হাসান রূহী
কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করায় প্রথমতঃ গেস্টরুম নামক টর্চার সেলে বন্দী করে নির্যাতন চালানো হয় ছাত্রীদের ওপর। জুনিয়রদের সামনে সিনিয়রদের কান ধরে করানো হয় উঠবস। শারীরিক ও মানসিকভাবে চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। আর এসব নির্যাতনের রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি পেতে জেগে উঠেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রীরা। যাদের মধ্যে অন্তত ২৪ জন ছিল ছাত্রলীগেরই নেতা-কর্মী। গত ১০ই এপ্রিল মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রলীগ সভাপতি ইফফাত ওরফে ইশরাত জাহান ইশার নির্যাতনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন ওই হলে অবস্থানরত সাধারণ ছাত্রীরা। নির্যাতন চালাতে গিয়ে ওই হলের ছাত্রলীগেরেই সহ-সভাপতি মুর্শেদা খানমের পা কেটে ফেলে ছাত্রলীগ সভাপতি এশা। হলের সিঁড়িতে ছোপ ছোপ রক্ত দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন হলে অবস্থানরত ছাত্রীরা। আর এরপরই এশাকে ভোগ করতে হয় তার কর্মফল।
এশার অমানবিক হিংস্রতায় এতদিন যারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে মাথা নিচু করে চলাফেরা করত, সেই ভীরুদের বুকে জন্মে সাহস। নির্যাতনের বিরুদ্ধে তাদের নির্বাক কণ্ঠগুলো হয়ে উঠে সবাক। গণধোলাইয়ের শিকার হন মধ্যরাতে ছাত্রী নির্যাতন ও মারধরের নেশায় আসক্ত এশা। এতেই ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি সাধারণ ছাত্রীদের। এক পর্যায়ে এশাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন শিক্ষকের সামনেই পরিয়ে দেয়া হয় জুতার মালা। সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে সে ভিডিও ভাইরাল হয় সারাদেশে। জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের এই গর্জে ওঠাকে সাধুবাদ জানায় দেশের মানুষ।
সাধারণ ছাত্রীদের অভিযোগ, কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্রীদের আন্দোলনের প্রথম দিন থেকেই কক্ষে নিয়ে মারধর করে আসছিলেন ইফফাত জাহান এশা। তবে নির্যাতনের শিকার ছাত্রীরা ভয়ে কাউকে কিছু বলেননি। কিন্তু ওইদিন মধ্যরাতের ঘটনার পর হলের সাধারণ ছাত্রীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
এরই মধ্যে ঘটে যায় কিছু কাকতালীয় ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করার মত অনধিকার চর্চা ও অমানবিক কর্মকান্ডের দায়ে ছাত্রলীগ নেত্রী এশাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও ভাইস চ্যান্সেলর। মিডিয়ার সামনে তারা এ ঘোষণা দেয়ার কিছু সময় পর আসে ছাত্রলীগের বিবৃতি। যেখানে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ছাত্রলীগ থেকে এশাকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়। ছাত্রীদের ওপর নির্যাতন ও একজন ছাত্রীর পা কেটে ফেলার খবরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে বেরিয়ে এসেছিল সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা সুফিয়া কামাল হলের সামনে জড়ো হয়ে ছাত্রলীগ নেত্রী এশার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। এ ঘটনার প্রতিবাদে সুফিয়া কামাল হলের সাধারণ ছাত্রীরাও হলটির মাঠে অবস্থান নিয়ে এশাকে বহিষ্কারের দাবি করেন। নিশ্চয়তা চান নিরাপদভাবে হলে অবস্থানের। এসময় তারা ‘নির্যাতনকারীর কালো হাত, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’, ‘মরতে নয়, পড়তে চাই’, ‘বোনের ওপর হামলা কেন, প্রশাসন জবাব চাই’- স্লোগান দিতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে আসা সেই কথিত বহিষ্কারাদেশ শুনে দীর্ঘ তিন ঘন্টা ধরে অবস্থান করা শিক্ষার্থীরা যে যার হলে ফিরে যায়। এরই মধ্যে বিভিন্ন পত্রিকায় এশা ও ঢাবি ছাত্রলীগের বিভিন্ন নিপীড়নমূলক কর্মকান্ড নিয়ে খবর বের হতে থাকে। সেখানে মিলতে থাকে পিলে চমকে যাওয়ার মত অনেক তথ্য। পত্রিকায় খবর ছাপা হয় ‘ঢাবিতে মধ্যরাতে ছাত্রী নির্যাতন মারধরই এশার নেশা।’ (দৈনিক মানবজমিন, ১২ এপ্রিল ২০১৮)
এরপর ঘটে গেছে অনেক নাটকীয়তা। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে ফেরাতে সাজানো হয় ভিসির বাড়িতে অগ্নিসংযোগের নাটক। আন্দোলনকারীদের কোনঠাসা করার চেষ্টা চলে দুর্দান্ত গতিতে। অন্যদিকে জুতার মালা নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হওয়া ছাত্রলীগ নেত্রীকে হলে ও দলে ফেরাতে পর্দার আড়ালে চলতে থাকে নানা তৎপরতা। এরপর দেখা গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও ছাত্রলীগের নেতারা বলতে শুরু করেছে – জীবন বাঁচাতেই নাকি তখন এশাকে বহিষ্কারের নাটক সাজিয়েছিলেন তারা। এরই মধ্যে আবার এল ছাত্রলীগের বিবৃতি। তাতে বলা হল ওই রাতের ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব নাকি স্বপ্রণোদিত হয়ে ছাত্রলীগ গ্রহন করেছে। ইয়াবা ও দেহব্যবসায় অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেত্রী নিশীতা ইকবাল নদীসহ ৪ সদস্যের কমিটি করা হয় এশাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে। তদন্ত চলাকালীন সময়েই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের পক্ষ থেকে ফুলমাল্য দিয়ে বরণ করে নেয়া হয় এশাকে। মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে এশাকে নির্দোষ বলে ফের ঘোষণা দেয় ছাত্রলীগ। কোন তদন্ত ছাড়াই ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
১৬ এপ্রিল সন্ধ্যার পর আবারো একটি বিবৃতি দেয় ছাত্রলীগ। এই বিবৃতিতে তারা এশার উপর হামলার ঘটনায় অভিযুক্ত দাবি করে সুফিয়া কামাল হলের ২৪জন ছাত্রলীগ নেত্রীকে স্থায়ীভাবে বহিস্কারের ঘোষণা দেয়। যাদের মধ্যে ছাত্রলীগের একজন কেন্দ্রীয় নেত্রীও রয়েছেন। এখন প্রশ্ন হলো, সাধারণ ছাত্রীদের ওপর নির্মম অমানবিক নির্যাতনকারী ছাত্রলীগের সভাপতি এশাকে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে দেয়া হলো ফুলের মালা। অনেকটা নিজেদের গায়ের জোরে ঘোষণা করা হলো নিরপরাধ। আর তাকে জনরোষ থেকে উদ্ধার করতে না যাওয়া কিংবা তার অত্যাচারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার অপরাধে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হলো ২৪জন নেতা-কর্মীকে। এর মাধ্যমে ছাত্রলীগ আসলে জাতিকে কি বার্তা দিতে চায়? ছাত্রলীগ সম্ভবত কোন প্রকার রাখঢাক ছাড়াই উচ্চকিত কণ্ঠে ঘোষণা করতে চায় যে, ছাত্রলীগে শুধু সন্ত্রাসীরাই থাকবে। এটাই ছাত্রলীগের রাজনীতি। এর বাইরে তারা এখনও পর্যন্ত অন্য কিছুই চিন্তা করছে না।