অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
নেপালের রাজধানী কাঠমাণ্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে স্মরণকালের এক ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার শিকার হলো বাংলাদেশি একটি যাত্রীবাহী বিমান। দেশের ভেতরে এর আগে সামরিক ও বেসরকারি কোনো বিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়লেও এত হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। দুর্ঘটনায় অর্ধশত মানুষ নিহত ও ২২ জন মানুষ গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনায় পুরো দেশ স্তম্ভিত হয়ে গেছে।
কী কারণে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটলো। এটাই এখন জানার চেষ্টা চলছে। আর ইউএস বাংলার বিমান নিয়ে আগেও একাধিকবার অভিযোগ উঠেছে। বরাবরই তারা বিষয়গুলোকে কৌশলে ধামাচাপা দিয়ে আসছেন।
পরিস্থিতির আলোকে বুঝা যাচ্ছে সোমবারের এই ভয়াবহ দুর্ঘটনাতেও ইউএস বাংলা কর্তৃপক্ষ দায় এড়ানোর চেষ্টা করছেন। সোমবার সন্ধ্যায় তাৎক্ষণিক সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইমরান আসিফ দাবি করেছেন, কন্ট্রোলরুমের ভুলের কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে। যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল না। তিনি বলেন, তারা একেকবার একেক নির্দেশনা দিচ্ছিল, যে কারণে এ দুর্ঘটনাটি ঘটে। ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক কামরুল ইসলামও দাবি করেছেন, উড়োজাহাজে কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল না। এটা দুর্ঘটনা।
বিমানে কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল না বলে ইউএস বাংলা কর্তৃপক্ষ এমন দাবি করলেও বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে আসা যাত্রী, ত্রিভুবন বিমানবন্দরে ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষমান থাকা এক বাংলাদেশি প্রত্যক্ষদর্শী ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের বক্তব্য অনুযায়ী ইউএস বাংলা কর্তৃপক্ষের দাবি মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। বিমানে যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল বলেই মনে করছেন সবাই।
যা বলছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল জাজিরার প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়, ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মহাব্যবস্থাপক রাজ কুমার ছেত্রি বলেছেন, কন্ট্রোল রুমের নির্দেশ অমান্য করে ভুল পথে অবতরণ করার ফলে রানওয়ে থেকে পিছলে পড়ে বিমানটি। তিনি দাবি করেন, কন্ট্রোল রুম বিমানটিকে দক্ষিণ দিক থেকে অবতরণ করার অনুমতি দেয়। কিন্তু বিমানটি আকাশে কয়েকটি চক্কর কেটে উত্তর দিক থেকে অবতরণ করে।
যা বললেন বাংলাদেশি প্রত্যক্ষদর্শী
নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ বাংলাদেশি ছাত্র আশীষ কুমার সরকার বলেছেন, তিনি বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলেন বাংলাদেশে ফেরার জন্যে। ইউ-এস বাংলার এই বিমানে করেই তার ঢাকায় ফেরার কথা ছিলো। তিনি বলেন, আমার চোখের সামনেই সবকিছু হলো। বোর্ডিং পাস হাতে নিয়ে আমি অপেক্ষা করছিলাম। এসময় এই দুর্ঘটনা ঘটে। আমি দেখলাম ল্যান্ড করার সঙ্গে সঙ্গেই বিমানটি কাঁপছিলো। মনে হচ্ছিলো যে ওটা মনে হয় ঠিক মতো ল্যান্ড করতে পারছিলো না। তারপর দেখলাম যে হঠাৎ করে বিমানে আগুন ধরে গেছে।
তিনি বলেন, দুর্ঘটনার পরপরই তিনি কোনো উদ্ধার তৎপরতা দেখতে পান নি। ইউএস-বাংলার কোনো কর্মকর্তা তখনও পর্যন্ত অপেক্ষমাণ যাত্রীদের সাথে যোগাযোগ করেনি। তাদের কাউন্টারও বন্ধ ছিলো বলে তিনি জানান।
পাইলটের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের শেষ কথা
ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মহাব্যবস্থাপক রাজ কুমার ছেত্রি বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম রয়টার্স জানিয়েছে, কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হওয়ার আগ পর্যস্ত উড়োজাহাজটির পাইলট নিয়ন্ত্রণ কক্ষকে জানিয়েছিলেন কোনো সমস্যা নেই। তবে পাইলট উড়োজাহাজটিকে একটি নির্দিষ্ট দিকে অবতরণ করাতে চাইছিলেন।
রাজ কুমার ছেত্রি বলেন, বিমানবন্দরে নামার অনুমতি পাওয়ার পর উড়োজাহাজটির পাইলট বলেন, তিনি উত্তর দিকে অবতরণ করতে চান। তখন কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে জানতে চাওয়া হয়, কোনো সমস্যা আছে কি না। এর জবাবে পাইলট জানিয়েছিলেন, কোনো সমস্যা নেই। অবতরণের আগে দুবার আকাশে চক্কর দেয় উড়োজাহাজটি। আবার নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার থেকে জানতে চাওয়া হয়, সবকিছু কি ঠিক আছে? জবাবে পাইলট জানান, ঠিক আছে। এরপর অবতরণে অসংগতি দেখে নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার থেকে পাইলটকে জানিয়ে দেওয়া হয়, উড়োজাহাজটি ঠিকভাবে অবতরণ করছে না। কিন্তু এ কথার কোনো জবাব পাইলটের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। এরপর নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার থেকে পাইলটের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
মহাব্যবস্থাপক রাজ কুমার ছেত্রি বলেন, অবতরণের সময় যথাযথ নির্দেশনায় থাকা উচিত ছিল উড়োজাহাজটির। কিন্তু উড়োজাহাজটি কোনো কারণে ওই নির্দেশনায় ছিল না। একপর্যায়ে উড়োজাহাজটি বিমানবন্দরের দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে ও সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে যায়।
বিধ্বস্ত বিমানটি আগেও দুর্ঘটনায় পড়েছিল
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর একবার ৭৪ জন যাত্রী নিয়ে সৈয়দপুর বিমানবন্দরে যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য বিমানটি রানওয়ে থেকে ছিটকে ঘাসের ওপর পড়ে। বিমানটি রানওয়ের এক প্রান্তে ইউটার্ন নিয়ে যখন পার্কিং বে-তে আসছিল তখন একটি চাকা আটকে যায়। সেদিন ঢাকা থেকে দ্রুততার সঙ্গে হেলিকপ্টারযোগে দক্ষ প্রকৌশলীদের নিয়ে যাওয়া হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রকৌশলীরা বিমানটি পার্কিং বে-তে ফিরিয়ে আনেন এবং ফিরতি যাত্রীদের নিয়ে যথারীতি ঢাকায় ফিরে আসে। সেসময় যাত্রীরা ভয়ঙ্কর আতঙ্কিত হলেও কর্তৃপক্ষ একটি ব্রিফ দিয়ে দায় সেরেছিল।
ঠিক প্রায় আড়াই বছর পর সেই বিমানটিই আজ নেপালে বিধ্বস্ত হলো।
এসব তথ্য থেকে প্রমাণিত হয় ইউএস বাংলার বিমানটি ত্রুটিযুক্ত ছিল। হতাহতের ঘটনা থেকে নিজেদের দায় এড়াতেই তারা এখন মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনেরা।
সচেতন মানুষও বলছেন, ভয়াবহ এই বিমান দুর্ঘটনার ঘটনায় সঠিক তদন্ত করতে হবে। বিমান কর্তৃপক্ষের যদি কোনো গাফলতি থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় ভবিষ্যতে এর চেয়েও আরও ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।