মামুন হোসেন আগুন
প্রতিবারের ন্যায় এ সময়টাতে মশার আধিপত্য বেশি লক্ষ্য করা যায় সবজায়গায়। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় নাজেহাল অবস্থা। খালগুলোর বর্জ্য অব্যবস্থাপনা, রাস্তা এবং ড্রেন বন্ধ হয়ে ময়লা জমে থাকা ইত্যাদি কারণে ঢাকায় কিউলেক্স মশার উপদ্রব অতিমাত্রায় বেড়েছে। দিন-রাত মশার কামড়ে অতিষ্ঠ নগরবাসী।
সন্ধ্যার আগেই বাসার দরজা-জানালা বন্ধ করা হয়। তার পরও মশার কামড় থেকে রক্ষা নেই। ছেলেমেয়েরা পড়তে বসলে মশার কামড়ে হাত-পা, মুখে রক্ত বিন্দু জমে থাকে। রান্নাঘরে কাজ করতে গেলে কানের মধ্যে ভোঁ ভোঁ শব্দ করে মশা। মশা মারতে কয়েল, স্প্রে, বৈদ্যুতিক ব্যাট সবই ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই মশার কামড় থেকে নিস্তার পাওয়া যাচ্ছে না। রাজধানীবাসীদের মতে, উত্তরা, খিলক্ষেত, নিকেতন, গুলশান, বনানী, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, মহাখালী, ফার্মগেট, শাহবাগ, ধানমন্ডি, গুলিস্তান সব এলাকার মশার পরিস্থিতি প্রায় একই। শীত এলেই কিংবা মৌসুমের এ সময়টাতে বেড়ে যায় কিউলেক্স মশার প্রকোপ। এর মধ্যে রয়েছে এডিস মশার কামড়ও। মশার কামড়ে ডেঙ্গুজ্বর, চিকুনগুনিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্রে দেখা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় দু’জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। গত বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৪০৫ জন, মারা গেছেন সাতজন। গত বছর জানুয়ারিতে আক্রান্ত হয়েছেন ১৯৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪৫ জন, মার্চে ২৭ জন, এপ্রিলে ২৫ জন, মে মাসে ১০ জন, জুনে ২০ জন, জুলাইতে ২৩ জন, আগস্টে ৬৮ জন, সেপ্টেম্বরে ৪৭ জন, অক্টোবরে ১৬৪ জন, নবেম্বরে ৫৪৬ জন এবং ডিসেম্বরে আক্রান্ত হয়েছেন ২৩১ জন।
এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর আক্রমণে দেশে সর্বোচ্চ মৃত্যু ছিল ২০১৯ সালে। সেবছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১৭৯ জনের মৃত্যু হয়। পাশাপাশি চরম দুর্ভোগ আর ভোগান্তি পোহাতে হয় নগরবাসীকে। এ ঘটনায় চরম সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে। ফলে সংস্থাগুলো ডেঙ্গুর ভয়াবহ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে পরের বছরটিতে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকাও পালন করে। কিন্তু চলতি বছর ফের মশার লাগামহীন উপদ্রব বেড়েছে। তবে এবার এডিসের প্রবণতা না থাকলেও বেড়েছে কিউলেক্সসহ অন্যান্য মশা। আর এসব মশার আক্রমণে ডেঙ্গু রোগের আশঙ্কা না থাকলেও ঝুঁকি বাড়ছে ফাইলেরিয়াসিস, চিকনগুনিয়াসহ অন্যান্য রোগের।
কিউলেক্স মশা নির্মূলের মূল দায়িত্ব ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের। কেননা, এ মশার প্রজনন স্থান খাল ও নর্দমা পরিষ্কার করা বা সেখানে মেডিসিন প্রয়োগ করা নাগরিকদের পক্ষে সম্ভব নয়। এ কারণে কিউলেক্স মশার প্রজনন বেড়ে যাওয়া দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার ব্যর্থতা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও যে কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে সেটি মশার জন্য সহনশীল বলেই দাবি করছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এর মেয়র। পাশাপাশি আশ্বস্তও করেছেন খুব শিগগিরই সেটি পরিবর্তন করে উপর্যুপরি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন চলতি বছরে করোনাভাইরাস মোকাবিলা এবং ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নগরবাসীর পাশে যেভাবে ছিলেন, কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। ওয়ার্ডভিত্তিক মশক নিধন শ্রমিকদের দিয়ে যেভাবে ডেঙ্গু ভাইরাস বাহিত এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ হয়েছে, এখন তেমন কোনো তৎপরতা নেই।
কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার, সেসব ক্ষেত্রে তারা দুই সিটি করপোরেশনের দুর্বলতা দেখছেন। কেননা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা এবং ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পাদন করা গেলে এই মশার উপদ্রব এত বৃদ্ধি পেত না। সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঢাকা শহরের সর্বত্রই এখন কিউলেক্স মশার মাত্রাতিরিক্ত উপদ্রব। যার ফলে রাজধানীবাসীর জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছে। মশার কামড়ে শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে পারছে না। মশার কামড়ে জ্বর থেকে শুরু করে অন্যান্য রোগের পরিমাণ বাড়ছে। যা শিশু এবং বয়স্কদের জন্য ভয়াবহ। এছাড়াও মশার প্রজনন যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, মার্চের শেষে কিংবা এপ্রিল-মে মাসে এর প্রজনন ৩-৪ গুণ বেড়ে যাবে। যা রাজধানীবাসীর জন্য ভয়াবহ ও হুমকিস্বরূপ।
তাই অতিদ্রুত মশা নিধনে সিটি কর্পোরেশন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা গ্রহণ করা অতীব জরুরি। পাশাপাশি সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে সর্বসাধারণকেও।
Discussion about this post