অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে এক প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম দ্য ইকোনমিস্ট বলেছে, দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গন, ছাত্র ও জনগণের মধ্যে তীব্র মতবিরোধী তৈরি করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ১৯৭১ সালের ঘটনার প্রেক্ষিতে দেশকে বিভাজনের নীতির কারনে একটি ব্যাপক সমালোচনার উদ্ভব হয়েছে। প্রধান বিরোধী নেত্রীকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। এমন অবস্থায় বিরোধীতার একমাত্র উৎস হল সেনাবাহিনী এবং ছাত্ররা।
‘বাংলাদেশে আন্দোলনের মুখে ত্রুটিপূর্ণ কোটা পদ্ধতি বাতিল : সিভিল সার্ভিসে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগে সরকারের প্রতিশ্রুতি’ এমন শিরোনামে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় ২০ এপ্রিল।
দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনটি ভাষান্তর করেছে অ্যানালাইসিস বিডি। পাঠকদের জন্য তা হুবহু তুলে ধরা হলো:
ভারতে বিশেষ বর্ণ ও সম্প্রদায়ের জনগণের জন্য সরকারী চাকরিতে একটি অংশ সংরক্ষিত থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে কোটা বন্টন ব্যবস্থা ইতিহাসের একটি অংশ। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ১৯৭১ সালের পাকিস্তান থেকে বিভাজনের যুদ্ধে যারা যুদ্ধ করেছে তাদের বংশধরদের জন্য সরকারী চাকুরীতে ৩০% কোটা বরাদ্দ দেয় (বাকি ২৬% অন্যান্য গোষ্ঠীর জন্য) ।
কোটা সংস্কারের দাবীতে ফেব্রুয়ারী থেকে আন্দোলনরত ছাত্ররা ৯০% সরকারী চাকরীতে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের দাবী করে। ক্রমাগত বিক্ষোভ ও অবস্থান ধর্মঘটের মুখে, ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃশ্যত তাদের দাবী মেনে নেন এবং কোটা বাতিলের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু পরবর্তিতে আর কোন দাপ্তরিক ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষণ দেখা যায়নি। অন্যদিকে কোটার সমর্থকরা পাল্টা বিক্ষোভের পরিকল্পনা করছে।
বর্তমানে স্থগিত কোটা বিরোধী আন্দোলন প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ৮ই এপ্রিলে শুরু হয় । খুব দ্রুত এটি ছড়িয়ে পড়ে এবং সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। রাজধানী ঢাকায় পুলিশ বিক্ষোভকারী ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার গ্যাস ছোড়ে, লাঠিপেটা করে এবং জল কামান ব্যবহার করে। এতে শত শত আহত হয়। কর্তৃপক্ষের কঠোর প্রতিক্রিয়া এবং আওয়ামী লীগের হিংস্র ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দেয়ায় বিক্ষোভ আরো প্রজ্বলিত হয়। একই প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় ষাটের দশকের জ্বালাময়ী ছাত্রনেতা ও বর্তমান সরকারের মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর বক্তব্যে যিনি আন্দোলনকারীদেরকে রাজাকারের বাচ্চা বলে আখ্যা দেন। ছাত্ররা কোটা সংস্কারে তাদের দাবীর বার্তা দিতে কয়েকটি সরকারী ওয়েবসাইট হ্যাক করে।
আন্দোলনকারীদের নেতাদের একজন রাশেদ খান বলেছেন, সরকার ভাংচুরের ঘটনায় জড়িত বেশ কয়েকজন ছাত্রের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার না করলে তারা পুনরায় আন্দোলন শুরু করবেন। তিনি দাবি করেন যে সাদা পোশাকের পুলিশ বাহিনী তাকে এবং আন্দোলনের অন্য দুই নেতাকে কোন অভিযোগ ছাড়া হাতকড়া পড়িয়ে ও চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে যায়, পরে ছেড়ে দেয়। তিনি আরো অভিযোগ করেন যে “এই দেশে সব রাজনৈতিক আন্দোলন নিষিদ্ধ। আমরা যে কোনো সময়ে অপহৃত হতে পারি”।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বাংলাদেশে “কোটা বিরোধী আন্দোলন” হয়েছে অনেকগুলো। সরকারী চাকরীর মাত্র ৪৪% এ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়। অনেক শিক্ষার্থী নারী (১০%), ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু (৫%), প্রতিবন্ধী (১%) এবং দেশের সকল অংশের মানুষের জন্য চাকরি নিশ্চিত করার জন্য (১০%) বিদ্যমান কোটাকে সমর্থন করে। কিন্তু তারা ক্ষমতাসীন দলের পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত পক্ষপাতিত্বমূলক ৩০% কোটার সমালোচক যা ক্ষমতাসীন দলেই কেন্দ্রীভূত থাকে। সরকার ২৫০,০০০ মুক্তিযোদ্ধাকে সনদ প্রদান করেছে। এরমধ্যে অনেকে ঘুষ প্রদান ও জালিয়াতির মাধ্যমে এই সনদ পেয়েছে।
বাংলাদেশের ক্যাম্পাস গুলো এখন শান্ত। তবুও সামগ্রিক রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের দৃষ্টিভঙ্গি তথা ১৯৭১ সালের ঘটনার প্রেক্ষিতে দেশকে বিভাজনের নীতির কারনে একটি ব্যাপক সমালোচনার উদ্ভব হয়েছে। শিক্ষার্থীরা ক্ষমতাসীন পরিবারের অনুগত বয়োজ্যেষ্ঠদের দ্বারা পরিচালিত সরকার থেকে নিজেদেরকে চটুল প্রমাণ করছে। একটি প্ল্যাকার্ডে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মানিত পিতা দেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতির নাম উল্লেখ করে লেখা হয়, “বঙ্গবন্ধুর বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই”।
ঢাকার একজন অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, বৃদ্ধমান কর্মসংস্থান সঙ্কট বিক্ষোভের শক্তি বৃদ্ধি করছে। যদিও জন্ম হার কমেছে, তবু দুই-তৃতীয়াংশ বাংলাদেশী ৩৫ বছরের কম বয়সী। সরকার প্রতি বছর ২০ লক্ষ নতুন কর্মসংস্থান তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু যে হারে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে তার তুলনায় জনশক্তি অনেক দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুবকদের মাঝে বেকারত্বের হার ১০% ছাড়িয়ে গেছে।
এই তীব্র মতবিরোধ তৈরি হয়েছে আওয়ামী লীগের হাত ধরে, যারা গত নয় বছর যাবত বাংলাদেশ কে শাসন করেছে, এবং ডিসেম্বরের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করেছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো ছত্রভঙ্গ, বিশৃঙ্খল অবস্থায় রয়েছে। শেখ হাসিনার তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী, প্রধান বিরোধীদল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেতা খালেদা জিয়া কারাগারে আছেন। এমনকি বিএনপি নিশ্চিত নয় যে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কিনা। তাদের নির্বাচনী মিত্র জামায়াত-ই-ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। বিরোধীতার একমাত্র উৎস হল সেনাবাহিনী এবং ছাত্ররা।
অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের প্রশ্ন, “আমরা এখনও কি এমন একটি নির্বাচন করতে পারি যার ফলাফল আমরা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি না?”। ২০০৮ এর নির্বাচনের পর নতুন করে নিবন্ধিত ২ কোটি ৩০ লক্ষ তরুণ ভোটাররা ক্ষমতাসীন দলের জন্য একটি উদ্বেগের বিষয় ।
দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনটির লিংক: Protests in Bangladesh put an end to a corrupt quota system