অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
অতিসম্প্রতি ঢাকায় সম্পন্ন হলো অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশনের (ওআইসি) পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন। দুইদিন ব্যাপী এই সম্মেলনে ৫৭ সদস্য বিশিষ্ট এই সংস্থার প্রায় ৬০০ প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনের সমাপনী দিনে প্রচারিত হয় সম্মেলনটির ‘ঢাকা ঘোষণা’। গুরুত্বপূর্ণ এই ঘোষণায় জম্মু-কাশ্মীর ইস্যুকে পাশ কাটানোয় তৈরি হয়েছে বিতর্ক।
কাশ্মিরী মুসলিম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রশ্নটি বেশ দীর্ঘদিনের। এই ইস্যুতে কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামীরা দীর্ঘদিন লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে আসছেন। প্রতিনিয়তই স্বাধীনতাকামীদের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে ভূ-স্বর্গ খ্যাত কাশ্মিরীরের রাজপথ। কাশ্মীরের মুসলমানদের এই সংকট নিয়ে সম্মেলনে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হলেও ঢাকা ঘোষণাতে তা অন্তর্ভুক্ত না করায় এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে পাকিস্তান।
এনিয়ে ঢাকাস্থ পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে গতকাল বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে একটি প্রেস রিলিজ পাঠায়। তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো মিডিয়া ‘পাকিস্তান ঢাকা ঘোষণার সাথে দ্বিমত পোষণ করেছে’ শিরোনামে সংবাদ পরিবেশন করে। কিন্তু কেউই এটা উল্লেখ করেনি যে, পাকিস্তান প্রধানত কি কারণে ঢাকা ঘোষণার সাথে দ্বিমত পোষণ করেছে। মিডিয়াগুলো পাকিস্তানের আপত্তির কারণ হিসেবে শুধু এতটুকুই উল্লেখ করেছে যে, ‘আয়োজক বাংলাদেশ সম্মেলন সমাপ্ত হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে ‘ঢাকা ঘোষণা’র খসড়া প্রকাশ করে। এতে শুধু আয়োজক দেশের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে কোনো আলোচনা বা দর কষাকষি ছাড়াই এটি গৃহীত বলে ঘোষণা দেয়া হয়।’
কিন্তু পাকিস্তান হাইকমিশনের পাঠানো প্রেস রিলিজের প্রায় পুরো অংশ জুড়ে আপত্তির কারণ হিসেবে জম্মু ও কাশ্মীর ইস্যু অন্তর্ভুক্তি না করার কথা উল্লেখ থাকলেও কোনো মিডিয়াতেই এটা উল্লেখ করেনি যে, ওআইসির ‘ঢাকা ঘোষণা’তে কাশ্মীর ইস্যু অন্তর্ভুক্ত না করাই পাকিস্তানের ক্ষোভ প্রকাশের মূল কারণ ছিলো।
পাকিস্তান হাইকমিশনের ইংরেজি প্রেস রিলিজটি অ্যানালাইসিস বিডির পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো:
Jammu and Kashmir highlighted at 45th OIC CFM Dhaka
The 45th Session of the OIC Council of Foreign Ministers (CFM) was concluded in Dhaka on 6 May 2018. The Pakistani delegation was led by Foreign Secretary Tehmina Janjua.One of the main highlights of this Session was the strong support demonstrated by the OIC member states to the just cause of the Kashmiri people through adoption of resolutions and endorsement of the report of the recently held OIC Contact Group on Jammu & Kashmir.
Both the resolutions and the report of the Contact Group reaffirmed OIC’s support for the realisation of the right of Kashmiri people to self-determination in accordance with the UN Security Council Resolutions. The Contact Group report drew attention to the rise in gross and systematic human rights violations in the Indian occupied Jammu & Kashmir, terming them as crimes against humanity. The report also rejected attempts to equate the peaceful indigenous struggle for self-determination with terrorism. The Memorandum presented by the True Representatives of the Kashmiri people to the OIC Secretary General was annexed to the report. The Foreign Secretary, in her statement at the Conference, as well as during a brainstorming session on humanitarian challenges and in her meetings inter alia, focused on the issue of Jammu & Kashmir. She also thanked the OIC member states for their consistent support to the cause.
The Foreign Secretary also spoke at length about the tragic plight of the Rohingya Muslims and Palestinians and expressed Pakistan’s full solidarity with them.
Just before the conclusion of the Conference, the host country circulated text of Dhaka Declaration. It only reflected the views of the host country, and therefore, issued under its own responsibility, signifying that the text was neither discussed nor negotiated by participating States. The Declaration is without prejudice to the well established positions of OIC member states and the organization, as enshrined in the CFM and Summit documents.
On the sidelines of the Conference, the Foreign Secretary met OIC Secretary General, Foreign Ministers of Saudi Arabia, Senegal, Minister of State of Uganda, her counterparts from Morocco, Malaysia, Tunis, Indonesia and heads of delegation of several other OIC countries.
07 May 2018
এই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সম্মেলন শেষ হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে ঢাকা ঘোষণার কপি বিতরণ করেছে বাংলাদেশ। এতে কেবলমাত্র বাংলাদেশের অভিমতই প্রতিফলিত হয়েছে। সম্মেলনে অংশ নেয়া রাষ্ট্রগুলোর সাথে আলোচনা না করে বাংলাদেশ নিজ দায়িত্বে ঢাকা ঘোষণা ইস্যু করেছে। এ ঘোষণায় ওআইসির দীর্ঘ দিনের অবস্থানের প্রতিফলন ঘটেনি।
এতে বলা হয়, সম্প্রতি জম্মু ও কাশ্মিরবিষয়ক ওআইসি কন্টাক্ট গ্রুপের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে ওআইসি সদস্য রাষ্ট্রগুলো কাশ্মিরের মানুষের ন্যায্য অধিকারের প্রতি শক্তিশালী সমর্থন প্রকাশ করে কন্টাক্ট গ্রুপের প্রতিবেদন অনুমোদন এবং তা প্রস্তাব আকারে পাস করে। এতে কাশ্মিরের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারবিষয়ক জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের প্রতি ওআইসির প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা হয়। কন্টাক্ট গ্রুপের প্রতিবেদনে জম্মু-কাশ্মিরে পরিকল্পিত মানবাধিকার লঙ্ঘনকে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এতে কাশ্মিরের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করার প্রচেষ্টাকে নাকচ করা হয়েছে। ওআইসি মহাসচিবকে দেয়া কাশ্মিরের অধিবাসীদের প্রকৃত প্রতিনিধিদের একটি স্মারকলিপি প্রতিবেদনের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে। ঢাকা সম্মেলনে দেয়া বিবৃতি, মানবাধিকার চ্যালেঞ্জ নিয়ে অনুষ্ঠিত অধিবেশন এবং সাইডলাইনে অনুষ্ঠিত বৈঠকগুলোতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব জম্মু ও কাশ্মির ইস্যুর ওপর আলোকপাত করেন। এ ইস্যুতে ধারাবাহিক সমর্থন দেয়ার জন্য তিনি ওআইসি সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে ধন্যবাদ জানান।
প্রেস রিলিজে বর্ণিত কাশ্মীরের মুসলমানদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ঢাকা ঘোষণাতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এই ঘোষণাতে বড় অংশজুড়ে শুধু রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিষয়গুলোই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যা কিনা বাংলাদেশের স্বার্থের সঙ্গেও যুক্ত। এজন্যই মূলত পাকিস্তান হাইকমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ‘এতে কেবলমাত্র বাংলাদেশের অভিমতই প্রতিফলিত হয়েছে’।
পাকিস্তান হাইকমিশনের এই প্রেস রিলিজ নিয়ে বাংলাদেশের সরকারি বার্তাসংস্থা ইউএনবি সংবাদ পরিবেশন করে। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে তারা তাদের সংবাদে পাকিস্তানের আপত্তির মূল কারণ কাশ্মীর ইস্যু অন্তর্ভুক্তি না করার ব্যাপরটি উল্লেখই করেনি। পরবর্তীতে বাংলাদেশের অন্যান্য মিডিয়াও ইউএনবির মত করেই জম্মু ও কাশ্মীর ইস্যু বাদ দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করে। কিছু অতিউৎসাহী মিডিয়া পাকিস্তানের এই আপত্তিকে উদ্ভট হিসেবেও অভিহিত করে। অথচ প্রত্যেক মিডিয়ার কাছেই প্রেস রিলিজ গিয়েছে এবং তারা চাইলেই প্রেস রিলিজে উল্লিখিত পাকিস্তানের আপত্তির মূল কারণ কাশ্মীর ইস্যুর কথা সংবাদে উল্লেখ করতে পারতো। কিন্তু তারা তা করেনি।
জম্মু ও কাশ্মীর ইস্যুটি ভারতের জন্য স্বার্থবিরোধী। আর এই ইস্যুকে পাশ কাটানোর জন্য বিশ্লেষকরা বাংলাদেশের সরকার ও মিডিয়ার অতি ভারতপ্রীতিকেই দায়ী করেছেন। জম্মু ও কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনী স্বাধীনতাকামী মুসলমানদের ন্যায্য লড়াই ও সংগ্রামকে দমন করতে হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন চালালেও তারা এসব বরাবরের মত অস্বীকার করছে এবং স্বাধীনতাকামীদেরকে সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করছে। এজন্যই মূলত বাংলাদেশের মিডিয়াও ভারতের স্বার্থ বিরুদ্ধ কাশ্মীর ইস্যুকে সবসময় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
এদিকে পাকিস্তান হাইকমিশনের প্রেস রিলিজের পর নড়েচড়ে বসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মঙ্গলবার রাত পৌনে নয়টার দিকে তারাও একটি পাল্টা প্রেস রিলিজ দিয়ে পাকিস্তানের আপত্তিকে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই প্রেস রিলিজেও পাকিস্তানের আপত্তির মূল কারণ জম্মু ও কাশ্মীর ইস্যুকে সম্পূর্ণরুপে এড়িয়ে যাওয়া হয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইংরেজি প্রেস রিলিজটি অ্যানালাইসিস বিডির পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো:
Ministry of Foreign Affairs, Dhaka
To: Media in Dhaka
Press Release:
Attention of the Ministry of Foreign Affairs of Bangladesh has been drawn to a press release issued by Pakistan on the recently concluded 45th OIC Council of Foreign Ministers held in Dhaka. In view of this, the Ministry of foreign Affairs of Bangladesh is constrained to make the following statement:
An original draft of the Dhaka Declaration was received from the General Secretariat of the OIC. Subsequently, some additional paragraphs were suggested by some member states, OIC related organisations and the host country. The suggestions were included in the draft Declaration prior to its adoption by the Council. However, there was no amendment made to the original draft of para 18 concerning which Pakistan has made observations.
End of the press release
এতে বলা হয়েছে, ঢাকা ঘোষণার মূল খসড়া ওআইসি সচিবালয় তৈরি করেছে। পরে কিছু সদস্য দেশ, ওআইসি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং স্বাগতিক দেশের পরামর্শে এতে অতিরিক্ত অনুচ্ছেদ সংযোজন করা হয়েছে। এরপর তা পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে গৃহীত হয়। ঘোষণার ১৮ নম্বর অনুচ্ছেদ নিয়ে পাকিস্তান যে প্রশ্ন তুলেছে, তাতে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।
অর্থাৎ এখানে জম্মু ও কাশ্মীর ইস্যুটি সম্পূর্ণরুপে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। অথচ পাকিস্তানের আপত্তির মূল কারণ ছিলো এই ইস্যুটি অন্তর্ভুক্ত না করা। সে ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো জবাবই দেয়া হয়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এবছরের ডিসেম্বরেই বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন হতে যাচ্ছে। আর বাংলাদেশের নির্বাচনে প্রতিবেশি দেশ ভারতের প্রভাবের ব্যাপারটি একটি ওপেন সিক্রেট ব্যাপার। এজন্য ফের ক্ষমতায় আসতে বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ভারতকে খুশি করার সবরকম প্রচেষ্টাই অব্যাহত রেখেছে। এই প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতা থেকেই শেখ হাসিনা ভারতকে ওআইসির পর্যবেক্ষক দেশ করার প্রস্তাব পেশ করে। যদিও তা পাকিস্তানের আপত্তিতে বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু ভারতকে পর্যবেক্ষক বানাতে সকল প্রচেষ্টাই করেছেন শেখ হাসিনা। ওআইসির ঢাকা ঘোষণাতে ভারতের স্বার্থবিরোধী জম্মু ও কাশ্মীর ইস্যু বাদ দেয়াটাও শেখ হাসিনার সেই প্রচেষ্টারই অংশ ছিলো। অন্যদিকে দলকানা মিডিয়াও আওয়ামী লীগ সরকারের দেখানো সেই পথেই হাঁটছে।