চরম সংকটের মুখে পড়ে দলটি।
তারপর অনেক চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে ২১ বছর পর দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা জনগণের কিছুটা সহানুভুতি আদায় করতে সক্ষম হয়। ১৯৯৬ সালে দ্বিতীয়বারের মত ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। কিন্তু অতীত থেকে তারা শিক্ষা নেয়নি। চিন্তা-চেতনায় যাদের বাকশাল তাদের কাছ থেকে সুশাসন আশা করাও কঠিন। আওয়ামী লীগের দ্বিতীয়বারের শাসনব্যবস্থা ছিল রাজনৈতিক ব্যর্থতা, ওয়াদাভঙ্গ, অর্থনৈতিক অধোগতি, সন্ত্রাস, রাহাজানি, গুম, হত্যা, নৈরাজ্য, মানবাধিকার লংঘন, রাজনৈতিক দমন পীড়ন, জনগনের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ, ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ড ও আলেম-ওলামাদের উপর নির্যাতন, আত্মীয়করণ, দলীয়করণ, ভারত তোষণ, কুটনৈতিক পরাজয় আর দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেয়ার এক ভয়াল ও মর্মন্তুদ উপখ্যানের কাহিনী।
তবে, তাদের চিন্তা-চেতনায় বাকশাল থাকলেও সাংবিধানিক জটিলতার কারণে ওই সময় পুরোপুরি বাকশালী শাসন ফিরিয়ে আনতে পারেনি। কারণ, সংবিধান সংশোধন করার মত জাতীয় সংসদে তাদের সংখ্যাগরিষ্ট সংসদ সদস্য ছিল না। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য আওয়ামী লীগের চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না। তারা সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করেছে কিন্তু সিস্টেমের কারনে পারেনি।
এরপর, ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিনের সঙ্গে আতাঁত করে ২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বরের একটি রূপ দেখানো প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ট আসন নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। নির্বাচনের আগে সিইসি শামছুল হুদা বলেছিলেন তিনি ৭০’র মত একটি নির্বাচন উপহার দিবেন। আওয়ামী লীগের দুইশ’রও বেশি লোককে এমপি নির্বাচিত করে তিনি তার কথা ঠিক রেখেছেন।
এদিকে, ২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর সংসদ নির্বাচনের পর থেকে শুরু হয় আওয়ামী লীগের তৃতীয় পর্যায়ের শাসন ব্যবস্থা। মহাজোট সরকার যাত্রার শুরুতেই ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পরিকল্পিতভাবে পিলখানায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে নির্মমভাবে হত্যার মাধ্যমে জনগণকে চরমপত্র দিয়েছে। লুটপাট আর শোষণ-নির্যাতনের পথ পরিষ্কার করতেই দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তাদেরকে তারা হত্যা করেছিল।
আর বিশাল সংখ্যাগরিষ্ট আসন নিয়ে সরকার গঠন করার ফলে প্রথম থেকেই বেপরোয়া হয়ে ওঠে মহাজোট সরকার। মেতে ওঠে প্রতিশোধ আর প্রতিহিংসার জিঘাংশায়। ভিন্ন মতকে দমন করার লক্ষ্যে বেছে নেয় গ্রেফতার, নির্যাতন, গুম, খুন আর হত্যার পথ। বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম, সাবেক সেনা কর্মকর্তা আব্দুল্লাহিল আমান আযমী, ব্যারিস্টার আরমান, শিবিরের দুই নেতা আল মোকাদ্দেস ও ওলিউল্লাহসহ বহু লোককে তারা গুম করে ফেলে। রাজপথের মিছিলে পুলিশ দিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে বিরোধীদলের কয়েকশত নেতাকর্মীকে।
বিশেষ করে ২৮ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে পুলিশ নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যা ও ৫ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতের নিরীহ আলেম-ওলামা ও ছাত্রদের উপর সরকারের বর্বরোচিত হামলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের লোকজন পর্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। সরকারের এ সব গণহত্যা যেন মানুষকে ৭২-৭৫’র দুঃশাসনের কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। সরকারের মানবাধিকার লংঘনের বিষয়ে দেশি-বিদেশী মানবাধিকার সংস্থাগুলো গভীরভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও সরকারের কোন টনক নড়েনি। বরং হত্যাকান্ড ধামাচাপা দিতে সরকার উল্টো ভিন্ন মতের জনপ্রিয় কয়েকটি গণমাধ্যম বন্ধ করে দেয়।
এছাড়া আওয়ামী লীগের শাসনামলে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট আর আত্মসাতের মহোৎসব চলেছে। ব্যাংক ডাকাতি, শেয়ারবাজার, হলমার্ক, রেলওয়ে ও পদ্মাসেতু কেলেংকারীর মাধ্যমে একদিকে রাষ্ট্রের অর্থনীতির মেরুদন্ড ভেঙ্গে ফেলেছে, অপর দিকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশকে একটি দুর্নীতিগ্রস্থ দেশ হিসাবে পরিচয় করে দিয়েছে। রাষ্ট্রের এমন কোন সেক্টর বাদ যায়নি যেখান থেকে তারা অর্থ আত্মসাত করেনি।
বিগত ১০ বছর দেশের গণতন্ত্র ছিল গণভবন আর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে বন্দি। বিরোধীদলের সকল প্রকার মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে সরকার গণতন্ত্রের ভীতকে অনেক মজবুত ও শক্তিশালী করেছে। আইনশৃংখলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ ও র্যাব সদস্যদেরকে সরকার জনগণের নিরাপত্তার কাজে ব্যবহার না করে বিরোধীদল দমনের কাজে ব্যস্ত রেখেছে। আর স্বাধীন বিচার বিভাগতো কেবল কাগজে পত্রেই স্বাধীন। খুনের আসামিদেরকে ছেড়ে দিয়ে বিরোধীদলের নিরাপরাধ নেতাকর্মীদেরকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করে তাদের উপর রিমান্ডের নামে চালানো হয়েছে অমানষিক নির্যাতন। এক কথায় আদালতে বিরোধীদলের জন্য জামিনের দরজা ছিল বন্ধ।
আর সবচেয়ে লক্ষণীয় ছিল সরকারের কথিত যুদ্ধাপরাধের বিচার। মুক্তিযুদ্ধে বিরোধীতাকারীদের বিচার সকলেই চায়। বিরোধীদলের পক্ষ থেকেও বার বার বলা হয়েছে আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে। তবে বিচার হতে হবে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ। কিন্ত সরকার বিচারের নামে যা করেছে তাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের লোকজন পর্যন্ত অবাক হয়েছে। বিচারপতির স্কাইপি কেলেংকারি, রায়ের পর আইন করে শাস্তি বাড়ানো ও রায়ের ঘোষণার আগেই তা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ঘটনা দেশ-বিদেশে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের সুনাম মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন করেছে। আর জামায়াতে ইসলামীর উপর সরকার যেভাবে দমন-পীড়ন চালিয়ে আসছে তাতো এক নজির বিহীন ঘটনা।
আর এসবই করেছে সরকার আইন করে। বিরোধীদলকে দমনের জন্য সরকার প্রতিনিয়ত নতুন নতুন আইন তৈরি করেছে। সংসদে বিশাল সংখ্যাগরিষ্টতার কারণে নতুন আইন তৈরীতে তাদের কোন জটিলতা ছিল না। ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রের সংবিধানকে কেটে ছেটে দলীয় গঠনতন্ত্রে পরিণত করেছে। সর্বজনগৃহীত কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতিটিকে বাতিল করেছে। ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য যা যা করা দরকার তারা সবই করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্ষমতার শেষ প্রান্তে এসে শেখ হাসিনা এখন শুধু অন্ধকার দেখতে পাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক মহল চাচ্ছে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। অপরদিকে বিএনপিও জোরালো আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারপর যেকোনো ইস্যুতে ছাত্রজনতাও আবার মাঠে নেমে যেতে পারে। শেষ সময়ে এসে শেখ হাসিনা এখন বুঝতে পেরেছেন ক্ষমতা হাত ছাড়া হলে জনগণের চরম প্রতিশোধের মুখে তাদেরকে পড়তে হবে। বলতে গেলে আওয়ামী লীগ এখন ইতিহাসের আরেকটি মহাসংকটের মুখোমুখি। ক্ষমতার পালাবদল হলে ৭৫’র ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ যে সংকটে পড়েছিল, এবারও তাদেরকে সেই সংকটের মুখোমুখি হতে হবে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।