সিলেটের এমসি কলেজের ঐতিহ্যবাহী ছাত্রাবাসে অগ্নিসংযোগকারী হিসেবে ২৯ জনকে চিহ্নিত করেছে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি।
এঁদের অধিকাংশই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। বাকিরাও সরকারি দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের সবার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত।
২০১২ সালের ৮ জুলাই সন্ধ্যায় ছাত্রশিবির ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষের জের ধরে কলেজের ঐতিহ্যবাহী ছাত্রাবাসে আগুন দেওয়া হয়। এতে ৪২টি কক্ষ ভস্মীভূত হয়। ঘটনার পাঁচ বছর পর গত বুধবার সিলেটের মহানগর বিচারিক হাকিম আদালতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। পরদিন বৃহস্পতিবার এ প্রতিবেদনের শুনানি শেষে সিলেটের অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর বিচারিক হাকিম উম্মে সরাবন তহুরা দায়ী ২৯ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন। আদালতের বেঞ্চ সহকারী মোহাম্মদ আলী এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিল করতে আদালতের নির্দেশনা ২৯ জনের ঠিকানা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট থানায় কাল রোববার পাঠানো হবে বলে তিনি জানান।
বিচার বিভাগীয় তদন্তে যে ২৯ জনকে দায়ী করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ওই সময় সিলেট সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও বর্তমানে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক দেবাংশু দাস মিঠুর নাম রয়েছে সবার আগে। এরপর পর্যায়ক্রমে দায়ী করা হয়েছে জেলা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি পংকজ পুরকায়স্থ, আবু সরকার (বহিরাগত, শ্রমিক লীগের সাবেক সভাপতি), জাহাঙ্গীর আলম (জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক), মৃদুল কান্তি সরকার, কামরুল ইসলাম, আলমগীর হোসেন (ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও বর্তমানে আইনজীবী ও বিশ্বনাথ উপজেলার রামপাশা ইউপি চেয়ারম্যান), বাবলা, মো. আতিকুর রহমান, লায়েক আহম্মেদ, সিদ্দিক আহম্মেদ ইউসুফ, জহিরুল ইসলাম, আক্তারুল ইসলাম, জসিম উদ্দিন, আসাদুজ্জামান শাহিন, মোহাম্মদ বিন মামুন বুলবুল, আউলাদ, আছরাফ আহমেদ শিপন, নজরুল ইসলাম, অলিউল্লাহ ওরফে ওলিউর রহমান, খুরশেদ আলম, বাছিদ ওরফে আবদুল বাছিদ, আবদুস সালাম, ইমতিয়াজ রফিক চৌধুরী, আবদুল্লাহ ফারুক, কয়েছ ওরফে কয়েছুজ্জামান তালুকদার, আবু রেহান, রুবেল ও জ্যোতির্ময় দাস সৌরভকে।
ঘটনাক্রম
পাঁচ বছর আগে ওই ছাত্রাবাস পোড়ানোর ঘটনায় দেশে-বিদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এমসি কলেজের ছাত্র হওয়ায় ঘটনার পরপরই তাঁরা সরেজমিন পরিদর্শন করে অগ্নিসংযোগকারীদের শনাক্ত করার নির্দেশ দেন। পোড়া ছাত্রাবাস পরিদর্শনে গিয়ে কেঁদে ফেলেন শিক্ষামন্ত্রী।
সিলেট নগরের টিলাগড় এলাকায় ১৮৯২ সালে রাজা গিরিশচন্দ্র রায় তাঁর পিতামহ মুরারি চাঁদের (এমসি) নামে এই কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ব্রিটিশ আমলে ১৯২০ সালে ৬০০ শতক জায়গার ওপর আসাম ঘরানার স্থাপত্যরীতির সেমিপাকা কাঠামোর ছাত্রাবাস নির্মাণ করা হয়েছিল। এ স্থাপত্যরীতির ফলে ছাত্রাবাসটি দেশে-বিদেশে ‘হেরিটেজ’ হিসেবে সমাদৃত ছিল। অবশ্য ঘটনার দুই বছরের মাথায় অবিকল আগের কাঠামোয় ছাত্রাবাস পুনর্নির্মাণ করে শিক্ষাপ্রকৌশল অধিদপ্তর। বর্তমানে ছাত্রাবাসে থাকছেন ছাত্ররা।
অগ্নিকাণ্ডের পরপরই ছাত্রাবাসে আগুন দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবির পরস্পরকে দায়ী করেছিল। ছাত্রাবাস থেকে ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের তাড়াতে ছাত্রলীগের ছেলেরা সেখানে আগুন লাগিয়ে দেন বলে অভিযোগ ছিল শিবিরের। আবার ছাত্রলীগের পাল্টা অভিযোগ ছিল, ছাত্রাবাস ছেড়ে যাওয়ার সময় শিবিরই আগুন দিয়ে পালিয়েছে। ছাত্রাবাস যখন আগুনে পুড়ছিল, তখন পাশ দিয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করছিলেন। এই নিয়ে প্রথম সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছিল প্রথম আলোয়। ২০১২ সালের ১৫ জুলাই প্রথম আলোর প্রথম পাতায় ‘বিক্ষোভকারীরাই আগুন দিয়েছে ছাত্রাবাসে!’ শিরোনামে প্রতিবেদন ছাপা হলে এ নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
ওই অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ছাত্রাবাসটির তত্ত্বাবধায়ক বাদী হয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে নগরের শাহপরান থানায় মামলা করেন। পরে ছাত্রলীগের নেতা দেবাংশু দাশ মিঠু, পঙ্কজ পুরকায়স্থসহ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে শিবিরের দুই কর্মী আদালতে পৃথক দুটি নালিশি মামলা করেন। আদালত তিনটি অভিযোগ একীভূত করে তদন্তের নির্দেশ দেন পুলিশকে। অগ্নিসংযোগকারী শনাক্ত করতে শাহপরান থানার পুলিশ ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) দুই দফা তদন্তের পর সর্বশেষ পুলিশের বিশেষায়িত বাহিনী পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) অধিকতর তদন্ত শুরু করে। পিবিআই তদন্ত শেষে গত ৩১ মে সন্দেহভাজন অগ্নিসংযোগকারীদের (ছাত্রলীগের নেতা) বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ না পেয়ে তাঁদের অব্যাহতির সুপারিশ করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন (ফাইনাল রিপোর্ট) দেয়। চূড়ান্ত প্রতিবেদনের শুনানি শেষে আদালত বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিলে মুখ্য মহানগর বিচারিক হাকিম মো. সাইফুজ্জামান হিরোর নেতৃত্বে বিচার বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়।
আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিচার বিভাগীয় তদন্ত কার্যক্রমের শুরুতে ২০ জুন সর্বশেষ তদন্তকারী সংস্থা হিসেবে পিবিআই সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সারোয়ার জাহানের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। এর পরে পর্যায়ক্রমে ঘটনার সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। এ ছাড়া অগ্নিকাণ্ডের আগে ছাত্রলীগ ও ছাত্রিশিবির কর্মীদের মধ্যে ফুটবল খেলা নিয়ে বচসার জের ধরে ছাত্রলীগের যে কর্মী শিবির কর্মীদের হাতে আহত হয়েছিলেন, তাঁরও সাক্ষ্য রয়েছে।
তদন্তের সাক্ষ্য পর্যালোচনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি উল্লেখ করেছে, ছাত্রাবাস পোড়ানোর ঘটনায় মামলার বাদীসহ ইতিপূর্বে গৃহীত জবানবন্দি প্রদানকারীদের পুনরায় জবানবন্দি গ্রহণের জন্য নোটিশ করা হলে মোট পাঁচজন সাক্ষী উপস্থিত হয়ে জবানবন্দি প্রদান করেন। এ সম্পর্কে পর্যালোচনায় বলা হয়, সাক্ষীদের মৌখিক সাক্ষ্য, ভিডিও ফুটেজ, স্থিরচিত্র, জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এটাই প্রতীয়মান হয় যে এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের দ্বন্দ্বের কারণেই সংঘটিত হয়। প্রথমত ছাত্রলীগের কর্মী উজ্জ্বল আহমদকে ছাত্রশিবিরের কর্মীরা গুরুতর জখম করায় তাৎক্ষণিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। তৎপ্রেক্ষিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। মৌখিক ও দালিলিক সাক্ষ্য বিচার বিশ্লেষণে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ প্রথম আলোকে বলেন, এঁরা এখন ছাত্রলীগের কেউ না। যাঁদের নাম এসেছে পাঁচ বছর আগেই তাঁদের অনেকে সংগঠন থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। আর কেউ সাবেক হয়ে গেছেন। এঁদের দায়ভার সংগঠন নিতে পারে না।
সূত্র: প্রথম আলো
Discussion about this post