ঢাকার প্রধান একটি সড়কের ওপর থেকে ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে গেলেন এক পথচারী। পাশের জনকে বেশ আশ্চর্যের সঙ্গে বললেন, ‘আরে লেনের দিকে তাকান!’ বাংলাদেশের রাজধানী যেই ‘মটোরায়িত নৈরাজ্যে’র জন্য কুখ্যাত, তাতেই এক জাদুকরি পরিবর্তন চলে এলো এক সপ্তাহের মধ্যে। হ্যাঁ, রাজপথ তখনো গাড়িতে ঠাঁসা ছিল। বাস থেকে শুরু করে ছোট অটোরিকশা কিংবা অভিজাতদের চার-চাকার ব্যক্তিগত গাড়ি- সবই আছে। কিন্তু ওই ওভারব্রিজের নিচে কিংবা অন্যান্য জায়গায় গাড়ি সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল। সারির মাঝে স্ব-নিয়োজিত ট্রাফিক পুলিশ হিসেবে কাজ করছিল হাইস্কুল ইউনিফর্ম পরা শিক্ষার্থীরা।
তারা চালকের লাইসেন্স চেক করছিল। জ্যামে আটকে পড়া অনেকের মাঝে খাবার বিলিয়ে দিচ্ছিল। ঢাকা কখনই এমন দৃশ্য চাক্ষুষ করেনি। লন্ডনের দ্য ইকোনোমিস্টের অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, স্কুলপড়ুয়া এই প্রহরীরা সংখ্যায় ছিল হাজার হাজার। তাদের সঙ্গে শিগগিরই যোগ দিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আগস্টের শুরুর দিকে তারা পুরো ঢাকার ট্রাফিকে শৃঙ্খলা নিয়ে এলো। এটি ছিল বেশ শক্তিশালী ঘরানার স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ। ২৯শে জুলাই যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতায় দ্রুতগামী এক বাস আরেকটির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে অপেক্ষমাণ জটলার ওপর চাপা দেয়। মারা যায় দুই স্কুলশিক্ষার্থী। এরপরই আন্দোলন শুরু হয়।
নরওয়েতে মানুষ হতাহত হওয়ার মতো দুর্ঘটনায় পড়ার ঝুঁকি যত, তার চেয়ে ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকি বাংলাদেশে। এ ছাড়া নব্বই দশকের পর বাংলাদেশে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। কিশোর-কিশোরীদের ঝুঁকি আরো অনেক বেশি। শহরের সড়কে নেই কোনো গতিসীমা। সড়ক নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারি সংস্থায় বাজেটে তেমন অর্থ বরাদ্দ করা হয় না। সড়কে চলাচলরত অর্ধেক গাড়িই অনিবন্ধিত। অনেক চালকের নেই লাইসেন্স। ট্রাফিক পুলিশের মধ্যে আইন প্রয়োগের চেয়ে ঘুষ চাওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। অপরদিকে, ছাত্ররা চায় কোনো চালকের বেপরোয়া গাড়িচালনার কারণে কেউ মারা গেলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হোক। প্রিভন নামে ১৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থীর ভাষ্য, সেদিন যেই দুই শিক্ষার্থী মারা গেল ‘তাদের মধ্যে আমরা যে কেউই থাকতে পারতাম।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদের সরকার খুব দ্রুতই এই প্রতিবাদের নেপথ্যে বিরোধী দলের কালো হাত খুঁজতে লাগলো। যদিও সব কিছুই ইঙ্গিত দেয় যে এই প্রতিবাদ স্বতঃস্ফূর্তভাবে শুরু হয়েছিল, তারপরও রাজনৈতিক মাত্রা থাকাটা আশ্চর্যজনক কিছু নয়। সড়ক নিরাপত্তা বিল বছরের পর বছর ধরে ফাইলচাপা ছিল। আর সরকারের অহঙ্কার ঔদ্ধত্যের পর্যায়ে পৌঁছেছে। তার মন্ত্রীদের একজন শাজাহান খানকে যখন ওই দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলো, তিনি হেসে উঠে জবাব দিলেন, ‘ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যে এক সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৩ জন মারা গেছে। এগুলো নিয়ে আমরা যেভাবে কথা বলি, ওখানে কি এভাবে কথা বলে?’
নিজেদের দাবির তালিকায় শিক্ষার্থীরা শাজাহান খানের পদত্যাগের দাবিও যুক্ত করে। মন্ত্রী হয়েও তিনি আবার বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনেরও প্রধান, যেটি স্পষ্টতই স্বার্থের সংঘাত তৈরি করে। শিক্ষার্থীদের একটি স্লোগান ছিল, ‘মন্ত্রী আর পুলিশকে স্কুল পাঠান, শিক্ষার্থীদের দিয়ে রাস্তা চালান।’
শাসক দল আওয়ামী লীগ এই বিক্ষোভের প্রতি এমন প্রতিক্রিয়া দেখালো যেন এটি ছিল ক্রমশ কর্তৃপরায়ণ শাসনের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি।
প্রথমে, সরকার স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিলো। ইন্টারনেটও বিরতি নিয়ে বন্ধ হলো। এরপর বিক্ষোভকারীদের নিন্দা জানানো হলো। এরপর ৪ঠা আগস্ট তাদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আক্রমণে গেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ বছর বয়সী শিক্ষার্থী মেঘ জানায়, তিনিও এই সমপূর্ণ অহিংস আন্দোলনের অংশ। তাকে ও তার বন্ধুদেরকেও কাঁদানে গ্যাস সইতে হয়েছে। শিক্ষার্থীদের জটলার দিকে রাবার বুলেট ছোড়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের যুব শাখা ছাত্রলীগের লাঠি ও চাপাতিধারী দুর্বৃত্তরা পুলিশের সহযোগিতায় প্রতিবাদকারীদের ভয় দেখিয়ে রাজপথ ছাড়া করার চেষ্টা করেছে। অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা হামলা চালিয়েছে আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের গাড়ি বহরে, যখন তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের একজন সমালোচকের সঙ্গে ডিনার শেষে ফিরছিলেন।
৮ই আগস্ট অবধি খুব অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থীই রাজপথে অবশিষ্ট ছিল। রাষ্ট্র-সমর্থিত সহিংসতা যখন বাড়ছিল, প্রিভনের পিতামাতা তাকে বিক্ষোভে যেতে বারণ করলেন। শ’ শ’ মানুষ আহত হয়েছে। আটক হয়েছেন অনেকে। এর মধ্যে আছেন প্রখ্যাত এক আলোকচিত্রী ও অ্যাক্টিভিস্ট শহিদুল আলম। কাতারভিত্তিক আল জাজিরা চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দেয়ার পর তাকে ৫ই আগস্ট বাসা থেকে তুলে নেয়া হয়। পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন করা হয়। সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। ওই সাক্ষাৎকারে শহিদুল শিক্ষার্থীদের সমর্থন, আর সরকারের সমালোচনা করেছিলেন। উচ্চ আদালতের এক বিচারপতি, যিনি তাকে হাসপাতালে পাঠানোর নির্দেশ দেন, তিনি বেশ হতাশা নিয়েই বলেন যে, ভাগ্য ভালো তাকে গুম করা হয়নি। প্রসঙ্গত, এই কয়েক বছরে সরকারের অনেক সমালোচক স্রেফ গায়েব হয়ে গেছে।
নজিরবিহীন এই কিশোর বিক্ষোভের ওপর দমনপীড়ন এমন সময় এলো যখন সাধারণ নির্বাচনের বাকি আছে আর মাত্র পাঁচ মাস। এই নির্বাচনে শেখ হাসিনা জিতবেন এমনটা প্রায় অবধারিত। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এতদিনে তিনি কার্যত বিরোধী দলকে সরিয়ে দিয়েছেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়া, যিনি বিরোধী দল বিএনপির নেতা, তিনি এখন দুর্নীতির অভিযোগে কারাগারে। তার সমর্থকরা বলছেন এসব অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
বিএনপি ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত গত নির্বাচন বর্জন করেছিল। পরবর্তী নির্বাচনে ভোটাভুটি সুরক্ষিত রাখতে সেনাবাহিনী মোতায়েন চান খালেদা জিয়া। তার দাবি, সংসদ ভেঙে দিতে হবে, নির্বাচনের দায়িত্বে থাকবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যেমনটা আগে ছিল। আওয়ামী লীগ এই দাবি মানতে রাজি নয়। তবে ফের নির্বাচন বয়কট করলে নির্বাচনী বিধান অনুযায়ী বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হবে। সম্ভবত, শিক্ষার্থীদের মাঝেই বিএনপি জন-অসন্তুষ্টি দেখতে পায়, যা দলটি ব্যবহার করতে পারবে।
আওয়ামী লীগ চায় না এই শিশুরা দলটির দীর্ঘদিন শাসনের পরিকল্পনায় ব্যাঘাত ঘটাক। তারপরও দেশের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশই ৩৫ বছরের কম বয়সী। তাই শিক্ষার্থীদের মনোভাবকে বিবেচনায় নিতে হবে। এই শিক্ষার্থীরা শুধু নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েই উদ্বিগ্ন নয়। তারা মনে করছে, চাকরির সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হবে। পাবে শুধু রাজনৈতিক যোগাযোগ যাদের আছে তারাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবরার চৌধুরী বলেন, এই আন্দোলনকে অসংবেদনশীল কায়দায় মোকাবিলা করায় শিক্ষার্থীদের সামান্য সংস্কারের দাবিদাওয়া সরকার-বিরোধী আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। তার ভাষ্য, ‘আমাদের প্রজন্ম ব্যর্থ হয়েছে। অথচ, শিক্ষার্থীরা সকলের জন্য রাষ্ট্রকে পুনরুদ্ধার করছে।’
দ্য ইকনমিস্টের প্রতিবেদন ভাষান্তর করেছে মানবজমিন