অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর শনিবার সশস্ত্র হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। এদিন বেলা ১১টার দিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সংবাদ সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। এর কিছুক্ষণ আগেই তাদের ওপর হামলা চালানো হয়। হামলায় সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক নূরসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। সাধারণ ছাত্রদের ওপরও হামলা চালানো হয়েছে। এসময় আন্দোলনকারীদের হামলা থেকে রক্ষা করতে গেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের প্রধান গ্রন্থাগারিক অধ্যাপক ড. এসএম জাবেদ আহমেদকেও লাঞ্ছিত করে ছাত্রলীগ।
কোটা বাতিল সংক্রান্ত প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর এক মাস চলে গেলেও এ সংক্রান্ত কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করেনি সরকার। দীর্ঘদিন ধরে আশ্বাস দিয়ে রাখলেও এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় সরকারের বক্তব্যের প্রতি সন্দিহান হয়ে পড়ে আন্দোলনকারীরা। এরই মধ্যে সরকারের অনেক মন্ত্রী এমপিরা কোটা থাকবে বলেও বক্তব্য দেন এবং আন্দোলনকারী সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিএনপি জামায়াতের দোসর বলে আখ্যায়িত করেন। প্রজ্ঞাপন জারি নিয়ে সরকারের এমন নয়ছয়ে প্রধানমন্ত্রীর কোটা বাতিলের বক্তব্যের উপর আস্থা হারাতে থাকে আন্দোলনকারীরা। আন্দোলন দমাতেই প্রধানমন্ত্রী এমন বক্তব্য দিয়েছেন বলেই মনে করছেন তারা। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর ইন্ধনেই ছাত্রলীগ শনিবার তাদের উপর হামলা চালিয়েছে বলেও মনে করছেন তারা।
জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার মাস পেরিয়ে গেলেও প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়ায় গত কয়েকদিন ধরেই কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের মধ্যে উত্তেজনা কাজ করছিল। আন্দোলনকারীরা তাদের ফেসবুক গ্রুপে বলছিলেন, আবারও নতুন কর্মসূচি দেওয়া হবে। অন্যদিকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরাও এ আন্দোলনকে যেকোনও মূল্যে প্রতিহত করার ঘোষণা দিচ্ছিলেন তাদের ফেসবুক টাইমলাইনে। শনিবার (৩০ জুন) পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। সেখানেই ছাত্রলীগের অতর্কিত হামলার শিকার হয় তারা।
এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের কয়েকজন সক্রিয় নেতাকে তুলে নিয়ে জিম্মি করে রাখা হয়েছে বলেও জানা গেছে।ক্যাম্পাসে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। হামলার ভয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের মধ্যেও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
কোটা সংস্কারের দাবিতে ডাকা সংবাদ সম্মেলন ও আন্দোলনকে যেকোনও মূল্যে প্রতিহত করার পরিকল্পনা আগে থেকেই ছিল বলে একটি অনলাইন পত্রিকাকে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের একাধিক নেতাকর্মী।
দুপুর দেড়টার দিকে শাহবাগে পাবলিক লাইব্রেরি’র ভেতর থেকে আন্দোলনের ‘স্লোগান মাস্টার’ খ্যাত জসিমসহ কয়েকজন আন্দোলনকারীকে ধরে নিয়ে আসে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। তাদের লাইব্রেরির গেটেই মারধর করা হয়। লাইব্রেরিতে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন,‘পাবলিক লাইব্রেরির ভেতর থেকে ৫ জন ছাত্রকে ডেকে বাইরে নিয়ে মারধর করা হয়েছে।’
লাইব্রেরির সামনে মারধর শেষে জসিমকে দিয়ে কোটা আন্দোলনে সক্রিয় আরও কয়েকজন নেতাকর্মীকে ফোন করিয়ে ডেকে আনার চেষ্টা করা হয়। পরে জসিমকে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করার পর পুলিশের গাড়িতে করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।
হামলার নেতৃত্বে থাকা একজন ছাত্রলীগ নেতা বলেন,‘প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কটূক্তি করছে আন্দোলনকারীদের একাংশ। উনি নাকি প্রতারণা করেছেন। এসব কথা আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ লাইভে এসেও বলছে। এসব কথা শোনার পরই আমরা সিদ্ধান্ত নিই, যেকোনও মূল্যে ওদের প্রতিহত করবো। সে অনুযায়ী আমরা সংবাদ সম্মেলন শুরুর আগে থেকেই ক্যাম্পাসে অবস্থান নিই।’
কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্রতিহত করার জন্য কে বা কারা নির্দেশনা দিয়েছেন— এমন প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তবে কেউ কেউ দাবি করেছেন,বর্তমানে ছাত্রলীগের কমিটি নেই। তাই সে অর্থে কমান্ড দেওয়ারও কেউ নেই। তারা নিজেরাই এ সিদ্ধান্ত নিয়ে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে অবস্থান নেন। তবে আন্দোলনকারীরা বলছেন সরকারের হাইকমাণ্ডের নির্দেশ ছাড়া ছাত্রলীগ কখনোই এভাবে হামলা চালানোর সাহস পেতো না।
অন্যদিকে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক মশিউর রহমানকে দুপুর ১টার দিকে তার হল থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান।
এরপর দুপুর ২টার দিকে মশিউরের ফেসবুক টাইমলাইনে একটি ভিডিওবার্তা পাওয়া যায়। সেই ভিডিওতে মশিউরকে বলতে শোনা যায়, ‘জামায়াত-শিবির, বিএনপির কাছ থেকে টাকা খেয়ে আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে চাইছে মামুন, রাশেদ, নুর, ফারুক।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান বলেন, ‘মশিউর রহমানসহ বেশ কয়েকজনকে হল থেকে তুলে নিয়ে যায় ছাত্রলীগ। পরে মশিউরকে জিম্মি করে ভয়ভীতি দেখিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলিয়ে সেটার ভিডির ধারণ করতে বাধ্য করেছে। পরে সেটা মশিউরের ফেসবুকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। মশিউর কোথায় আছে তা এখনও জানতে পারিনি।’
এদিকে হামলার দায় এড়াতে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বলেছেন, ‘ছবি ও ভিডিও ফুটেজে যদি ছাত্রলীগের কর্মী কাউকে দেখাও যায় মারধর করতে, তবু ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে তাদের বিষয়ে কোনও দায় নেই। কারণ, যেহেতু সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, সেহেতু সে শিক্ষার্থী হিসেবে তার ব্যক্তিগত দায় নিয়েই সেটা করেছে। তাছাড়া এখন ছাত্রলীগের কোনও কমিটি নেই। ফলে দলের পক্ষ থেকে তাদের ব্যাপারে কিছু বলার নেই।’
এদিকে আন্দোলনের নেতা রাশেদ খান জানিয়েছেন, ‘কয়েকদিন ধরে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী ফেসবুকে ও মোবাইলে ফোন করে হুমকি দিচ্ছিলেন। তারা বলেছেন, আমাদের যেখানেই পাবে মেরে ফেলবে। এছাড়া আমাদের জামায়াত-শিবির বলে অপ্রপ্রচার চালাচ্ছে। এসবের প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করতে চাইলে সংবাদ সম্মেলনের আগেই আমাদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের ওপর হামলার পরপরই আমার কাছে আমার বাবা ফোন করেন। আমাদের বাড়িতে নাকি কয়েকজন অচেনা লোক এসে হুমকি দিয়ে গেছে, গালিগালাজ করে গেছে। বলেছে, আমি যদি না থামি তাহলে আমার পরিবারের সবাইকে গুম করে দেবে। আমি এখন আমার পরিবার নিয়েও নিরাপত্তাহীনতায় আছি। জানি না কখন কী হয়।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন শিক্ষার্থীদের একটি যৌক্তিক আন্দোলন। এই আন্দোলন দমাতে ছাত্রলীগকে পেটোয়া বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করে জঘন্য নজির স্থাপন করেছে সরকার। তারা বলেন, শিক্ষার্থীরা কোটা পদ্ধতি রেখে সেটাকে সংস্কারের জন্য আন্দোলন করলেও প্রধানমন্ত্রী রেগেমেগে পুরো কোটা পদ্ধতিই বাতিল বলে বক্তব্য দেন। তখন থেকেই এই বক্তব্য নিয়ে সন্দেহের তৈরি হয়। আন্দোলন দমাতেই যে এই কোটা বাতিলের এই কথিত ঘোষণা ছিলো সেটা এখন স্পষ্ট। কিন্তু তাতেও আন্দোলন দমাতে ব্যর্থ হয়ে সরকার এখন ছাত্রলীগকে ব্যবহার করছে। এটা খুবই ন্যক্কারজনক কাজ। বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, কোটা বাতিল কিংবা সংস্কার যেটাই হোক সরকারের উচিত আন্দোলনকারীদের সাথে এমন ইঁদুর বিড়াল না খেলে অতি দ্রুত ব্যাপারটি পরিস্কার করা।