মুসাফির রাফি
সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়া ওআইসির সদস্যরাষ্ট্রগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন চলাকালে বাংলাদেশ আবারও ওআইসির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রভাবশালী পদ, অর্থাৎ ওআইসির এ্যাসিস্টেন্ট জেনারেল পদে নির্বাচনে অংশ নেয়। অথচ স্বাগতিক দেশ হওয়া স্বত্বেও বাংলাদেশ এই নির্বাচনে লজ্জ্বাজনক পরাজয়ের সম্মুখীন হয়। ওআইসির মহাসচিব বা সহকারী মহাসচিব পদে বাংলাদেশের নির্বাচন নতুন কিছু নয়। তবে এবারের মত বিব্রতকর পরাজয় বাংলাদেশের আগে কখনো হয়নি। আর বাংলাদেশেই যখন সম্মেলনটি হচ্ছে তখন অতিথিদের কাছ থেকে এই নুন্যতম সমর্থন নিতে না পারাটাকে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কুটনৈতিক ব্যর্থতা হিসেবেই দেখছেন পর্যবেক্ষকরা।
অনেকেই এই ব্যর্থতার জন্য বাংলাদেশের ভুল প্রার্থী নির্বাচনকে দায়ী করলেও প্রকৃত বাস্তবতা এটা নয়। সম্প্রতি বিভিন্ন দেশ থেকে আগত অতিথিদের সাথে কথাবার্তা বলে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশের এই শোচনীয় পরাজয়ের নেপথ্যের কিছু কারন উঠে এসেছে। তাতে বেশ স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে আভ্যন্তরীন ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের কিছু কর্মকান্ডকে বিদেশী মেহমানরা ভালভাবে নেয়নি ফলে তারা বাংলাদেশের ব্যপারে আর আস্থা রাখতে পারেনি।
এই পরাজয়ের পেছনে যেই কারনগুলো বেশী আলোচিত হচ্ছে সেগুলো হলো:
প্রথমত: স্বাগতিক হিসেবে বাংলাদেশের এবারের আয়োজনে অতিথি হয়ে আসা বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা সন্তুষ্ট হতে পারেননি।
দ্বিতীয়ত: বাংলাদেশ এখনো ওআইসির সদস্যরাষ্ট্রগুলোর কাছে বড় কোন প্লেয়ার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেনা। ওআইসিতে আরব দেশগুলো বিশেষ করে সৌদি আরবের প্রভাবই এখনো সবচেয়ে বেশী। আর সৌদি আরব বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে ওআইসির এত গুরুত্বপূর্ন পদে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে কোন আগ্রহ দেখায়নি।
তৃতীয়ত: মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের যতটুকু ইমেজ ওআইসিতে ছিল, বিগত বছরগুলোতে সরকারের কর্মকান্ডে তা একেবারেই ধুলিসাৎ হয়ে গেছে। ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনকে ওআইসির অনেক সদস্যরাষ্ট্রই এখনো প্রহসন মনে করে। সেই নির্বাচনের বদৌলতে আসা এই সরকারকে স্বীকৃতি দিতেও অনেকের আপত্তি রয়েছে।
চতুর্থত: এদেশের বেশ কিছু ইসলামিক নেতৃবৃন্দকে এই সরকারের আমলে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অনেককে জেলে ঢোকানো হয়েছে। ওআইসির অনেকেই বিষয়টাকে ভালভাবে নেননি।
পঞ্চমত: এই সরকার গনজাগরন মঞ্চ নামক একটি ধর্মনিরপেক্ষ প্লাটফর্মকে গড়ে ওঠার সুযোগ করে দিয়েছে এবং এই প্লাটফর্মকে ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে কাজে লাগিয়েছে। এই প্লাটফর্মের অনেকেই সরাসরি আল্লাহ ও তার রাসুলকে (সা.) অশ্নীল কথা বলেছে, লিখেছে এবং সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। এই বিষয়টাও বিদেশী মেহমানদের কাছে অজানা নয়।
ষষ্ঠত: বাংলাদেশের সাথে সাম্প্রতিক বছরগুলো পাকিস্তানের রেষারেষিকে অনেকেই ইতিবাচকভাবে নিতে পারেনি। পাকিস্তান এখনো ওআইসিতে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে আছে। তাই খোড়া অজুহাতে বাংলাদেশ যেভাবে পাকিস্তানের সাথে কুটনৈতিক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে তা ওআইসির কাছে বাংলাদেশের ভাবমুর্তিকে অনেকটাই ক্ষুন্ন করে দিয়েছে।
এর আগে ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ আরেকবার এসিস্টেন্ট জেনারেল পদে নির্বাচন করেছিল। সেই সময় বাংলাদেশ তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব মোহাম্মাদ মোহসীনকে এই পদের জন্য ভেবেছিল। তিনি তেমন নামকরা ব্যক্তি ছিলেননা। তবে তৎকালীন সামরিক শাসক এরশাদের খুব আস্থাভাজন ছিলেন। বাংলাদেশ সামরিক শাসনের অধীনে থাকায় ওআইসি দেশগুলো অসন্তুষ্ট ছিলেন। তারা মোহসীনকে জিতে আসতে দেননি। তথাপি বাস্তবতা এটাই যে, মোহসিনও এত কম ভোট পাননি যতটা এবারের প্রার্থী পেয়েছেন। এরশাদের আমলের নির্বাচনও বিতর্কিত ছিল কিন্তু ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনটি তার চেয়েও বেশী বিতর্কিত বলেই ওআইসি বিবেচনা করে।
বাংলাদেশ ওআইসিতে এত দুর্বল অবস্থানে কখনোই ছিলনা। বাংলাদেশ ওআইসিতে প্রবেশ করে ১৯৭৪ সালে। সেবারই প্রথম মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে ওআইসির সম্মেলনে যোগ দান করেন। বঙ্গবন্ধুর লাহোর সম্মেলনে যাওয়াটা এতটাই ভিআইপি ট্রিটমেন্ট পেয়েছিল যে মিশর থেকে মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ঢাকায় এসে শেখ মুজিবকে নিয়ে লাহোরে উড়ে গিয়েছিলেন। সম্মেলনে আরো অনেক প্রসিদ্ধ ব্যক্তিই ছিলেন তবে সকলের চোখ ছিল, শেখ মুজিবের দিকে। কেননা তিনি স্বাধীন একটি দেশের নেতা হিসেবে ওআইসিতে অংশ নিয়েছিলেন। তাও আবার সেই পাকিস্তানে, যেখানে তিনি যুদ্ধের গোটা সময়টায় বন্দী ছিলেন। অথচ আজ তারই কন্যার আমলেই ওআইসিতে নাকানিচুবানি খেল বাংলাদেশ। এই লজ্জা আমরা কোথায় রাখি!!