মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যের রাজনৈতিক অপব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী তোলপাড় ফেলে দেওয়া ব্রিটিশ তথ্য বিশ্লেষণী প্রতিষ্ঠান ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকার পা পড়েছে বাংলাদেশেও। ২০১৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দল অাওয়ামী লীগের সঙ্গে তারা যোগাযোগ করেছে।
ভারতের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্থান টাইমসের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য এসেছে। ১৯ মার্চ পত্রিকাটি এ সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বাংলাদেশ ছাড়াও শ্রীলঙ্কা ও ভারতের পরবর্তী নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে ‘ভোটার ভোলানো’ প্রতিষ্ঠানটি।
ভারতে ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকার শরিক প্রতিষ্ঠানের নাম ওভেলানো বিজনেস ইন্টেলিজেন্স (ওবিআই)। মূলত তারাই ভারত, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করছে।
ওবিআইর সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে হিন্দুস্থান টাইমসের প্রতিবেদনে জানানো হয়, ভারতের পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিজেপি ও কংগ্রেস, শ্রীলঙ্কার পরবর্তী নির্বাচনকে সামনে রেখে সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দ্র রাজাপাকশে এবং বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা করেছে তারা। তবে ওই কর্মকর্তার দাবি, ‘শুধু প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। এখনো কোনো কিছু চূড়ান্ত হয়নি।’
ওবিআইর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অমরেশ ত্যাগী বলেছেন, ‘ভারতে আমরা ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকার সহযোগী। ভারতীয় আইন সমর্থন করে না, এমন কোনো বিষয় সামনে এলে আমরা অবশ্যই সেটি বিবেচনা করব।’
ত্যাগী আরও বলেছেন, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিহারের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ‘জনতা দল ইউনাইটেড’ ওবিআইর সাহায্য নিয়েছিল। ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকার ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, তারা বিহারের নির্বাচনে যতগুলো আসন বাছাই করেছিল তার ৯০ ভাগেরও বেশি আসনের ফল তাদের পক্ষে আসে।
এ বিষয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল কোনো নেতাই মন্তব্য করতে রাজি হননি। নাম প্রকাশেও তারা আগ্রহী নন।
আওয়ামী লীগের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রিয়.কমকে বলেন, ‘এ বিষয়ে জানা নেই।’ পরে আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্যের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এইসব আজগুবি খবর কই পান?’ বলেই ফোন কেটে দেন।
এরপর আরও একজন প্রেসিডিয়াম সদস্যের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘এ রকম মিথ্যা বিষয়ে আমাদের বক্তব্য থাকা উচিত না।’
ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা কী
এটি একটি ব্রিটিশ তথ্য বিশ্লেষণী প্রতিষ্ঠান, যারা সাধারণ মানুষের তথ্য বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক ও সামরিক উদ্দেশ্যে বিশ্লেষণ ও ব্যবহার করে। ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত অনেক দেশের বেশ কিছু নির্বাচনে প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্টতা এবং নির্বাচনের ফলাফলে ব্যাপক প্রভাব রাখার অভিযোগ আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়া নিয়ে যে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল (ব্রেক্সিট), ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা সেই ভোটেও ব্যাপক প্রভাব রেখেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
সর্বশেষ ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটারদের তথ্যের অপব্যবহার করে নির্বাচনী ফলাফলে প্রভাব রাখার অভিযোগ ওঠে তাদের বিরুদ্ধে। মার্চের শুরু দিকে ওঠা এ অভিযোগ নিয়ে এখনো যুক্তরাষ্ট্রে তোলপাড় চলছে।
ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা নিয়ে কেন তোলপাড়
মূল ঘটনাটি শুরু হয়েছিল ২০১৩ সালে। যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক আলেক্সান্দার কোগান ‘দিস ইজ ইউর ডিজিটাল লাইফ’ নামের একটি সোশ্যাল অ্যাপ তৈরি করেন। অ্যাপটিতে ফেসবুকের মাধ্যমে লগইন করতে হতো। কোনো গ্রাহক অ্যাপটিতে লগইন করলে তার ব্যক্তিগত কিছু তথ্য শেয়ার করতে হতো।
অ্যাপটিতে লগইন করার মাধ্যমে ব্যবহারকারীর তথ্যের পাশাপাশি তার ফেসবুক বন্ধুদের তথ্যও কোগানের হাতে চলে যায়। এভাবে প্রায় পাঁচ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য পেয়ে যান কোগান। এসব ব্যবহারকারী কোথায় থাকেন, কোন কোন পোস্টে লাইক দিচ্ছেন, তাদের পছন্দ-অপছন্দ কী—সব তথ্য পেয়ে যান কোগান।
মনোবিজ্ঞানের গবেষণার কাজে এসব তথ্য ব্যবহার করার কথা বললেও কোগান একপর্যায়ে এসব তথ্য ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকার কাছে বিক্রি করে দেন। ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকাই ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারের দায়িত্ব পায়। তারা তখন কোগানের কাছ থেকে পাওয়া পাঁচ কোটি গ্রাহকের তথ্য সমষ্টিগতভাবে বিশ্লেষণ না করে আলাদা আলাদা ব্যক্তি ধরে বিশ্লেষণ করে (মাইক্রো টার্গেটিং) এবং প্রতিটি ভোটারের চাহিদা, ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা বিবেচনা করে তাদের ফেসবুকে আলাদা আলাদা বিজ্ঞাপন ও ভুয়া খবর দেখাতে থাকে। এভাবে তারা বিশালসংখ্যক ভোটারকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়। নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হন।
ফেসবুকের ভূমিকা
ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকার বিরুদ্ধে অভিযোগ সামনে আসার পর বড় ধরনের সংকটে পড়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং প্রতিষ্ঠান ফেসবুক। ফেসবুক গ্রহকের ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা দিতে পারছে না—এমন অভিযোগ আসতে থাকে মার্কিন প্রভাবশালী রাজনতিবিদ, ব্যবসায়ী, প্রযুক্তি উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে সাধারণ ব্যবহারকারীদের কাছ থেকেও। ভুল স্বীকার করে বিবৃতি দিতে বাধ্য হন ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ। ভবিষ্যতে আর এ ধরনের ঘটনা ঘটবে না বলে অঙ্গীকার করেন তিনি।
জাকারবার্গ তার বিবৃতিতে বলেন, ‘আলেক্সান্দার কোগান যখন এই অ্যাপটি তৈরি করেছিলেন, তখন এ ধরনের সামাজিক অ্যাপকে আরও বেশি সুযোগ দেওয়ার নীতি ছিল ফেসবুকের। ২০১৪ সালে ফেসবুক তাদের নীতি পরিবর্তন করে এবং এ ধরনের অ্যাপ যাতে ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য নিতে না পারে, সে ব্যাপারো কঠোর হয়।’
কিন্তু ততদিনে যা হওয়ার হয়ে গেছে। কোগানসহ অজানা অনেকের কাছেই বহু ফেসবুক ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য চলে গেছে।
জাকারবার্গ দাবি করেছেন, সংগ্রহের পর ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য মুছে ফেলতে ফেসবুকের সঙ্গে কোগানের চুক্তি ছিল। কিন্তু কোগান বা পরবর্তীতে ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা সে তথ্য মুছে ফেলেছে কি না, তা যাচাই করেনি ফেসবুক। এটিকেই ফেসবুকের বড় ভুল বলে স্বীকার করেছেন জাকারবার্গ। তিনি বলেছেন, ‘এ ধরনের যত অ্যাপ আছে তাদের প্রত্যেকটিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করা হবে এবং কোনো ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য বেহাত হয়েছে সন্দেহ হলে সংশ্লিষ্ট ব্যবহারকারীকে জানিয়ে দেওয়া হবে।
শঙ্কার জায়গা
‘আপনার সন্তান কেমন হবে’, ‘আপনার হবু স্ত্রী দেখতে কেমন হবে’, ‘৪০ বছর পর আপনাকে দেখতে কেমন লাগবে’—এ ধরনের বহু অ্যাপ প্রতিদিনই ফেসবুকে দেখা যায়। মানুষ মজা করে এসব অ্যাপে ক্লিক করে ফলাফল দেখতে চায়। কিন্তু এ অ্যাপগুলোই ফেসবুকের ব্যক্তিগত তথ্য বেহাত হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। কোনো গ্রাহক যখন এ ধরনের কোনো অ্যাপ বা ভুয়া ওয়েবসাইটের লিংকে ক্লিক করেন, তখন তার ব্যক্তিগত তথ্য ওই ওয়েবসাইটে চলে যাওয়ার ঝুঁকি প্রবল হয়। ওই ওয়েবসাইট চাইলে তখন তার ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহার করতে পারে—এমন অভিযোগই এসেছে ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকার বিরুদ্ধে।
যদিও ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, ফেসবুকের নিয়ম লঙ্ঘন করে গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, এমন তথ্য জানার পর তারা গ্রাহকের সব ব্যক্তিগত তথ্য সম্পূর্ণ মুছে দিয়েছে। ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অধ্যাপক কোগানের কাছ থেকে পাওয়া কোনো তথ্য ব্যবহার করা হয়নি।
সূত্র: প্রিয় ডটকম