অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্মম নির্যাতনে নিহত রায়হানের খুনী এসআই আকবরকে ১৪ দিনেও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। এমনকি আকবর কি দেশে আছে নাকি সীমান্তের ওপারে চলে গেছে সেটাও বলছে না পুলিশ।
এছাড়া, পুলিশ এসআই আকবরের অপরাধ কর্মকাণ্ডে সার্বক্ষণিক যে সহযোগিতা করেছে সেই কথিত সাংবাদিক নোমানও লাপাত্তা। তাকেও খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ। রায়হানকে হত্যার পর বন্দরবাজার পুলিশ ফাড়ির সিসিটিভির ফুটেজ সরিয়ে নিয়েছিল সাংবাদিক নোমান।
এসআই আকবর ও সাংবাদিক নোমানকে খুঁজে না পাওয়ার ঘটনায় সিলেটের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। তারা বলছেন-সিলেট পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আকবরের বিষয়ে সবই জানেন। আকবর যদি সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে সেটা পুলিশের সহযোগিতায়ই সম্ভব হয়েছে। আর যদি দেশেও থেকে থাকে তাহলে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আশ্রয়েই আছে। যারা দীর্ঘদিন ধরে আকবর থেকে সুবিধা নিয়েছিল।
স্থানীয়রা বলছেন-রায়হান হত্যার পরই এসআই আকবরকে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়। ওইদিন সন্ধ্যায় আকবর নিজের মোটরসাইকেল নিয়ে পুলিশ লাইনে এসেছিল। পুলিশলাইনের ক্যান্টিনে সন্ধ্যার দিকে নাস্তাও করেন। এর এক পর্যায়ে তার সঙ্গে এসে যোগ দেয় সাংবাদিক নোমান। পুলিশলাইন ক্যান্টিনে থাকা অবস্থায় এসআই আকবর সিনিয়র এক কর্মকর্তাকে ফোন দেন। ওই কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এবং তার কাছ থেকে বিদায় নিয়েই লাপাত্তা হয়ে যান।
তাদের দাবি-পুলিশের সহযোগিতায়ই এসআই আকবর পুলিশলাইন থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। কারণ, পুলিশ সহযোগিতা না করলে নজরদারীর ভেতর থেকে একজন পুলিশ সদস্য কোনোভাবেই লাপাত্তা হতে পারে না।
আরেকটি সূত্রে জানা গেছে, কোম্পানীগঞ্জের সীমান্তবর্তী বরমসিদ্ধিপুর গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা জানিয়েছেন- ঘটনার দিন গত ১১ অক্টোবর রাতে তারা সাংবাদিক নোমানের সঙ্গে আকবরকে সেখানে দেখেছেন। তারা মোটরসাইকেলে হেলমেট পরে বরমসিদ্ধিপুর গ্রামের হেলালের বাড়িতে যান। সেখানে কয়েক ঘণ্টা অবস্থান করেন। এরপর নোমানকে সঙ্গে নিয়ে আকবর ভারত সীমান্তে ঢুকে পড়েন।
এদিকে আদালতে ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দি দিয়েছেন ফাঁড়িতে কর্মরত পুলিশ কনস্টেবল সাইদুর রহমান ও দেলোয়ার হোসেন। বন্দরবাজার ফাঁড়িতে পুলিশি নির্যাতনে রায়হানের মৃত্যুর ঘটনায় করা মামলায় একই আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন কনস্টেবল শামীম মিয়া।
জানা যায়, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ওই মামলার তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর ঘটনার সময় বন্দর ফাঁড়িতে দায়িত্বে থাকা তিন কনস্টেবল দেলোয়ার, শামীম ও সাইদুরকে ১৯ অক্টোবর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক জিহাদুর রহমানের খাস কামরায় নেয়া হয়। সেখানে তাদের জবানবন্দি গ্রহণ করেন বিচারক।
তারা বলেন, আকবর আমাদের হুমকি দিয়ে বলে ছিল, ‘সিনিয়র স্যাররা এলে বলবি, ফাঁড়িতে কোনো লোক এনে নির্যাতন করা হয় নাই। সে (রায়হান) কাস্টঘর থেকে গণপিটুনি খেয়ে ধরা পড়েছে। তাকে সরাসরি ওসমানী হাসপাতালে নেয়া হয়েছে, যা বলছি তাই বলবি। সত্য কথা বললে বুকে গুলি করব, পিঠ দিয়ে বের হবে।’
শামীম : কনস্টেবল শামীম মিয়া জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, ১০ অক্টোবর রাত ২টার দিকে বিভাগীয় পদোন্নতি পরীক্ষার প্রস্তুতিমূলক পড়াশোনা শেষ করে ফাঁড়ির মুন্সির কক্ষে তিনি ঘুমিয়ে যান। রাত ৩টার পর কক্ষের ভেতরেই কান্নার আওয়াজ শুনে তার ঘুম ভেঙে যায়। দেখতে পান রায়হানের দুই হাত পেছনের দিকে হাতকড়া লাগানো। মেঝেতে বসে চিৎকার করছেন তিনি।
কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাস মোটা লাঠি দিয়ে তাকে এলোপাতাড়ি মারধর করছেন। একপর্যায়ে তিনি ডান দিকে কাত হয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়লে কনস্টেবল টিটু তার পায়ের তলায় আঘাত করে। তখন কনস্টেবল হারুনুর রশিদ রুমে প্রবেশ করেন। তিনিও রায়হানকে মারধর শুরু করেন। এ সময় এএসআই আশেক এলাহী ও কুতুব উদ্দিন রুমে উপস্থিত ছিলেন। আর রুমের দরজায় দাঁড়ানো ছিলেন কনস্টেবল তৌহিদ ও সজিব।
এর কিছুক্ষণ পর রুমে প্রবেশ করেন ফাঁড়ি ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন। তিনি টিটুর হাতের লাঠি নিয়ে রায়হানকে তার নাম-ঠিকানা জিজ্ঞাসা করেই বেধড়ক পেটাতে শুরু করেন। তার মারমুখী আচরণ দেখে এএসআই কুতুব আকবরকে বলেন, স্যার আর মাইরেন না। তখন আকবর রুমের একটি বিছানায় লাঠি হাতে নিয়ে বসে যান।
সকাল সাড়ে ৭টায় সিয়েরা-৪ ডিউটিতে যাওয়ার জন্য ঘুম থেকে উঠে দেখি রায়হানকে যেখানে মারধর করা হয়েছে সেই স্থানটি ভেজা। সকাল ৯টায় আমরা ওসমানী মেডিকেলের ক্যাজুয়ালটি বিভাগের স্টোরে গিয়ে দেখি একটি লাশ রাখা আছে। পাশে দাঁড়িয়ে আছে কনস্টেবল তৌহিদ। তখন লাশটি দেখে আমি চিনতে পারি।
সাইদুর : সাইদুর আদালতকে জানান, বন্দরবাজার ফাঁড়ির মুন্সি কনস্টেবল আমিনুলের রুমে কনস্টেবল হারুন রায়হানের পা উঁচু করে ধরে রাখেন আর এসআই আকবর ও কনস্টেবল টিটু তার পায়ের পাতা এবং পায়ে আঘাত করেন। এ সময় এএসআই আশেক এলাহী আকবরকে বলেন, রায়হান পুলিশের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে তার পায়ে মারেন। পায়ে মারলে সমস্যা নেই। তখন আকবর আমাকে ধমক দিয়ে সেন্ট্রি পোস্টে পাঠিয়ে দেন।
এরপর বেশ কয়েকবার রায়হানের চিৎকার শুনতে পাই। ভোর ৪টায় কনস্টেবল দেলোয়ারকে আমি ডিউটি বুঝিয়ে দিয়ে চলে যাই। সাইদুর আদালতকে বলেন, পরদিন দুপুর সাড়ে ১২টায় বন্দরবাজার ফাঁড়ির মুন্সি কনস্টেবল আমিনুল ডিসি স্যারের (এসএমপির উপকমিশনার উত্তর আজবাহার আলী শেখ) কথা বলে ফাঁড়িতে ডাকেন।
আসার পর আকবর স্যার বলেন, ‘সিনিয়র স্যাররা এলে বলবি, ফাঁড়িতে কোনো লোক এনে নির্যাতন করা হয় নাই। সে (রায়হান) কাস্টঘর থেকে গণপিটুনি খেয়ে ধরা পড়েছে। তাকে সরাসরি ওসমানী হাসপাতালে নেয়া হয়েছে।’ আমি যা বলছি তাই বলবি। আমার বুকে হাত দিয়ে আকবর স্যার হুমকি দিয়ে আরও বলেন, ‘সত্য কথা বললে বুকে গুলি করব, পিঠ দিয়ে বের হবে।’
দেলোয়ার : সাইদুরের মতো একইভাবে এসআই আকবর কনস্টেবল দেলোয়ার হোসেনকেও হুমকি দিয়েছেন বলে তিনি আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে জানিয়েছেন। দেলোয়ার আদালতে বলেন, কনস্টেবল তৌহিদ ফাঁড়ির সেন্ট্রি পোস্টে তার সঙ্গে গল্প করছিল এ সময় আকবর স্যার তৌহিদকে ডেকে নেন। এরপর তৌহিদ এসে জানায়, আকবর স্যার তার মোবাইল নিয়ে রায়হানকে দিয়ে তার বাসায় কল দিয়ে ১০ হাজার টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে আসতে বলেছেন। এরপর আকবর স্যার এএসআই আশেক এলাহীকে বলেন, আমি ঘুমিয়ে গেলাম।
কিছুক্ষণ পর রায়হানকে হাসপাতালে নিয়ে যেও। ফজরের আজানের পরপর রায়হানের চাচা এলে তাকে নিয়ে নামাজে যান এএসআই আশেক এলাহী। নামাজ থেকে এসে আশেক এলাহী রায়হানের চাচাকে বলেন, স্যার ঘুমিয়ে গেছেন আপনি সকাল ৯টার পর আসেন। সকাল ৬টা ২০ মিনিটের দিকে এএসআই আশেক এলাহী ও কনস্টেবল হারুন রায়হানকে ধরে বের করে নিয়ে আসেন এবং সিএনজি আটোরিকশায় তোলেন। তারা আমাকে জানান তাকে ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আধাঘণ্টা পর আকবর স্যার ঘুম থেকে উঠে তাড়াহুড়া করে ফাঁড়ি থেকে বেরিয়ে যান। সকাল ৮টায় আমি কনস্টেবল ইলিয়াসকে ডিউটি বুঝিয়ে দিয়ে চলে যাই।