মুসাফির রাফী
হয়তো চোখের সামনে কোন লেন্দুপ দর্জি নেই। হয়তো সিকিমের মত ভারতের অধীনে আমরা অফিসিয়ালী চলে যাইনি, তবে ভারত যে এখন বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি কিংবা মিডিয়াসহ অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রন করছে তা অনুধাবন করতে বোধ হয় বিশেষ কোন গবেষনার দরকার হয়না।
বেশ কয়েকবছর আগেই পত্রিকায় পড়েছিলাম, বাংলাদেশে ২০১০ সালের হিসাবেই ১২ লাখের বেশি অবৈধ ভারতীয় শুধু বসবাস করছেন যা এখন ১৫ লাখের অধিক ছাড়িয়েছে। ২০১২ সালে, বাংলাদেশ ভারতের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনক্ষেত্র হিসেবে পঞ্চম দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়। সেই বছর এই ভারতীয় অভিবাসীরা বাংলাদেশ থেকে ৩.৭ বিলিয়ন ইউএস ডলার উপার্জন করে ভারতে পাঠিয়েছে। আর অতি সম্প্রতি যে জরিপ পাওয়া গেছে, তাতে বাংলাদেশ থেকেই এখন ভারত সবচেয়ে বেশী পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। ভারতীয় এই অভিবাসীদের বেশিরভাগই পর্যটন ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসেন, তবে একবার ঢোকার পর এদের বের হওয়ার কোন প্রবণতা দেখা যায় না।
এরা যে শুধু বসবাসই করছে তাই নয়, বরং দেশের উচ্চপদের চাকরির একটা বিরাট অংশই তাদের দখলে। বায়িং হাউস, ব্যাংক, হাসপাতাল ও মোবাইলফোন কোম্পানিগুলোর উদাহরণ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এইসব প্রতিষ্ঠানের হর্তাকর্তা পজিশনের অধিকাংশই ভারতীয়। বিনিয়োগের আড়ালে বিশেষ করে ভারতীয় হিন্দুরা তাদের দেশ থেকে বেশি বেতনে লোকজন নিয়ে আসছে। তারা বেতনের টাকাও হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে পাঠাচ্ছে। ফলে একদিকে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশীরা চাকরি পাচ্ছে না, অন্যদিকে হুন্ডির কারণে ভারতীয়দের বিনিয়োগে দেশও উপকৃত হচ্ছে না। রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার জন্য হাজার হাজার বিদেশী নাগরিক বিশেষতঃ ভারতীয় নাগরিক অবৈধভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যম পর্যায় বা শীর্ষ পদে চাকরি করছে। বছরে এক একজন বিদেশী নাগরিক গড়ে ১ থেকে দেড় কোটি টাকা আয় করলেও তারা কোনো কর দিচ্ছে না।
এত গেলো অর্থনীতির পরিসংখ্যান। সাহিত্য সংস্কৃতি ও মিডিয়ার কত লোক যে ভারতের ইন্ধনে জীবন চালায় তা গননা করা কঠিন। এদের একটা বিরাট অংশই ভারতে বৃষ্টি হলে বাংলাদেশে মাথায় ছাতা দিয়ে বসে থাকে। এরা অধিকাংশই এজেন্ডা নিয়ে কাজ করে। কৌশলে সীমানা তুলে দিয়ে একভুমির স্বপ্ন দেখে, সেই লক্ষ্যে ক্যাম্পেইনও চালায়।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এই অনাচারগুলো চলছে প্রশাসনেরই সহযোগিতায়। এসব দেখে যাদের নাকি ব্যবস্থা নেয়ার কথা, তারাও ভারতের কাছে মাথা বিক্রি করে দিয়েছেন অনেক আগেই। রাজনীতির মাঠে আমরা অসংখ্যবার দেশ বিক্রির গল্প শুনেছি। এও শুনেছি অমুক নেতা ভারতের দালাল, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট ইত্যাদি। এটাও শুনেছি, অমুক ট্রায়াল, অমুক মামলা নাকি ভারতের ইশারায় চলছে। ভারতই নাকি মামলার রায়ের ডিকটেশন দিয়ে দেয়। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেশ কয়েকবার সংসদে দাঁড়িয়ে এবং জনসভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেছেন, গ্যাস বিক্রি করতে রাজী হননি বলেই নাকি তিনি ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসতে পারেননি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, জনগনের ভোটে কিছু হয়না। বিদেশীরাই নির্ধারন করে যে কারা বাংলাদেশে ক্ষমতায় আসবে বা দেশ চালাবে।
বর্তমান সরকারকে অনেকেই ভারতের আস্থাভাজন সরকার হিসেবে অভিহিত করে। এই সরকার নাকি ভারতের পরিকল্পনাতেই ক্ষমতায় এসেছে। ভারতের পূর্ববতী কংগ্রেস সরকারের সাথে এই সরকারের যে ভিন্ন কানেকশন ছিল তা অবশ্য এত বছর পরে ফাঁস হয়েছে যখন ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রনব মুখার্জী তার আত্মজীবনীতে ওয়ান এলিভেন এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার প্রেক্ষাপট এবং তার ভুমিকার বিষয়টা স্পষ্ট করেছেন। আবার এও শুনি যে, প্রনব বাবু প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ সফরকালে বিএনপি তার সাথে সাক্ষাত করতে যায়নি, সেই জন্যই নাকি ভারত বিএনপির উপর রুষ্ট। এমনকি এই মুহুর্তে খালেদা জিয়ার জেলে থাকার পেছনেও নাকি ভারতের সেই অসন্তোষও একটা ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে।
তবে আওয়ামী লীগ বা বিএনপির সাথেই যে শুধু ভারতের কানেকশন আছে তাও কিন্তু নয়। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদও দুই দিন পর রহস্যজনক কারনে ভারতে যান। সেখানে গিয়ে তিনি বেশ সম্মানও পান। একইভাবে কিছুদিন পর পর ভারতে গমন করেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, এই সব পাতি দলের ছোট নেতারাও ভারতে গেলে ব্যপক সম্মাননা পান। তারা ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী এমনকি রাষ্ট্রপতির সাথেও দেখা করার সুযোগ পান। অথচ অন্য অনেক দেশের মন্ত্রী-মিনিস্টাররাও ভারত সফরে গেলে এই সুযোগ পাননা।
সম্প্রতি একটা খবর বেশ ভাইরাল হয়েছে। বাংলাদেশের আরেক পাতি দল এলডিপির প্রেসিডেন্ট অলি আহমেদকে নাকি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি ফোন দিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। কর্নেল অলিকে বাংলাদেশেই কেউ তেমন দাম দেয়না। তিনি বিএনপির উচ্ছিষ্ট। মাঝে মাঝে মিডিয়াতে হাজির হয়ে বড় কিছু কথা বলা ছাড়া তার তেমন কোন ভুমিকাও নেই। আর নরেন্দ্র মোদি বিশ্বের সর্ববৃহৎ গনতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী। কর্নেল অলির জন্মদিনে তার কি আসে যায়?
অথচ এই বিস্ময়কর ব্যপারটাই ঘটেছে। এই ঘটনাটিকে অনেকে তেমন গুরুত্ব না দিলেও বস্তুত এটা হালকা কোন ঘটনা নয়। এটা বাংলাদেশের মাথার পর কালো মেঘেরই ইংগিত বহন করে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, মূল দু’দলের বাইরে বড় দুই জোটে থাকা পাতিদলগুলোকেও ভারত নিয়ন্ত্রন করতে চায়। মুলত আওয়ামী লীগ বা বিএনপি যেন জোটে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রন না পায়, সেটাকে চেক এন্ড ব্যালেন্স করতেই ডিভাইড-রুল পলিসির অংশ হিসেবেই ভারত এই কৌশলে অবতীর্ন হয়েছে।
প্রকৃত বাস্তবতায় মনে হয়, আমরা পিন্ডির কাছ থেকে মুক্ত হয়ে দিল্লীর অধীনে চলে এসেছি। বিগত ১০ বছরে বাংলাদেশের উপর ভারত যেভাবে আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করেছে, এরকম নজির এর আগে কখনো দেখা যায়নি। তবে ভারতের এই সব গেম আর কুটকৌশলের হাত থেকে মুক্ত হতে না পারলে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব যে হুমকির মুখে পড়বে তা বলাই বাহুল্য।