খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ভোট জালিয়াতি, কারচুপি ও পুলিশের সহযোগিতায় কেন্দ্র দখলের মহোৎসবে শেষ হয়েছে ভোট গ্রহন। ভোট গ্রহণ শুরু করার পর থেকে একে একে কেন্দ্রগুলো দখলে নিতে থাকে সরকার সমর্থকরা। এসময় বিএনপির পোলিং এজেন্টদের মারধর করে কেন্দ্র থেকে বের দেয়া হয়। লাঞ্ছিত করা হয় নারী এজেন্টদেরও।
সকাল সাড়ে ১১টার পর নগরীর রূপসা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে পুলিশের সহযোগিতায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ওই কেন্দ্রে প্রবেশ করে বিএনপির মেয়র প্রার্থীর এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়। পাঁচটি বুথে ঢুকে ব্যালট নিয়ে সীল মারা শুরু করে।
পরে খবর পেয়ে সাংবাদিকরা সেখানে যান। বিএনপির মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জুও আসেন এই কেন্দ্রে। সাংবাদিকরা আসার পর পুলিশের উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা এসে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেন। ওই সময় ভোট গ্রহণ সাময়িক বন্ধ রাখা হয়। এরপর সাংবাদিকরা চলে গেলে পুনরায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কেন্দ্রে প্রবেশ করে ব্যালটে সীল মারে।
এদিকে ৩১ নং ওয়ার্ডের লবণচরা প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে পোলিং এজেন্টদের পাশাপাশি প্রিসাইডিং অফিসারদেরও বের করে দিয়েছে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেকের সমর্থকরা। তারা বুথের ভেতরে ঢুকে যখন সীল মারছিলো তখন প্রিসাইডিং অফিসাররা বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন। তারা সাংবাদিকদের বলেন, তাদের বুথ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে ২০ নং ওয়ার্ডে এইচ আর এইচ প্রিন্স আগাখান উচ্চ বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে পুলিশের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ সমর্থকরা ভোটারদেরকে বের করে দিয়ে নৌকা মার্কায় সীল মারে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ৪ নং ওয়ার্ডে দেয়ানা উত্তর পাড়া কেন্দ্রে বিএনপি নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ওপর হামলা এবং বিএনপি কর্মী মিশুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
১৯ নং ওয়ার্ড ইসলামাবাদ ভোটকেন্দ্রে পোলিং এজেন্টকে মারধর করে প্রশাসনের সামনেই বের করে দেয় সরকার সমর্থকরা। পাইওনিয়ার স্কুল ভোটকেন্দ্র থেকেও প্রশাসনের সামনেই বের করে দেয়া হয়েছে বিএনপির পোলিং এজেন্টদেরকে। গল্ডামারি লায়ন্স স্কুল ও নিরালয় স্কুল কেন্দ্র থেকে ধানের শীষের এজেন্টকে প্রশাসনের সামনে মারধর করে বের করে দেয়া হয়েছে।
আ.লীগ প্রার্থী খালেক বের হলেই জাল ভোটের মহড়া
আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক যে কেন্দ্রে যাচ্ছেন সেখানেই জাল ভোটের মহোৎসব চলছে। সকাল থেকেই বিভিন্ন কেন্দ্রে ঘুরে ঘুরে ভোট গ্রহণ দেখছেন তালুকদার আব্দুল খালেক। কেন্দ্রগুলোতে যাওয়ার সময় খালেকের সঙ্গে ৩০/৪০ জনের একটি বহর থাকে। সঙ্গে মিডিয়াও থাকে। কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে তিনি বের আসলে মিড়িয়াও বের হয়ে আসে। এ সুযোগে পেছনে তার বহর শুরু করে জাল ভোটের মহোৎসব।
তালুকদার আব্দুল খালেক দুপুর ২টার দিকে ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের শেখপাড়া বিদ্যুৎ স্কুল কেন্দ্রে যান। সেখান থেকে তিনি বের হয়ে আসলে তার সঙ্গে থাকা বহর জাল ভোট দেয়া শুরু করে। একইভাবে হাতেম আলী স্কুল, ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে সিদ্দিকীয়া মাদ্রাসা, ৩১ নম্বর আব্দুল মালেক ইসলামীয়া কলেজ কেন্দ্রে একই ঘটনা ঘটে।
জোর করে ব্যালটে সিল, দুই কেন্দ্রে ভোট স্থগিত
জোরপূর্বক ব্যালটে সিল মারার কারণে দুটি ভোটকেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। এগুলো হলো ইকবালনগর সরকারি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্র (পুরুষ) ও ৩১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয় কেন্দ্র। দুপুর ১২টার দিকে ইকবালনগর সরকারি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রের (পুরুষ) ও বেলা দুইটার দিকে অপর কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করা হয়।
ইকবালনগর সরকারি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট শুরুর পর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ওই কেন্দ্রে ২০ থেকে ২৫ জন যুবক জোর করে ঢুকে পড়েন। তাঁরা কেন্দ্রের ৭ নম্বর বুথে ঢুকে ব্যালট পেপার নিয়ে সিল মেরে ভোট বাক্স খরতে থাকে। কেন্দ্রের ৭ নম্বর বুধের ধানের শীষের পোলিং এজেন্ট কাকলী খান ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর প্রার্থী জাকিয়া সুলতানার এজেন্ট সাজেদা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ওই যুবকদের সবার শার্টে নৌকা প্রতীকের ব্যাজ লাগানো ছিল। তাঁরা এসেই অন্য প্রার্থীদের এজেন্টদের বের হয়ে যেতে বলেন। এরপর ব্যালট পেপার নিয়ে নৌকা প্রতীকে এবং আওয়ামী লীগ–সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর ঠেলাগাড়ি ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদের গ্লাস প্রতীকে ভোট দিয়ে তা বাক্সে ভরেন।
প্রিসাইডিং কর্মকর্তা খলিল বলেন, তিনি পুলিশের সহযোগিতা চেয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করেছে কি না, সেটা তাঁর জানা নেই। প্রিসাইডিং কর্মকর্তার পাশেই ছিলেন ওই কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা এক পুলিশ কর্মকর্তা। তাঁর পোশাকে নামের কোনো ব্যাজ ছিল না। ব্যাজ কোথাও পড়ে গেছে জানিয়ে নিজের নাম নয়ন মিয়া বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, কেন্দ্র যে দখল হয়েছে, এমন তথ্য তাঁদের কাছে ছিল না।
এরপর দুপুর ১২টার দিকে কেন্দ্রে আসেন রিটার্নিং কর্মকর্তা ইউনুচ আলী। প্রথম আলোর প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই কেন্দ্র স্থগিত করা হয়েছে। সব ব্যালট পেপার জব্দ করা হয়েছে। তিনি বলেন, কাউকে মারধর করা হলে সেটা পুলিশের ব্যাপার। আর এজেন্ট ঢুকতে না দেওয়ার কোনো অভিযোগ আসলে তিনি ব্যবস্থা নেবেন বলে জানিয়েছেন।
এদিকে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয় একদল যুবক ঢুকে ব্যালটে সিল মারতে থাকেন। তাঁরা আওয়ামী লীগ–সমর্থিত প্রার্থী খুলনা মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান রাসেলের নির্বাচনী প্রতীকে সিল মারতে থাকেন। এই কেন্দ্রের মোট ভোটার ১ হাজার ৬৯১ জন। প্রায় আধা ঘণ্টা তাঁরা ব্যালটে সিল মারেন। এরপর পুলিশ এলে তাঁরা চলে যান।
ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আলীম হোসেন বলেন, দুর্বৃত্তরা ব্যালটে সিল মারলেও তা বাক্সে ভরতে পারেনি। পরে দুটার দিকে কেন্দ্র স্থগিত করা হয়।
‘আপনার ভোট দেওয়া হয়ে গেছে…বাড়ি যান’
কাউন্সিলর প্রার্থী হাসান মেহেদি রেজভী ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থী মাজেদা খাতুন অভিযোগ করেন, নগরীর ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের কেন্দ্র ডি আলী ইসলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়- ২৩৭ নম্বর কেন্দ্রে প্রতিপক্ষরা তাদের কর্মীদের ভোট দিতে দিচ্ছে না। আগে থেকেই ব্যালটে সিল মেরে তা বক্সে ফেলছে। অনেক ভোটার এসেই বিমুখ হয়ে ফিরে এসেছেন।’
অভিযোগ করার সময় নৌকা সমর্থিত একদল যুবক তাদের ঘিরে হইচই শুরু করে। তারা চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘এরা মিথ্যুক। সবাই তাদের ভোট দিয়েছেন।’
এসময় ভোটার আব্দুস সাত্তার (৫০) সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, ‘আমি ভোট দিতে বুথে গেলে তারা পাশের রুমে যেতে বলে। সেখানে গেলে জানানো হয়, আপনার ভোট দেওয়া হয়ে গেছে, ব্যালটও শেষ। বাড়ি চলে যান!
এই কেন্দ্রে দায়িত্বে রয়েছেন ইন্সপেক্টর তোফায়েল। তিনি এ প্রতিনিধিকে বলেন, ‘বিএনপি ও সরকার বিরোধীরা এমন অভিযোগ করেই থাকে। ভোট সুষ্ঠুভাবেই হচ্ছে।’
‘নাম বলে দিলে এখানে অনেক সমস্যা হবে’
নগরীর ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের হাজী আবদুল মালেক ইসলামিয়া কলেজে জাল ভোট দেয়ার সময় দুইজনকে আটক করেছে পুলিশ। কিন্তু আটককৃতদের নাম ও পরিচয় প্রকাশ করছে না পুলিশ। সেখানে দায়িত্বরত পুলিশের এসআই বোরহান মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, অসহায়। আপনাদেরই ভাই ব্রাদার। নাম বলে দিলে এখানে অনেক সমস্যা হবে। এ সময় নির্বাচনী দায়িত্বরত একজন ম্যাজিস্ট্রেট সে কেন্দ্রে গেলেও গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেননি তিনি।
বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে ওই কেন্দ্রে দায়িত্বরত সমন্বয়ক আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, আটককৃতদের ছেড়ে দেয়া হবে। এ জন্যই তাদের তাদের নাম ও পরিচয় প্রকাশ করছে না পুলিশ। এদিকে জাল ভোট দেয়ার সময় সোনাডাঙ্গা থানা ছাত্রলীগের সেক্রেটারিকে আটক করেছিল পুলিশ। কিন্তু গণমাধ্যম সেখানে পৌঁছার আগেই তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।
অন্যদিকে আবদুল মালেক ইসলামিয়া কলেজ কেন্দ্রের কয়েকটি গেট বন্ধ করে রাখা হয়েছে। যারা ভোট দিতে আসছেন তারাও ফেরত যাচ্ছেন ব্যালটের অভাবে। প্রতিটি কেন্দ্রে ভোটারের সংখ্যা অনুযায়ী ব্যালট সরবরাহ করা হলেও এ কেন্দ্রে দুপুর একটার সময়ই শেষ হয়ে গেছে ব্যালট। একই রকম পরিস্থিতি নগরীর শেরে বাংলা রোড সোনা স্কুল কেন্দ্রে। সেখানেও দুপুর দেড়টার মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে সব ব্যালট। সকালে এ কেন্দ্রের বাইরে বিএনপি প্রার্থীর এজেন্টদের চেয়ার টেবিল ভাঙচুর করা হয়েছিল।
সূত্র: মানবজমিন, প্রথম আলো ও বাংলা ট্রিবিউন