নিউইয়র্ক টাইমস প্রতিবেদন
এক সময় নিজ দেশে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে খ্যাতি কুড়ানো, মিয়ানমারের শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী নেত্রী অং সান সুচির বিরুদ্ধে সোমবার চাপ বৃদ্ধি করা হয়েছে। তার দেশে সেনাবাহিনীর অভিযানের নিন্দা জানানো হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে। সেনাবাহিনীর ওই অভিযানের ফলে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে প্রবেশ করছে বাংলাদেশে। এর প্রতিবাদে ফুঁসে উঠছে এ অঞ্চল। সুচির অনুজ শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী (মালালা ইউসুফজাই) টুইটারে সুচির মুখোমুখি হয়েছেন। নোবেল কমিটি মিয়ানমারের এমন নৃশংসতায় প্রকাশ্যে সুচির সমালোচনা করবে নাকি তার নোবেল পুরস্কার বাতিল করবে তা নিয়ে অনেকেই দাবি তুলেছেন, বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। নির্যাতিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে নৃশংসতা চালানোয় সোমবার প্রতিবাদ হয়েছে ক্যানবেরায় অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টের বাইরে। ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় আগুনে পোড়ানো হয়েছে অং সান সুচির ছবি। সেখানে মিয়ানমারের দূতাবাসে ছোড়া হয়েছে গ্যাসোলিন বোমা। ইন্দোনেশিয়ায় বিক্ষোভের আয়োজক ফরিদা। তিনি শুধু এই নামেই পরিচয় দেন। তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গা মুসলিমদের গণহত্যা করা হচ্ছে। আর বাকি বিশ্ব রয়েছে নীরব।
মিয়ানমারে সর্বশেষ সহিংসতা শুরু হয় গত মাসে (২৫ শে আগস্ট)। ওই সময় রোহিঙ্গা উগ্রপন্থিরা মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও পুলিশি চৌকি বা পোস্টে হামলা চানায়। এ হামলার দায় স্বীকার করে আরাকান রোহিঙ্গা সলভেশন আর্মি। তারা ওই হামলা সম্পর্কে বলে, মিয়ানমারের নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা যাতে আর নিষ্পেষণ চালাতে না পারে সে জন্য ওই হামলা চালানো হয়েছে। কিন্তু সেনাবাহিনী তার জবাব দিচ্ছে কঠোরভাবে। তারা এর নাম দিয়েছে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশনস’। মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলোর মতে, সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের শত শত বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। এর ফলে হাজার হাজার রোহিঙ্গা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করছে। তারা (বাংলাদেশে) গাদাগাদি করা শরণার্থী শিবিরগুলোতে ঠাঁই পাওয়ার চেষ্টা করছে।
তাদের এই দুর্ভোগ ক্রমাগত বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। এতে করে নতুন করে সমালোচনা হচ্ছে মিয়ানমারের। সেই সমালোচনা করছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। এর মধ্যে রয়েছে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অনেকে। পাকিস্তানি মুসলিম, সবচেয়ে কম বয়সী নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মালালা ইউসুফজাই সোমবার টুইট করেছেন। তিনি লিখেছেন, কয়েক বছর ধরে বার বার আমি এই ট্রাজিক ও লজ্জাজনক আচরণের নিন্দা জানিয়ে আসছি। এখনও আমি অপেক্ষায় আছি আমার অগ্রজ শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সুচিও তেমনি নিন্দা জানাবেন। এ জন্য বিশ্ব ও রোহিঙ্গা মুসলিমরা অপেক্ষা করছেন। গত বছর মালালা ইউসুফজাই, ডেসমন্ড টুটু ও আরো ১১ জন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী একটি খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। তারা মিয়ানমারের রাখাইনে গণহত্যায় সতর্কতা উচ্চারণ করেছিলেন। অনলাইনে ওই চিঠি ও মালালা ইউসুফজাইয়ের টুইটের দেখেছেন অং সান সুচির সমালোচকরা। তারা মিয়ানমারের এই সঙ্কটের জন্য দায়ী করেন সুচিকে। একই সঙ্গে তারা সুচির শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বাতিল করার জোর দাবি তুলেছেন।
এসব আবেদন অং সান সুচির রাজনৈতিক বন্দিত্বের যে সুখ্যাতি ছিল তার ওপর এক কালো ছায়া ফেলেছে। ১৯৮৮ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর ওই নির্বাচনকে বাতিল করে তাকে গৃহবন্দি করা হয়। ১৫ বছর তিনি সামরিক জান্তার অধীনে গৃহবন্দি ছিলেন। শেষ পর্যন্ত সংবিধানের অধীনে ক্ষমতা ভাগাভাগির চুক্তি হয়। তার অধীনে গত নির্বাচনে সুচির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি ভূমিধস বিজয় অর্জন করে। কিন্তু সংবিধানের অধীনে তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট হতে পারেন না। তাই তাকে বানানো হয় স্টেট কাউন্সেল। তবে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ রয়ে যায় কার্যত সেনাবাহিনীর হাতে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে তিনি রহস্যজনকভাবে নীরব রয়েছেন। সাংবাদিকরা এ নিয়ে তাকে চাপাচাপি করলে তিনি সেনাবাহিনীর সুরে সুর মিলান। সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক মনে করে না। তারা তাদেরকে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে দেখে। ২০১২ সালের সহিংসতার পর ২০১৩ সালে সুচি বিরল এক সাক্ষাতকার দেন। (তখন রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযানকে জাতি নির্মূল অভিযান বলে অভিযোগ করা হচ্ছি। তার জবাব দেন সুচি।) তিনি বলেন, না, এটা জাতি নির্মূল করে দেয়ার অভিযান নয়।
উল্লেখ্য, বিতর্ক সৃষ্টিকারী প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সুচি একাই নন। অতীতে হেনরি কিসিঞ্জার, বারাক ওবামার পুরস্কার বাতিল করতে নোবেল কমিটির কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন এক্টিভিস্টরা। ১৯৯৪ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান যৌথভাবে ইসরাইলের নেতা শিমন পেরেস, আইজাক রবিন ও ফিলিস্তিনের নেতা ইয়াসির আরাফাত। এর প্রতিবাদে নোবেল কমিটির একজন সদস্য পদত্যাগ করেন। তিনি হলেন কারে ক্রিশ্টিয়ানসেন। তিনি ইয়াসির আরাফাতকে ‘টেরোরিস্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। তার মতে, আরাফাত নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য নন। নোবেল কমিটিতে যারা থাকেন তারা সবাই নরওয়ের নাগরিক। তাদেরকে নিয়োগ করে দেশের পার্লামেন্ট। এ কমিটি কখনো কারো পুরস্কার ফিরিয়ে নেয় নি। কমিটির সাবেক সদস্য গুনার স্টালসেট বলেছেন, অং সান সুচির ক্ষেত্রেও নেয়া হবে না। তিনি বলেন, শান্তি পুরস্কার কখনো বাতিল করা হয় না। নোবেল পুরস্কার বিজয়ীর বিরুদ্ধে কমিটি নিন্দা জানায় না। একবার পুরস্কার হাতে তুলে দেয়ার পর নোবেল কমিটির দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়।
উংস: নিউইয়র্ক টাইমস
ভাষান্তর: মানবজমিন
Discussion about this post