অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
দলীয় নেতাকর্মীদের বিভিন্ন অপকর্মের জন্য বাহিষ্কার করা বর্তমানে ছাত্রলীগের একটি নিয়মিত কাজে পরিণত হয়েছে। চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি, খুন, লুটপাট, ধর্ষণ কিংবা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে অহরহই এই বহিষ্কারের ঘটনা ঘটছে। তবে এসব অপরাধ করলেই যে তার বহিষ্কার অনিবার্য তা কিন্তু নয়। যে ঘটনাগুলো বেশি আলোচিত হয় এবং নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠে সেসব ঘটনাতেই কেবল অভিযুক্তকে বহিষ্কার করা হয়ে থাকে।
প্রতিবাদ ও সমালোচনার মুখে দলীয় নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করলেও পরবর্তীতে আবার তাদেরকে বিভিন্ন পদে আসীন করা হয়। বিশেষ করে ক্যাম্পাসগুলোতে এরকম চিত্র বেশি দেখা যায়। বিভিন্ন ঘটনায় নেতা-কর্মীদের বহিষ্কার করা হলেও তাঁরা ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন হননা। তাঁরা সংগঠনের সব ধরনের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বহিষ্কৃতদের ভবিষ্যতে সংগঠনের আরো বড় পদ দেয়া হয়। অর্থাৎ বহিষ্কার হওয়াটা যেনো সংগঠনটির নেতাকর্মীদের জন্য একটি বাড়তি যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর মাধ্যমে নেতাকর্মীদেরকে অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি, খুন, ধর্ষণ, ছিনতাইসহ নানা অপকর্মে উৎসাহিত করে সংগঠনটি। কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেয়া এক ছাত্রীর পায়ের রগ কেটে দেয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রলীগ সভাপতি ইফফাত জাহান ইশা যার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
২০১২ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষে পুলিশের সামনে প্রকাশ্যে অস্ত্র চালানো আখেরুজ্জামান তাকিম ও তৌহিদ আল হোসেন ওরপে তুহিন থেকে শুরু করে আজকের ইফফাত জাহান এশা পর্যন্ত কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতার কথা এখানে তুলে ধরা হলো। যাদেরকে নানা অপকর্মের দায়ে বহিষ্কার করার পর ফের সংগঠনের পদে বহাল কিংবা আরো উচ্চপদে আসীন করা হয়েছে।
আখেরুজ্জামান তাকিম
ছাত্রত্ব না থাকলেও ২০১২ সালের জুন মাসে গঠিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সহসভাপতির পদ পেয়েছিলেন আখেরুজ্জামান তাকিম। ২০১২ সালের ২ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির ও ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষের সময় পিস্তল বের করে প্রকাশ্যে গুলি ছুঁড়েন তিনি। গুলি ছোঁড়ার সেই ছবি তখন পত্রিকাতেও আসে। ওই বছরের ১৫ জুলাই রাতে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কর্মী আবদুল্লাহ আল হাসান ওরফে সোহেল রানা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
ওই ঘটনায় আখেরুজ্জামান ও তখনকার সাংগঠনিক সম্পাদক তৌহিদ আল হোসেন জড়িত ছিলেন বলে অভিযুক্ত করা হয়। এই ঘটনার পর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি সংগঠনের শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও সংগঠনবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁদের দুজনকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে। কিন্তু বহিষ্কার করা হলেও পরে তাকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য করা হয়।
তৌহিদ আল হোসেন (তুহিন)
২০১২ সালের ২ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির ও ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষের সময় পুলিশের সামনে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি ছুঁড়তে দেখা গেছে তৎকালিন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম তৌহিদ আল হোসেন ওরফে তুহিনকে। পরদিন সে ছবি পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। একই বছর দলের কর্মী আবদুল্লাহ আল হাসানকে হত্যার অভিযোগ ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে তাকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। ২০১৩ সালের ২০ জুলাই গঠিত ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কমিটিতে তৌহিদকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
নাসিম আহাম্মেদ
২০১২ সালের ৪ ডিসেম্বর রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের টিভি কক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোটের তৎকালীন সভাপতি আরিফ পারভেজকে পিটিয়েছিলেন নাসিম আহাম্মেদের নেতৃত্বে কয়েকজন ছাত্রলীগের কর্মী। পরদিন সাংস্কৃতিক কর্মীদের তোপের মুখে ছাত্রলীগের তৎকালীন উপপাঠাগার সম্পাদক নাসিমকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। কিন্তু নাসিম ছাত্রলীগের সব কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতো। ২০১৩ সালের ২০ জুলাই ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ২৪তম কাউন্সিলে গঠিত কমিটিতে তিনি যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পান।
সাকিব হাসান সুইম
আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ২০১৩ সালের ৩০ নভেম্বর গভীর রাতে ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ছাত্র আসাদুজ্জামান ফারুক মারা যান। ওই হত্যা মামলার অন্যতম আসামি ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাকিব হাসান সুইম। ঘটনার পরই সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল তাকে। ২০১৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি গঠিত ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সাকিব হাসান সুইম সহ-সভাপতি হয়েছেন।
সৃজন ঘোষ
ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সৃজন ঘোষ আগের কমিটিতে উপক্রীড়া সম্পাদক ছিলেন। ২০১৪ সালে এক মোবাইল রিচার্জ ব্যবসায়ীকে জিম্মি করে টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় তাকে বহিষ্কার করেছিল ছাত্রলীগ।
আমিনুল ইসলাম
ছাত্রলীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি আমিনুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের ছাত্র ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় নকল করার অভিযোগে বহিষ্কার হয়েছিলেন তিনি। পরে আর লেখাপড়া শেষ করতে পারেননি ছাত্রলীগের শহীদুল্লাহ হলের সাবেক এই সভাপতি।
আনোয়ার হোসেন আনু
আনোয়ার হোসেন আনু ছাত্রলীগের বর্তমান পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সহ-সভাপতি পদে আছেন। আগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আনু এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তার বিরুদ্ধে সলিমুল্লাহ হলের আশপাশ এলাকায় মাদক ব্যবসা ও ‘জুনিয়রদের’ দিয়ে ছিনতাই করানোসহ বিভিন্ন অভিযোগ গণমাধ্যমে এসেছে। কয়েক দফায় সংগঠন থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছিল তাকে।
নুর আলম ভূঁইয়া রাজু
২০১৭ সালের ২১ জানুয়ারি ঢাকা কলেজে চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় পরদিন কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ও ঢাকা কলেজ শাখার আহ্বায়ক নুর আলম ভূঁইয়া রাজুসহ ১৯ নেতাকে বহিষ্কার করে ছাত্রলীগ। কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসেন স্বাক্ষরিত গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে তাঁদেরকে বহিষ্কার করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ৪ জানুয়ারি সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে নুর আলমকে আপ্যায়ন উপকমিটিতে দায়িত্ব দেয়া হয়।
ইফফাত জাহান এশা
গত মঙ্গলবার(১০ এপ্রিল) রাত ১২টার দিকে কবি সুফিয়া কামাল হলে তিন ছাত্রীকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেয়ায় মারধর ও এক ছাত্রীর পায়ের রগ কেটে দেয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইফফাত জাহান এশা। এশা ঐ তিন ছাত্রীকে তার নিজ কক্ষে (৩০৭) ডেকে নিয়ে নির্যাতন করেন। এসময় তাদের চিৎকার শুনে হলের অন্য সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের উদ্ধারে এগিয়ে যান। তখন মোর্শেদা খানমকে পায়ের রগ কাটা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
এ খবর ছড়িয়ে পড়লে ক্ষোভে ফেটে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা। ছাত্রলীগের বাধা উপেক্ষা করে ছেলেদের হল থেকে মিছিল নিয়ে কবি সুফিয়া কামাল হলের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করে ৪-৫ হাজার শিক্ষার্থী। এসময় তারা এশাকে বহিষ্কারের দাবি করেন।
এক পর্যায়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে এশাকে হল ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয় প্রশাসন। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে বহিষ্কার করা হয় ছাত্রলীগ থেকেও। কিন্তু আন্দোলন স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর এশার বাহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে তাকে স্বপদে বহাল করে ছাত্রলীগ।