অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল মাস দুয়েক আগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল মেধাবী ছাত্র এ আন্দোলনটি শুরু করলেও কালক্রমে এতে সাড়া দেয় সারা দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় আর কলেজের ছাত্র ছাত্রীরা। একযোগে উত্তাল হয় সারা দেশ। বিরোধী দলসহ বিভিন্ন সংগঠন বছরের পর বছর জনসম্পৃক্ত আন্দোলন করতে যেখানে ব্যর্থ হয়েছে সেখানে এই ছাত্ররা শুধুমাত্র কোটা পদ্ধতির সংস্কার চেয়ে আন্দোলন করলেও তাতে সব মত ও পথের সকলের সহযোগিতা পেতে সক্ষম হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে এক বক্তৃতায় কোটা পদ্ধতি পুরোপুরি বাতিল করে দেয়ার গোঁজামিল এক ঘোষনা দিলে সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয় এ আন্দোলন।
পরবর্তীতে অবশ্য আরো কয়েক দফা এই আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ও ঢাকার গুরুত্বপূর্ন পয়েন্টে আন্দোলন জমানোর চেষ্টা করে। প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের প্রেক্ষিতে কোন গেজেট জারি না হওয়ায় তাদেরকে বার বার মাঠে নামতে হয়। কিন্তু প্রতিবারই সরকারের নানা অযুহাতে তারা সে আন্দোলন স্থগিত রেখে তারা ক্যাম্পাসে ফিরে যায়। মূলত সরকার প্রধানের উপর তারা অগাধ আস্থা রেখেই রাজপথ থেকে সরে যায়। আন্দোলনকারীদের এসব কার্যক্রমগুলো প্রমান করে যে এ ছাত্ররা কারও চাপে পড়ে বা কোন বাজে শক্তির ফাঁদে পড়ে এ আন্দোলনে নামেনি। তারা নিরেট ও নিখাদ একটি দাবী নিয়েই আন্দোলনটি শুরু করেছিল। দাবীটি ছিল ভীষন রকম যৌক্তিক আর আন্দোলনের কৌশলও ছিল শান্তিপূর্ন ও অহিংস। কিন্তু এতকিছুর পরও শেষ রক্ষা হলোনা তাদের।
ঈদের পর আবারও এ ছাত্রগুলো আন্দোলনের ইংগিত দেয়। সে হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তারা সংবাদ সম্মেলনও করতে চেষ্টা করে। কিন্তু সেদিন থেকে স্বরূপে ফেরে এ সরকারের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ । এক দল গুন্ডা ও ক্যাডার শ্রেনীর লোকেরা সেদিন থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের উপর বর্বর আক্রমন চালায়। শুধু সেদিনই নয়, পর পর কয়েকদিন, দেশব্যপী বিভিন্ন ক্যাম্পাসে কোটা আন্দোলনকারীদেরকে খুঁজে খুঁজে বের করে তাদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। ডেইলী স্টারের একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, প্রতিটি আক্রমন চালানোর আগেই মোতায়েনকৃত আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা সেখান থেকে সরে পড়তেন ফলে ছাত্রলীগের আক্রমন চালানোর পথে আর কোন বাধা থাকতোনা। বিশ্লেষকমহল এ কারনে ধারনা করছেন যে, সরকারের নির্দেশে এবং প্রশাসনের ছত্রছায়াতেই ছাত্রলীগ এই জঘন্য হামলাগুলো পরিচালনা করেছে।
শুধু তাই নয়, যারা এই ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে পুলিশ তাদের শীর্ষ সবাইকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করছে এবং রিমান্ডেও নিয়েছে। কারও বিরুদ্ধে আইসিটি মামলা আবার কারও বিরুদ্ধে সাধারন মামলা দিয়ে তাদেরকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে এ কথা বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী এই মেধাবী ছাত্রদের সাথে প্রতারনা করেছেন। তার ঘোষনা বাস্তবায়নে সরকার তো আন্তরিক নয়ই, বরং ওটা ছিল একটি রাজনৈতিক স্টান্ট এবং শুধুমাত্র ছাত্রদেরকে রাজপথ থেকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্যই এই ছলচাতুরী করা হয়েছে।
কিন্তু কেন এই নির্বাচনের বছরে এসে ছাত্রদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলো সরকার। আমার কাছে এই ইস্যুতে সরকারকে নৈতিকভাবে পরাজিতই মনে হয়েছে। কোটা সংস্কারকারীদেরকে প্রতিপক্ষ বানানোটা সরকারের কোন প্রয়োজনের মধ্যেই পড়েনা। সরকার যেহেতু মঙ্গলবার একটি গেজেট জারি করে কোটা পদ্ধতি বিশ্লেষন করার জন্য একটি প্রশাসনিক কমিটি করে দিয়েছে সুতরাং এরপর আবার ছাত্রদেরকে হয়রানি করার কোন মানে হয়না। বরং এ ছাত্রদেরকে তাদেরকে আস্থায় রেখেই যৌক্তিক পর্যায়ে কোটা সংস্কার করা যেত। তাতে করে দেশের বিশাল এক যুব সম্প্রদায়কে আওয়ামীলীগ কাছে টেনে নেবার সুযোগ পেত। কিন্তু তা না করে, দেশের যুব সম্প্রদায়কে নিজেদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলাটা আওয়ামীলীগের অদূরদর্শী একটা সিদ্ধান্ত বলেই আমার মনে হয়েছে।
এ ছাত্রগুলো নিজেদেরকে কখনোই বিএনপি জামায়াত শিবির হিসেবে প্রমান করতে চায়নি। বরং তারা নিজেদেরকে বরাবরই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তি হিসেবেই দাবী করেছে। আজ অবধি যত সমাবেশ এই আন্দোলণকারীরা করেছে প্রতিটি সমাবেশের ব্যানারে শেখ মুজিব ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি ছিল। এই ছাত্ররা জয় বাংলা বলেই শ্লোগান দিতো- যা এখন আওয়ামী লীগের শ্লোগান হিসেবেই পরিচিত। এছাড়া যারা এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা সবাই হল পর্যায়ে ছাত্রলীগেরই নেতাকর্মী। প্রশ্ন হলো, এরপরও কেন সরকার তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলো?
যেখানে গোটা বিরোধী দলকে সরকার মামলা- হামলা করে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। যেখানে সরকার বিরোধী দল নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে নানা কুটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে সফলতার সাথে মাসের পর মাস জেলে আটকে রাখতে পেরেছে, অন্য একটি বিরোধী দলের ৫ শীর্ষ নেতাকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করতে পেরেছে, যেখানে একের পর এক স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রহসনের মাধ্যমে সরকারী দল তাদের প্রার্থীদেরকে বিজয়ী করে নিয়ে আসতে পেরেছে, সেখানে অরাজনৈতিক প্লাটফর্মের এই আন্দোলনকারীদের দমনে সরকার কেন এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠলো?
বিগত কয়েকদিনে যেভাবে দেশজুড়ে মেধাবী ছাত্রদেরকে ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা প্রশাসনের মদদে পিটিয়েছে এটার পরিনতি কারও জন্যই শুভ হবেনা, হতে পারেনা। এই যুবকরাই একটা সময়ে প্রশাসনকে নেতৃত্ব দিবে, দেশ পরিচালনা করবে- এই ক্ষতের দাগ তাদের শরীর থেকে সহজেই মুছে যাবে এটা মনে করার কোন কারন নেই। এই ছেলেগুলো সরকারের পক্ষে ছিল, এমনকি যারা নিরপেক্ষ মানসিকতার, তারাও কেউ স্বেচ্ছায় সরকারের সাথে বিরোধে যেতে চায়নি। কিন্তু সরকার এই সাম্প্রতিক পীড়নটা চালিয়ে হয়তো তাদেরকে স্থায়ী শত্রুই বানিয়ে ফেললো। জানিনা, সব কিছুর উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠাকারী আওয়ামী লীগ কেন এই সহজ ভুলটা করলো। এটা নি:সন্দেহে তাদের রাজনৈতিক অদূরদর্শীতা, রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব এবং নৈতিকভাবে পরাজয়- যার খেসারত হয়তো আওয়ামী লীগকে খুব নির্মমভাবেই দিতে হবে।
সরকারের সাথে সাথে জাতির বিবেক বুদ্ধিজীবি শ্রেনীরও এই আন্দোলনে মারাত্মকভাবে পরাজয় হয়েছে। যেসব সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা অনর্গল ছাত্রদের অধিকার ও মেধাবীদের মুল্যায়ন নিয়ে কথা বলতেন তারা পছন্দের দলকে বাঁচাতে গিয়ে এই ইস্যুতে নিরবতা পালন করেছেন। ফলে জনগনও তাদেরকে দলকানা ও অনিরপেক্ষ হিসেবে চিনে ফেলেছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে এসব পরগাছা বুদ্ধিজীবিদেরও যে পরাজয় ঘটেছে তা বলাই বাহুল্য।
সাধারন মানুষ, যারা রাজনীতি বোঝেনা, তারা কেউই সাধারন এসব ছাত্রদের উপর সরকারী দলের এহেন আক্রমনকে মেনে নিতে পারেনি। সার্বিকভাবে এবারের কোটা সংস্কার আন্দোলনে মারমুখী ও বাজে ভুমিকা নেয়ার কারনে জনগনের কাছেও আওয়ামী লীগ সরকারের গ্রহনযোগ্যতা যে শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে তা বলাই বাহুল্য।