কামাল আহমেদ
গত সপ্তাহে যেদিন কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু মেয়র নির্বাচিত হলেন, সেদিন অনেককেই কৌতুক করে বলতে শুনেছি, তাঁর কপালে কারাবাস লেখা হয়ে গেল। যাঁরা এ ধরনের মন্তব্য করলেন, তাঁরা বোঝাতে চাইলেন যে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে নাশকতার মতো ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে পুলিশ তৈরি হয়েই আছে এবং মামলার পর অভিযোগপত্র দিতেও খুব একটা দেরি হবে না। অতঃপর তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে অপসারণের আদেশ জারিতে সরকারের দক্ষতাও প্রশ্নাতীত। সবাই শুধু ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ইশারার অপেক্ষায়।
কুমিল্লার নতুন মেয়র এখনো দায়িত্বই নেননি, সুতরাং তাঁর জন্য আমরা অপেক্ষাতেই থাকলাম। কিন্তু সিলেট আর রাজশাহীর মেয়র দুজন দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর চেয়ারে বসলেন যথাক্রমে দুই ঘণ্টা এবং আট মিনিট। হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র অবশ্য সময় পেলেন আরেকটু বেশি—এগারো দিন। তাঁরা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হলেও তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয়টা এ ক্ষেত্রে কাল হয়েছে বলে মনে হয়। না হলে যে ধরনের অভিযোগে যেভাবে তাঁদের অপসারণ করা হলো, তা বিস্ময়কর। এখন সবার আলোচনায় এই তিন মেয়র। কিন্তু এই তিন মেয়র যে একটি রাজনৈতিক ধারাবাহিকতার অংশ, সে কথা হয়তো অনেকেরই মনে নেই। এই ধারাবাহিকতায় এর আগে অপসারিত হয়েছেন গাজীপুর ও খুলনার মেয়ররা। খুলনার মেয়র মনিরুজ্জামান দায়িত্ব ফিরে পেলেও নিশ্চয়ই তিনি শঙ্কা আর উদ্বেগমুক্ত নন। গাজীপুরের মেয়র এম এ মান্নানের বিরুদ্ধে দফায় দফায় মামলা হয়েছে ২১টি এবং তাঁকেও বারবার অপসারণের পর তিনি কিছুদিন আগে প্রথম আলোকে বলেছিলেন যে তিনি আর তাঁর দায়িত্ব ফিরে পাওয়ার আবেদন করবেন না, কেননা সেই চেষ্টা করলেই তাঁর বিরুদ্ধে নতুন মামলা হবে এবং তাঁকে আবারও জেলের ভাত খেতে হবে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী এবং হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র জি কে গউছ প্রথমবার অপসারিত হন সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যার মামলায়। ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জের বৈদ্যেরবাজারে সংঘটিত ওই হত্যাকাণ্ডের এজাহার বা প্রথম অভিযোগপত্রে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিল না। কিন্তু প্রায় ১০ বছর পর ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পুলিশ সম্পূরক অভিযোগপত্রে আরিফুল ও গউছ দুজনকেই আসামি করল। অতঃপর সরকার স্থানীয় সরকার আইন, ২০০৯-এর ১২(১) ধারায় তাঁদের সাময়িক বরখাস্ত করে দায়িত্ব থেকে অপসারণ করে। তাঁরা আদালতে আত্মসমর্পণের পর জামিন চাইলেও তা প্রত্যাখ্যাত হয় এবং প্রায় দুই বছর বিচারাধীন অভিযুক্ত হিসেবেই কারাবাস করেন। এরপর প্রায় দুই বছর তিন মাস ধরে নানা ধরনের আইনি লড়াই করে তাঁরা জামিন নিয়ে পরে তাঁদের অপসারণের আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়িত্ব ফিরে পান। রাজশাহীর মেয়র মোসাদ্দেক হোসেনও প্রথমবার অপসারিত হন ২০১৫ সালের মে মাসে। তার আগে তাঁর বিরুদ্ধে নাশকতার মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। তিনিও প্রায় দুই বছর আইনি লড়াই করে দায়িত্ব ফিরে পেয়েছিলেন।
ওপরে যে কজন মেয়রের কথা বললাম, তাঁদের মধ্যে অদ্ভুত যে মিলটি লক্ষণীয়, তা হলো তাঁরা সবাই বিএনপির নেতা। তাঁরা হয়তো কুমিল্লার মনিরুল হক সাক্কুর মতো ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেননি, কিন্তু তাঁদের ভোটাররা তাঁদের বিএনপি-সমর্থিত অথবা মনোনীত হিসেবেই জানেন। এসব সিটি করপোরেশন বা পৌর মেয়র অপরাধী হয়ে থাকলে তাঁদের বিচারে কারোরই আপত্তির কোনো কারণ নেই। কিন্তু তাঁদের অপসারণের মাধ্যমে বিচারের আগেই সরকার তাঁদের দোষী হিসেবে এক দফা শাস্তি দিয়ে দিল। এই পদক্ষেপের কারণে ফৌজদারি অপরাধের মামলার বিচারের সময় তাঁরা আত্মপক্ষ সমর্থনে এখন একটা বাড়তি যুক্তি দিতে পারবেন যে তাঁরা রাজনৈতিক হয়রানির শিকার। অথচ রাজনৈতিক হয়রানিটুকু না করা হলে যেসব হত্যা বা নাশকতার মামলায় তাঁদের আসামি করা হয়েছে, সেগুলোর বিচারিক আদালতে তাঁরা ওই যুক্তি দেওয়ার সুযোগ পেতেন না। আসলে ক্ষমতাসীন দল আশু এবং স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক সুবিধা নিতে গিয়ে বড় অপরাধের বিচার–প্রক্রিয়ারই ক্ষতিসাধন করল।
২০১৫ সালের এক হিসাবে দেখা গেছে, বিএনপি–জামায়াতের অন্তত ২৫ জন পৌর মেয়র ও উপজেলা চেয়ারম্যান নাশকতার মামলার কারণে অপসারিত হয়েছেন (জনপ্রতিনিধি অপসারণে সরকারের দ্বৈতনীতি: প্রথম আলো, ২৭ মার্চ, ২০১৫)। বিপরীতে ক্ষমতাসীন দলের হওয়ায় আওয়ামী লীগের মেয়র–চেয়ারম্যানদের বিরুদ্ধে মামলা করে এমন সাধ্য কার। আবার যদি মামলা হয়ও পুলিশ তদন্ত ঝুলিয়ে রাখে। এরপরও দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের অন্তত পাঁচজনের ক্ষেত্রে অভিযোগপত্র দায়ের হলেও তাঁরা তখনো অপসারিত হননি। দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরেও মন্ত্রী পদে বহাল আছেন সেই দৃষ্টান্তের কথা নাহয় না–ই বললাম।
আরিফুল হকের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টে লড়াই করেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন। তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে হাইকোর্টে তাঁর মক্কেল যে আইনি প্রতিকার পেয়েছিলেন, সেই আদেশে কী বলা হয়েছে? তিনি জানালেন, স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনের ২০০৯ সালের যে ধারা প্রয়োগ করে আরিফুল হককে অপসারণ করা হয়েছে, সেই আদেশের কার্যকারিতা আদালত স্থগিত করে দিয়েছেন এবং ওই আইনের বৈধতার প্রশ্ন এখন বিচারাধীন। অভিযোগপত্রে নাম থাকলেই কেউ অপরাধী হয়ে যায় না বিধায় শুধু অভিযোগপত্রে নাম থাকার ভিত্তিতে একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে তাঁর দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখা যায় না—তাঁর এই যুক্তি আদালত গ্রহণ করেছেন বলে মইনুল হোসেন জানান। সরকার হাইকোর্ট বিভাগের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করলেও আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের আদেশ বহাল রেখেছেন। নতুন বরখাস্ত আদেশও গতকাল হাইকোর্টে স্থগিত হয়েছে। সরকার এখন আপিল না করলে বুঝতে হবে তার সংবিৎ ফিরছে। রাজশাহীর বরখাস্ত হওয়া মেয়র মোসাদ্দেক হোসেনের কাছেও
বিষয়টি জানতে চাইলে তিনিও একই ধরনের আদেশের কথা জানান। তিনি বললেন, তিনি আবারও আদালতে যাবেন। কিন্তু গাজীপুরের মেয়র মান্নানের মতো তিনিও যে জেল থেকে বাঁচতে একসময় হাল ছেড়ে দেবেন না, তা বলা মুশকিল।
আমি এর আগে অপসারিত মেয়রদের রাজনৈতিক পরিচয়ে মিল থাকার কথা বলেছি। কিন্তু অন্য আরও এক জায়গায় মিল আছে, মিলটি পাওয়া যায় তাঁদের অপসারণে লাভবান হয়েছেন কারা, সেই সুবিধাভোগীদের রাজনৈতিক পরিচয়ে। একমাত্র সিলেটে নিজেদের দলীয় কোন্দলের কারণে করপোরেশন চলছে প্রশাসক নামে সরকারি আমলা দিয়ে। আর অন্য সব জায়গায় প্যানেল মেয়র ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর। মেয়র পদে যিনি বা যাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতার যোগ্য বলে নিজেদের মনে করেননি বা সাহস করেননি, তাঁরাই এখন পেছনের দরজা দিয়ে মেয়রের দপ্তরের দখল নিয়েছেন। গণতন্ত্রের এ এক অদ্ভুত পরিণতি! অথচ ভোটারদের রায়কে যাতে কেউ নস্যাৎ করতে না পারে, সে রকম একটি রায় আপিল বিভাগের রয়েছে। সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ ধারায় স্থানীয় সরকারবিষয়ক আইন প্রসঙ্গে ওই রায়ে বলা হয়েছিল: ‘এর মানে হচ্ছে, স্থানীয় বিষয়গুলোর ব্যবস্থাপনা করবে স্থানীয় পরিসরে নির্বাচিত ব্যক্তিরা। যদি সরকারি অধিকর্তা কিংবা তাঁদের ভৃত্য বা অনুসারীদের স্থানীয় সরকার পরিচালনায় নিয়ে আসা হয়, তাহলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেগুলো রাখার কোনোই মানে হয় না’ (কুদরত ই এলাহী পনির বনাম বাংলাদেশ: ঢাকা ল রিপোর্টস সংখ্যা ৪৪, ১৯৯২)। সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে যে আপিল বিভাগ রায়টি দিয়েছিলেন, তার অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বিচারপতি এ টি এম আফজাল, বিচারপতি মোস্তাফা কামাল ও বিচারপতি লতিফুর রহমান (এঁরা সবাই পর্যায়ক্রমে প্রধান বিচারপতিও হয়েছেন)।
রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন দল বা সরকার যাতে ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্থানীয় শাসনে ভোটারদের প্রত্যাশাকে নাকচ করার একচেটিয়া সুযোগ না পায়, সে জন্য ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার স্থানীয় সরকার আইনে সীমিত আকারে একটি সুরক্ষার ব্যবস্থা রেখেছিল। সেই সুরক্ষার ভারটি পড়ত আঁতুড়ঘরে মৃত্যু হওয়া স্থানীয় সরকার কমিশনের ওপর। স্থানীয় সরকারের সম্পদ বরাদ্দ থেকে শুরু করে তাদের নানা ধরনের কাজে সহায়তা, তদারকি ও নজরদারির লক্ষ্যে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠনের আইন করে তখন একটি কমিশনও গঠন করা হয়েছিল। স্থানীয় সরকার কমিশনে একজন চেয়ারম্যানসহ তিনজন কমিশনার নিযুক্ত হয়েছিলেন চার বছর মেয়াদে। ওই কমিশনারদের একজন অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ জানালেন, ২০০৯-এ আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর স্থানীয় সরকার কমিশন আইন সংসদে উত্থাপন না করায় সেটি তামাদি হয়ে যায়। কিন্তু ওই আইন থাকলে ২০০৮ সালের সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভা আইনগুলোর বিধান অনুযায়ী মেয়রদের অপসারণে কমিশনের মতামত বাধ্যতামূলক ছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাটি মন্ত্রণালয়ের হাতে কুক্ষিগত রাখতে কমিশনের আইনটিসহ ২০০৮ সালের স্থানীয় সরকার আইনগুলো তামাদি হতে দেয়। কিন্তু ২০০৯ সালে কমিশনের অংশগুলো বাদ দিয়ে নতুন করে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা-বিষয়ক আলাদা আলাদা আইন করে।
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কূটকৌশলে অপসারণের গঠনাটি যেদিন ঘটল, তার ঠিক আগের দিন ঢাকায় বিশ্বের শতাধিক দেশের সাংসদদের এক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, গণতন্ত্র শুধু একটি ব্যবস্থা নয়, এটি সমস্যা থেকে উত্তরণের একটি পথও বটে। তাঁর দলের অনেকে অবশ্য বলে থাকেন যে অগ্রাধিকার হচ্ছে উন্নয়ন। গণতন্ত্রে উত্তরণ তারপর হতে পারে। নির্বাচনব্যবস্থায় নানা ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে আমাদের গণতন্ত্রে এমনিতেই গণরায় বা গণসম্মতির (ম্যান্ডেটে) ঘাটতির কথা বলা হয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনেও অর্ধেকের বেশি আসনে ভোটাররা যে ভোট দেওয়ার সুযোগ পায়নি এবং তখনকার প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি—এ কথাগুলোও সবার জানা। এখন তৃণমূলের গণতন্ত্র, স্থানীয় সরকারব্যবস্থাতেও গণতন্ত্রের পরিপন্থী পদক্ষেপ কোনো ভালো বার্তা বহন করে না। বরং তা শঙ্কারই জন্ম দেয়। এই শঙ্কা গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে।
শেষ করব একটা কৌতুক বলে। ফেসবুক-জমানায় সাধারণ মানুষের রসবোধে আমি প্রায়ই বিমোহিত হই। যেমন হলাম রোববার রাতে। টিভি চ্যানেলগুলোতে তিনটি সংবাদ শিরোনাম। আরিফুল-মোসাদ্দেক-গউছের অপসারণ, প্রশ্নপত্র ফাঁস বিতর্কের পটভূমিতে ট্রেজারি থেকে এইচএসসির প্রশ্ন আনতে গিয়ে স্মার্টফোন সঙ্গে রাখায় তিনজন শিক্ষক বরখাস্ত এবং ৩৫তম বিসিএস উত্তীর্ণদের গেজেট প্রকাশ। তো ফেসবুকে একজন লিখলেন: আগামী বিসিএস পরীক্ষার নিশ্চিত প্রশ্ন—কোন দেশে একই দিনে তিন মেয়র বরখাস্ত হয়েছিলেন? তাঁর ওই মন্তব্য দেখে মনে হলো, এটি হয়তো গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মতো একটি বিরল ঘটনা। গিনেস বুকে না হলে আমাদের প্রথম আলোতে যে রিপলি’স বিলিভ ইট অর নট ছাপা হয়, সেখানে হয়তো কোনো একদিন এটি ছাপা হবে!
লেখক: সাংবাদিক, প্রথম আলো
Discussion about this post