সাইফ মানিক
পেছন ফিরে দেখে কামাল আতাতুর্কের সেনারা ১৯৬০ সালের ১৭ মে আদনান মেন্দেবেসকে ফাঁসি দিয়ে গণতন্ত্রের কবর রচনা করেছে। এরপর ১৯৯৭ সালে আরবাকানকে নিষিদ্ধ করে কিন্তু আরবাকান ৩ বছর পাওয়া সময়ে তুরস্ককে দিয়েছেন ২৭০ টিরও বেশি ভারী শিল্পকারখানা। যদি তিনি আরও কিছু দিন থাকতেন তবে আমেরিকার শিল্পকারখানাকেও ছাড়িয়ে যেত তার সৃষ্টিকর্ম।
এরদোগানের বেলায় তাই ভাবল আমরাতো ভালই আছি। বিরোধী সকল নেতা ঐক্যবদ্ধভাবে গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিলেন। জনগণ গুলির সামনে বুক পেতে দিলো, ট্যাঙ্কের নীচে পিষ্ট হলো, রক্ষা পেল গণতন্ত্র।
পশ্চিমা মিডিয়া অভ্যুত্থানকারীদের আবারও পথ দেখালো আরেকটা অভ্যুত্থান হতে পারে। এরদোগানও পাল্টা জরুরি অবস্থা ঘোষণা ও জনগণকে নিয়ে মাঠে থাকলেন। মানুষ দিনরাত পাহারা দিল গণতন্ত্র। অভ্যুত্থান ঠেকাতে এরদোগানের পন্থা এ ও বি। পন্থা এ পালন করা কঠিন ছিল বিধায় পন্থা বি কার্যকর করেন। গণতন্ত্র ও জনশক্তির কাছে পরাজয় ঘটে অভ্যুত্থানকারী সেনাবাহিনীর, ১২০ জনেরও বেশি জেনারেল এবং এডমিরালকে গ্রেফতার ও পদচ্যুত করা হয়। সেনা সদস্য, শিক্ষক, বিচারপতি, পুলিশসহ সকল বিভাগে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা হয়। যা নিয়ে পশ্চিমারা উচ্চবাচ্য করলেও ছাড় পায়নি কেউ। রাশিয়া তুরস্কের পাশে থাকার ঘোষণা দেয়। এরদোগান সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের সাথে কথা বলেন। অথচ ইউরোপ আমেরিকাসহ অনেক পশ্চিমা দেশ খুব খুশি হয়েছিল। বরং অভ্যুত্থানের সময় কোন কোন দেশ আশ্রয় দেয়ার প্রস্তাব দিলে তা প্রত্যাখ্যান করে এরদোগান শহীদী চেতনাকে ধারণ করে হাজির হন জনতার কাতারে।
সিরিয়া পরিস্থিতি আলোচনার এক ফাঁকে রুশ বিমান ভূপাতিত করার সম্মানজনক সমাধানে পৌঁছে যায় তুরস্ক ও রাশিয়া আর এদিকে আমেরিকার সাথে চলতে থাকে বাকযুদ্ধ। রাশিয়ার সাথে বিরোধের সময় আমেরিকা ও ন্যাটো মিসাইল ডিফেন্সসহ সকল প্রতিরক্ষা সুবিধা প্রত্যাহার করে, বিপদে পড়ে যায় তুরস্ক। তাই তড়িঘড়ি করে রাশিয়ার সাথে সম্মানজনক সকল প্রতিরক্ষা সুবিধা প্রত্যাহার করে, বিপদে পড়ে যায় তুরস্ক। তাই তড়িঘড়ি করে রাশিয়ার সাথে সম্মানজনক সমাধান ও পশ্চিমাদের তুষ্ট করতে ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ও ড্রোন ব্যবস্থার উন্নয়নকল্পে একটি সম্মানজনক চুক্তিতে পৌঁছে যায় তুরস্ক।
এদিকে আইএস বিতাড়নের নামে তুরস্ক শুরু করে ‘ইউফ্রোটিস শেল্ড’ অপারেশন। এতে পশ্চিমা বিশ্লেষকরা বলতে শুরু করে এতগুলো জেনারেল হারিয়ে তুরস্ক দুর্বল হয়ে পড়েছে, তাই সিরিয়ায় যুদ্ধে জড়ালে তারা এক সপ্তাহও টিকবে না। কিন্তু বাস্তবে হলো তার উল্টো, সবাইকে তাক লাগিয়ে সৈন্য পাঠিয়ে শহরের পর শহর জয় তুরস্ককে দিয়েছে এক অনন্য স্বীকৃতি। ইরাকেও তার্কিরা সাফল্যের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে।
মিশরে সালাউদ্দিন আইয়ূবী যেমন সুদানীদের দ্বারা বড় বড় দুটি বিদ্রাহ মোকাবেলা করেছিলেন ঠিক তেমনি এরদোগানকেও করতে হচ্ছে। এরদোগানের সামনে আছে মুরসির ইতিহাস। আওরঙ্গজেবের দ্বারা সুজাসহ কয়েকটি ইতিহাস তাই শক্ত হাতে এরদোগান মোকাবেলা করে চলেছেন এ বিদ্রোহ।
এরদোগান হুমকি দিলেন যেই মানবী যে কুর্দিদের পাশে দাঁড়াবে তাদের জন্য তুরস্কের আকাশসীমা হারাম। কে সামনে তা দেখব না।
সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটানোর জন্য অট্যোমানদের বিজয় বাহিনী ও ঐতিহ্যের আলোকে তুর্কিদের সাফল্যের মঞ্চনাটক ও টিভি নাট্যকারদের মাধ্যমে হারানো স¤্রাজ্যের নানা উত্থান পতনের বিভিন্ন বাক ও রহস্যের সাথে রোমাঞ্চ দিয়ে তুর্কিদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ হাজির করছে প্রতিদিন।
সিরিয়ায় তুরস্কের আনুষ্ঠানিক সৈন্য পাঠানোতে হকচকিয়ে যায় বিশ্ব। তুরস্কের এই পরিবর্তিত কূটনৈতিক সফলতায় পশ্চিমাদের গায়ে জ্বালা ধরেছে। তার চেয়েও বড় ব্যাপার ৭ মার্চ ২০১৭ তে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর দক্ষিণ আনতালিয়া শহরে সিরিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে আমেরিকা, রাশিয়া ও তুরস্কের সেনাপ্রদানদের বৈঠক তুরস্ককে অবশ্যই একটা পর্যায়ে উপনীতি করে দিয়েছে।
আসুন জেনে নেই কুর্দিদের যৌক্তিক আন্দোলন কোন পথে, কুর্দিদের হাতে শুধু সাধারণ মানুষের রক্তের দাগ পশ্চিমাদের মদদে সেনাবাহিনীর পবিত্র পোশাক প্রতিনিয়ত চিরে ফেলছে কুর্দিরা। তুরস্ক দেখেছে কিভাবে সুদান থেকে দক্ষিণ সুদানকে আলাদা করেছে পরাশক্তিগুলো। সেখানে এখনো দুর্ভিক্ষ চলছে। ঠিক একই কায়দায় ইন্দোনেশিয়া থেকে পূর্ব তিমুরকেও আলাদা করেছে পশ্চিমারা। তাই তুর্কি জনগণ, সেনাবাহিনী ও সরকার দেশের স্বাধীনতা রক্ষা ও সীমান্তের অখ-তার জন্য সবকিছু দিতে প্রস্তুত।
এখন কথা হচ্ছে সিরিয়ায় ও তুরস্কে কুর্দিদের সাথে কোন খারাপ কিছু হয়ে যায় তবে তা হবে পশ্চিমাদের জন্যই। পশ্চিমারা চাইছে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের মত আরও এক নতুন বিশ্বস্ত বন্ধু। আর তুর্কি কুর্দিদের দিয়ে উঠতি পরাশক্তি তুরস্ককে ভাগ করে ইউরোপের রুগ্ন মানুষ বানিয়ে রাখলে ইউরোপ-আমেরিকারই লাভ।
পশ্চিমারা যখন বিশ্লেষণ করছে তুর্কি সেনাবাহিনী ধরপাকড় ও অব্যাহতির কারণে দুর্বল হয়ে পড়ছে। এরদোগান তখন দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করলেন সেনাবাহিনী দুর্বল না শক্তিশালী করতে একটি প্রতিরক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় করা হবে।
তুরস্কের সকল বাহিনীকে ঢেলে সাজানোর জন্য যা কিছু প্রয়োজন আমরা করব। ইতোমধ্যে ড্রোন উন্নয়নের জন্য ইসরাইলের সাথে সমঝোতা এবং ২৯ জানুয়ারি ২০১৭ তুর্কি বিমান বাহিনীর আধুনিকায়নের জন্য ১০০ মিলিয়ন পাউন্ডের চুক্তি হয় বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসামের সাথে। এর ক’দিন পরেই ছুটে আসেন জার্মান চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেল। এ যেন পুরো ইউরোপের ভাগ্য তুরস্কের হাতেই, তাই যেকোন মূল্যে এরদোগানকে থামাতেই হবে।
কিন্তু বিপরীতে তর তর করে বেড়ে চলেছে এরদোগানের জনপ্রিয়তা। তাই পৃথিবীর দিকে দিকে এরদোগানকে নিয়ে মিছিল, সমাবেশ, র্যালি, সেমিনার, প্রবন্ধ আরও কত কি!
সকল মুসলমান এরদোগানকে সমর্থন করছে। কি তার্কি, আরবি, বাঙালি, পাকিস্তানী, আফগানী, ইউরোপী, আমেরিকান, রাশিয়ান। সবার স্বপ্ন এরদোগানকে ঘিরে। যদিও অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছিল আরবে জাতীয়তাবাদের হাত ধরেই, ১৯০২ সালে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল।
খোদ ইউরোপের বুকের ভিতর নিশোন্বিত হচ্ছে এরদোগান। আল জাজিরার ২০১৬ সালের জরিপের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি হচ্ছে এরদোগান।
যখন খবর আসল নিজস্ব প্রযুক্তিতে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরির কাজে হাত দিয়েছে তুরস্ক সাথে বিমানবাহী রণতরী তৈরির প্রস্তুতিও চলছে জোরেশোরে। এখানেই শেষ নয়, রাশিয়ার তৈরি সর্বাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি এস-৪০০ পেতে রাশিয়ার সাথে চুক্তি সম্পন্ন। ইউরোপের তখন মাথায় হাত। তুরস্কের বিমানবাহিনীতে যুক্ত হতে যাচ্ছে এস-৩৫ যুদ্ধবিমান আর পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান তৈরির কাজও শুরু করে দিয়েছে তুরস্ক।
এছাড়াও আন্তর্জাতিক বিষয়গুলোতে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নাকগলানো এর কোনটিই যেন তুরস্কের জন্য না, সব করবে মোড়লরা কিন্তু তুরস্ক ব্যাপারটা মানতে নারাজ। এরই সাথে এরদোগান যখন ঘোষণা করেন তুরস্ক আমেরিকার মত শক্তিশালী প্রেসিডেন্ট পদ্ধতিতে ফিরে যাবে, এর জন্য সংসদীয় সকল পন্থা শেষ করে গণভোটে যাচ্ছে। এতে আরও নাশোখ পশ্চিমারা। তুরস্কের কেন প্রেসিডেন্ট পদ্ধতিতে ফেরা আর তাতে কেন এত বাধা? প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি কি পৃথিবীতে অচল, নাকি স্বৈরশাসনের হাতিয়ার, নাকি রাষ্ট্রশক্তিকে জানান দিতে পৃথিবীর সর্বশ্রদ্ধেয় অদ্বিতীয় শক্তিমান এক অলকারিক কর্তৃত্বের আসন। যদি ধরে নেয় ৩টি ক্ষেত্রই বিশেষ প্রয়োজ্য। তবে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়াসহ যেসব দেশে এ পদ্ধতি চালু আছে তাতে কোন উচ্চবাচ্য নেই। তবে তুরস্কের বেলায় কেন এত বাধা, এত উদ্বেগ।
পশ্চিমা সরকার ও মিডিয়া এরকমই। যেখানে ইসলামপন্থিরা জয়লাভ করে সেখানে সেনাবাহিনীকে ইন্ধন দেয় সেনা অভ্যুত্থানের। আর যেখানে ইসলামপন্থী সেনাবাহিনী ক্ষমতায় আসে সেখানে গণতন্ত্র, মানবাধিকার আর আইনের শাসন নিয়ে যত মাথাব্যথা, সব তাদের। এটা পশ্চিমাদের ডাবল স্ট্যান্টবাজি ছাড়া আর কিছুই না। ওদের মিডিয়া ধোঁকাবাজির জন্য যা যা প্রয়োজন সব করে থাকে। যেমন আমেরিকাতে শুটিং করে ইরাকে আল কায়েদার উত্থান দেখায়। সত্যের চর্চা ওদের জীবনে কমই দেখা যায়, বিশেষ করে মুসলিম স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট পদ্ধতিতে ফেরা মানে অতীতে অটোম্যান সা¤্রাজ্যের দিকে ধাবিত হওয়া। কিছুদিন পূর্বে এরদোগান বলেছিলেন, আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য নই কিন্তু ইউরোপের নিয়ন্ত্রক। তাই তুরস্কের বিরুদ্ধে একাট্টা পুরো ইউরোপ। এক এরদোগানকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে ইউরোপের নেতারা। এরদোগান একাই লড়ে যাচ্ছে একপক্ষের একজন মাত্র খেলোয়াড়।
তুরস্ক, জার্মানি ও নেদারল্যান্ডকে নাৎসিবাদ বলায় ক্ষিপ্ত ইউরোপ। শুধু তাই না, এরদোগান বলেছে, কূটনীতি কাকে বলে নেদারল্যান্ডকে শেখানো হবে। যারা আমাদের মন্ত্রীদের সাথে কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ করেছে এবং জনগণকে কুকুর ও ঘোড়া দিয়ে নির্যাতন করে তাদের অবশ্যই শিক্ষা দেয়া হবে। এখানেই শেষ না, এরদোগান বলেছেন, ইউরোপ মুসলমান ও ইসলামের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে।
তুর্কি প্রেসিডেন্ট ১৪ ফেব্রুয়ারি আটক হওয়া সাংবাদিক ডেনিজ ইসলামকে জার্মানির এজেন্ট ও কুর্দি জাতিসত্বার সক্রিয় কর্মী বলে আখ্যা দিয়েছে। প্রমাণ হিসাবে তার সাথে প্রাপ্ত নথি বাস্তব হয়ে কথা বলে। এরদোগান বলেন, ইউরোপের কিছু রাষ্ট্র তুরস্কের উত্থানকে মেনে নিতে পারছে না। চারদিকে যখন ইউরোপ আর তুরস্কের বাকযুদ্ধ চলছে তখন মার্কিন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডেভিড লিন্ডফ বলেন, তুরস্ক ও ইউরোপের এই বাকযুদ্ধ ন্যাটো ভেঙে যাওয়ার লক্ষণ। যাই হোক, তাতে লাভ রাশিয়ারই হবে। কারো কারো মতে, যৌক্তিক হলেও এরদোগানের সমালোচনার মাত্রাটা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে। যদিও সামরিক অভ্যুত্থানের পর এরদোগানের শক্তি ও ভিত আরও শক্তিশালী হয়েছে। তবুও সবপক্ষ চুপ থেকে সমস্যার সমাধান করে নিলে উভয়েরই কল্যাণ হবে বৈ অকল্যাণ নয়।
এত সমালোচনার পরও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি ফেরাতে এরদোগানের সমর্থন করেছেন অটোম্যান শাহজাদী নীলহান। সাথে শাহজাদা ও শাহাজাদীরাও এরদোগানের প্রতি বেজায় খুশি। আর জনগণ তো ম্যান্ডেট নিয়ে অপেক্ষা করছে ১৬ এপ্রিলের জন্য।
তুর্কি প্রেসিডেন্ট বলেন, ইউরোপ শঠতা ও ভ-ামির আশ্রয় নিয়েছে। ইইউ’র অনেক দেশে এখনও মানবাধিকার নেই। ইইউ বাড়াবাড়ি করলে শরণার্থী চুক্তি বাতিলের হুমকি দেন এরদোগান। বর্তমান ইউরোপ তুরস্কের হাতে অনেকটাই জিম্মি।
এদিকে সিরিয়ায় তুরস্কের সাফল্যের পর সিরিয়ার ৫০ জন কুর্দি, আরব, শিয়া, সুন্নি গোত্রপতিরা তুরস্কের ডাকে সাড়া দিয়ে বৈঠক করেন। অটোম্যান স¤্রাজ্যের চেতনা থেকে পূর্বেও এ রকম ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল সিরিয়ার আমির-উমরাদের। তুরস্কও তাদের সাদরে গ্রহণ করেছে আপন ভেবে।
যাহোক, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট পদ্ধতিতে রূপান্তর মানে পশ্চিমাদের মদদে আরেকটি সেনা অভ্যুত্থান ঘটানো কঠিন হয়ে যাবে। তাই যেকোন মূল্যে তুরস্কের প্রেসিডেন্টপদ্ধতিতে ফেরা ঠেকানো।
কারণ প্রেসিডেন্টের নির্বাহী আদেশের সামনে তুর্কি সেনাবাহিনী বাধ্য শক্তিসম্পন্ন এক জেনেসারী বাহিনী হয়ে যেতে পারে। যাদেরকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাহিনী বানানোর জন্য এরদোগান সকল সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুত
এরদোগানের মনে আছে, কিং ফয়সালকে কিভাবে হত্যা করা হয়েছিল। মুরসির উৎখাতসহ পূর্বের ইতিহাস তাকে শক্ত হাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য করছে। এ প্রজন্মের তরুণ তুর্কিরা কষ্ট সহিষ্ণু, বনাঞ্চল-পাহাড়-পর্বতের ঢালে বাস করা মানুষ এবং সাগরপাড়ের হৃদয়হীন মানুষগুলো পুরনো ঐতিহ্য আর ইসলামী মূল্যবোধে বেড়ে ওঠা। যদিও তুরস্কের ৭৫% মানুষ শহরে বাস করে। এ মানুষগুলো নতুন পৃথিবীকে গড়ার প্রত্যাশায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবে না তার নিশ্চয়তা কে দিবে?
কারণ তারা জানে, আমাদের অতীত আছে, বিজয়ের সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে, অভিজ্ঞতা আছে সেই ৫ হাজার বছরের।
হিটাইট, ফ্রীজীয়, গ্রীক, গ্রীক, পার্সিক, রোমান, আরব ও সেলজুকসহ আরও কতজ্ঞান ও সভ্যতার সংমিশ্রণ যেন এখানেই। রোমানদের ৯০০ বছরের শাসন, অটোম্যানদের ৬০০ বছরের শাসনের স্মৃতি যেন আজ নতুন করে নাড়া দিচ্ছে। সেই অর্থনীতি আর অংহকারের প্রাচীন পৃথিবী যেন ইস্তাম্বুল যেন আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইউরোপের সবচেয়ে বড় এবং ব্যস্ত দুটি বিমানবন্দরের একটি এই ইস্তাম্বুলেই।
তুরস্ক অর্থনৈতিকভাবে ইইউয়ের প্রথম সারির কয়েকটি দেশের পরেই উঠে এসেছে, তুরস্কের যে গতি তার সামনে দাঁড়ায় কে। এ যেন উদীয়মান এক শক্তির নাম তুরস্ক।
জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিগমার গ্যাবরিয়েল বলেছেন, তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নে ঢোকার সম্ভাবনা বর্তমান সময়ের মত আর কখনও এতটা কমে যায়নি। এটা ইইউ-এর ভ-ামি তারা কখনও চায় না যে, তুর্কিরা ইইউয়ের সদস্য হোক। কারণ, ইইউয়ের অনুসারী অনেক তুর্কি শাসক গত হয়েছে তাতে তুর্কিদের কোন লাভ হয়নি।
ইউরোপ আমেরিকায় পৃথিবীকে যা দেয়ার তার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে ক্লান্ত, ক্যারিং ক্যাপাসিটির সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এখন তাদের উপরে উঠতে হলে ছাদ ফুটো করতে হবে। অথচ অন্যরা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেছে। একটা সময় পর ইউরোপের কিছু কিছু দেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়বে।
ইইউ ও আমেরিকা তার সবটুকু উজাড় করে দিয়ে ক্লান্ত। তাদের জ্ঞান, যোগ্যতা, প্রযুক্তি, অভিজ্ঞতা আজ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
পশ্চিমাদের মানবসম্পদ আজ বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছে আর তুর্কিরা নতুনের কেতন উড়াচ্ছে। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে তুর্কিরা আজ এখানে। পলিটিক্সে ১০০’তে ১০০ না বুঝলেও অন্তত ৮০ বুঝতে পারে। তারা খুঁজে পেয়েছে এ যুগের নতুন সুলতান সুলেমান যার নাম এরদোগান।
তাই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট পদ্ধতিতে ফেরা মানেই অটোম্যান সা¤্রাজ্যের দিকে ধাবিত হওয়া। রাজনীতিতে একটা কথা আছে, অভিজ্ঞতা, শক্তি, অর্থ সবগুলোই যেন তাদের সাথে যায়। তুর্কিদের রক্তে মিশে আছে শক্তি, ঘুমিয়ে আছে ক্ষমতার আগ্নেয়গিরি, ঘুমান্ত আগ্নেয়গিরি জেগে উঠে ভয়ঙ্করভাবে।
তুর্কিদের প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির আগমন মানে, নতুন শক্তির পদধ্বনি। শরীয়তের তাৎপর্যে সালতানাত ও খেলাফতের আলাদা মর্তবা বহন করে। তবুও খেলাফতের অলঙ্কারিক রূপান্তরে খানিকটা বুঝি প্রেসিডেন্ট পদ্ধতিতে দেখা যায়। যখন বারাক ওবামা তার বিলের বিরুদ্ধে সিনেটের অবস্থানের বিপরীত দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, আমি আমার সর্বোচ্চ নির্বাহী ক্ষমতা ব্যবহার করব এ বিল পাস করতে, সবাই তখন বলেছিল, এটি তার স¤্রাটসুলভ আচরণ।
অনেকে ভাবতে শুরু করেছে, ১০০ বছর পরে নতুন সালাদিনের পুরনো সা¤্রাজ্যে ফেরা, নাকি ওসমানি সা¤্রাজ্যের গোড়াপত্তনের মূল কাগির লোকচক্ষুর অন্তরালে আদর্শ ও অনুপ্রেরণার সাহসীসালার, অটোম্যান সুলতানদের সুলতান এ যুগের আর্তগুরুল হয়ে এরদোগানের উত্থান। ইতিহাস ও গবেষণা বলছে, পৃথিবীতে প্রতি ১০০ বছরে বড় বড় একটি বা দুটি যুদ্ধের মাধ্যমে পৃথিবীর মানচিত্রের পরিবর্তন ঘটেছে। আমরা কি সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে?
যে এরদোগানের সাহস আর কর্ম ছুঁয়ে বয়ে আসবে তুর্কিদের নতুন দিন। তাই ইউরোপের মনে পড়ে যায়। হাঙ্গেরী, পোল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, ইউক্রেন, বুলগেরিয়া, অস্ট্রিয়া, আলবেনিয়া, কসোভো, বসনিয়া, হারজেগোবিনা আরও কত দেশ অটোম্যানদের বশ্যতায় বিশ পার করেছে যুগের পর যুগ। যার ক্ষত আজও বয়ে বেড়ায় ইউরোপ। মুসলিমরা সকল জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে, তাই মুসলিম বিশ্বে এরদোগানকে নিয়ে এত মাতামাতি। চারদিক থেকে আওয়াজ উঠছে সৌদি, তুরস্ক আর পাকিস্তানের নেতৃত্বে মুসলিম জাতিসংঘ চাই।
আজকের পৃথিবী জাতীয়তাবাদের অষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। কারো শ্রেষ্ঠত্ব কেউ মানতে নারাজ। ইসলামের আদর্শিক সৌন্দর্য ও বিশ্বাসে জাতীয়তাবাদের কোন স্থান নেই। এর বড় প্রমাণ খেলাফত আন্দোলন এবং ১৯২০ সালে করমচান্দ গান্ধীর প্রতি সমর্থন প্রদান করেন।
তাই প্রেসিডেন্ট পদ্ধতিতে ফেরার তালগোলে এরদোগানকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা হবে না তা বলা মুশকিল। কারণ বাদশাহ ফয়সাল তার জলন্ত প্রমাণ।
যাহোক, পশ্চিমারা তুরস্কে অনেক দাদাগিরি ফলিয়েছে। এখন সুযোগটা একটু কম, তবুও দেখার বিষয় কি হয়। এরদোগানকে ভাবতে হবে, আমেরিকা ইউরোপের সাথে বাদানুবাদ করে ক্ষতি ছাড়া লাভ নেই। ন্যাটো তার বড় হাতিয়ার। জন্মগত শত্রু রাশিয়া যত কাছেই আসুক না কেন, সাবধান হওয়া দরকার, ইউরোপ এবং আমেরিকার যেমন তুরস্ককে দরকার তুরস্কেরও এখন অনেক কিছু ইউরোপ আমেরিকা থেকে পাওয়ার বাকি আছে।
যত যাইহোক, এরদোগানকে মনে রাখতে হবে, সবার সাথে শত্রুতা ভাল ফল বয়ে আনে না। ডানপন্থিদেরসহ সকলের সাথে যৌক্তিক বিরোধ মিটিয়ে ফেলা হবে এরদোগানের দূরদর্ষিতার পরিচয়।
শেষ করছি আমার অনুভূতি দিয়ে প্রেমের উপাখ্যান হেলেনের টয়নগরী ইতিহাসের তীর্থভূমি, প্রকৃতির স্বর্গরাজ্য, প্রাচুর্যের আধিক্য, সাত পাহাড়ের অপূর্ব সমাহার, মহাদেশ বিভক্তির জলরেখা বসফরাস, তপকাপিয়া প্রাসাদ, ব্লু ও সলেমানিয়া মসজিদ, খৃস্টান ও মুসলমানদের জীবন্ত সাক্ষী হাজিরা ফোফিয়া। অতপর রাসূল (সা.)-এর ভবিষ্যৎ বাণীর সমাহারে ভাললাগা-ভালবাসা আর প্রাপ্তির প্রণয় ঘটেছে এখানেই। আমি মুগ্ধ নয়নে মননের বিশ্বাসে ইতিহাসের সোনালী ফ্রেমে ওসমানী খেলাফত ছুঁয়ে দাঁড়িয়েছে। অনন্তকাল তাকিয়ে এ চোখ ঝাপসা হয়নি আজও।
তথ্যসূত্র :
১. তুরস্কের ইতিহাস, ২. বিবিসি, ৩. সিএনএন, ৪. রয়টার্স, ৫. প্রথম আলো, ৬. কালের কণ্ঠ, ৭. উইকিপিডিয়া, ৮. নয়াদিগন্ত, ৯. সংগ্রাম, ১০. আরটিএনএন, ১১. টিআরটি, ১২. আল জাজিরা, ১৩. ইস্তাম্বুল যাত্রীর পত্র, ১৪. প্রাণ ছুঁয়ে দেখি, ১৫. একশত বছরের রাজনীতি, ১৬. তার্কি আর্মি ইউটিউব।
আরও পড়ুন: এরদোগানের তুরস্ক : ইসলাম ও গণতন্ত্রের এক মডেল (১ম পর্ব)
সূত্র: সংগ্রাম