আবু সাদিক
হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত তোফায়েল আহমেদ জোসেফ রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় মুক্তি পাওয়ার পর পুরনো বিতর্ক নতুন করে সামনে এসেছে। কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে গোপনে দেশ ছেড়েছেন জোসেফ। গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মারফত মানুষ জেনেছেন নব্বইয়ের দশকের এই শীর্ষ সন্ত্রাসী আর কারাগারে নেই, দেশেও নেই।
দণ্ডপ্রাপ্ত যে কাউকে ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতা রয়েছে রাষ্ট্রপতির। বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতির পদ অনেকটা ‘আলঙ্কারিক’ হলেও সাংবিধানিকভাবে তিনি এই ক্ষমতার অধিকারী। সংবিধানের ৪৯ নম্বর অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত যে−কোন দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করিবার এবং যে−কোন দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করিবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে।’
শীর্ষ সন্ত্রাসী জোসেফকেও রাষ্ট্রপতি এই ক্ষমতাবলেই অপরাধ মার্জনা করেছেন।
এছাড়াও রাষ্ট্রপতির দায়মুক্তি রয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আইন যে সংবিধান সেখানেই বলা হয়েছে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালন করিতে গিয়ে কোনো কিছু করে থাকলে বা না করে থাকলে তাকে জবাবদিহি করতে হবে না। এ নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। এর পরও কুখ্যাত অপরাধীরা যখন ক্ষমা পেয়েছেন তা নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। বঙ্গভবন থেকে এরকম ক্ষমতার ব্যবহার বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকেনি।
২০১৩ সালের ২০ এপ্রিল আব্দুল হামিদ বাংলাদেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। সে সময় রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের অসুস্থতার কারণে তার মৃত্যুর ছয় দিন পূর্বেই ১৪ মার্চ থেকে ২০১৩ তারিখে তিনি বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে আসীন ছিলেন। আব্দুল হামিদ তার প্রথম মেয়াদে বঙ্গভবনে থাকাকালে কুখ্যাত সব রাজাকারদের ফাঁসির রায় হয়েছে। তাদের অনেকেই প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি তাদের সে সুযোগ দেননি। এর জন্য তিনি প্রশংসিত হয়েছেন। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করার পরই একজন হত্যাকারীকে ‘দয়া’ দেখালেন তিনি।
২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন জিল্লুর রহমান। সে বছরের নভেম্বর মাসে তিনি জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর ছেলে শাহাদাব আকবরকে ক্ষমা করে কারামুক্তির ব্যবস্থা করে দেন। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতি দমন কমিশন ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চারটি মামলায় পলাতক শাহাদাবকে ১৮ বছরের কারাদণ্ড ও ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছিলেন আদালত। তার দণ্ড মওকুফ করে দেওয়ার ঘটনায় ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। বিতর্কিত হলেও পরবর্তীতে এই ক্ষমতা ব্যবহারে রাষ্ট্রপতি বিশেষ যত্নশীল হয়েছিলেন এমনটা বলা যায় না।
বছর যেতে না যেতেই ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে মৃত্যুদণ্ডের সাজা ঘোষিত ২০ জনকে ঢালাওভাবে ক্ষমা করে দেন রাষ্ট্রপতি। যুবদল নেতা সাব্বির আহমেদ গামা হত্যা মামলায় ওই সাজাপ্রাপ্তদের বেশিরভাগই ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী। হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তদের এভাবে মার্জনা করার ঘটনা সেবারও তীব্র বিতর্ক তৈরি করেছিল।
কিন্তু মানুষ হত্যাকারীদের ক্ষমা করার এটাই শেষ নজীর ছিল না জিল্লুর রহমানের জন্য। বছর ঘোরার আগেই ২০১১ সালের জুলাই মাসে তিনি লক্ষ্মীপুরের আওয়ামী লীগ নেতার গুণধর পুত্র এএইচএম বিপ্লবের সাজা হ্রাস করেন। আলোচিত নুরুল ইসলাম হত্যা সহ অপর একটি হত্যা মামলায় ফাঁসির জন্য কারাগারে দিন গুনছিল বিপ্লব। ফাঁসি এড়াতে আইনি কাঠামোর ভেতরে থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিল বিপ্লবের পরিবার। কিন্তু আপিল বিভাগ পর্যন্ত রায়ে বলেছিলেন, সমস্ত তথ্য প্রমাণ করে বিপ্লব হত্যাকারী। তাই তার সাজা হ্রাস করার কোনো প্রশ্ন নেই।
আদালতে ব্যর্থ হলে কি হবে, অপরাধী ছেলেকে রক্ষা করতে বিপ্লবের বাবা তাহের তার রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করেন। ফলাফলও পেয়ে যান হাতেনাতে। মাত্র সাত মাসের ব্যবধানে দুটি হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপতি দুবার তার সাজা হ্রাস করে দেন। দুই ক্ষেত্রেই তার মৃত্যুদণ্ড থেকে কমিয়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড করা হয়।
অপরাধীদের সাজা মওকুফে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের পূর্বসূরি ইয়াজুদ্দিন আহমেদেরও জুড়ি মেলা ভার। ২০০৫ সালে তিনি তৎকালীন বিএনপির সুইডেন শাখার সভাপতি মহিউদ্দিন জিন্টুকে ক্ষমা করেন। দুই দশক আগে একটি জোড়া খুনের মামলায় তার ফাঁসির রায় হয়েছিল। জিন্টু ক্ষমা পাবার আগে ওই মামলারই অপর এক আসামির ফাঁসি কার্যকর হয়েছিল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তখন সমালোচনার মুখে পড়েছিল সরকার।
জিন্টুর ক্ষমা নিয়ে সে সময়কার প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সংসদে ও বাইরে এ নিয়ে সমালোচনায় সরব হয়েছিল। কিন্তু পরই ক্ষমতায় এসে বিএনপির দেখানো পথেই হাঁটতে শুরু করে আওয়ামী লীগ। সরকার গঠনের প্রথম দুই বছরের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্তরা রাষ্ট্রপতির ক্ষমা নিয়ে একের পর এক কারাগার থেকে বেরিয়ে গেলেও টু শব্দটি করেননি আওয়ামী লীগের নেতারা।
আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া মাত্র দুটি কাজ করতে পারেন। এর একটি হলো প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা ও দ্বিতীয়টি হলো প্রধান বিচারপতি নিয়োগ। ফলে অপরাধীদের সাজা মওকুফের ক্ষেত্রেও তিন সরকারেই পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করেছেন বলে ধরে নেওয়া যায়। যদিও ৪৯ নম্বর অনুচ্ছেদে এ ধরনের কোনো পরামর্শের কথা উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু রাষ্ট্রপতি চাইলেই সাজা মওকুফের সুপারিশ ফেরত পাঠাতে পারতেন। তিনি একটি নৈতিক অবস্থান নিতে পারতেন।
১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ নির্দলীয় ব্যক্তি হিসেবে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদকে রাষ্ট্রপতি করেছিল। তিনি ‘জননিরাপত্তা আইন’ নামের একটি বিতর্কিত আইন প্রণয়নে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। সেকারণে তৎকালীন সরকারের সঙ্গে তার তিক্ততা তৈরি হলেও কালাকানুনে সই না করে মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। কুখ্যাত একজন সন্ত্রাসীকে ক্ষমা না করে বর্তমান রাষ্ট্রপতির সামনে এই সুযোগটি আসলেও এবার তিনি রাজনৈতিক বিতর্কের ওপরে উঠতে পারলেন না।
সূত্র: ডেইলিস্টার