মুসাফির রাফি
ড. মুহাম্মাদ জাফর ইকবাল বাংলাদেশের বহুল আলোচিত, সমালোচিত এবং প্রশংসিত একজন শিক্ষক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চতর শিক্ষালাভ করে সেখানকার বহু লোভনীয় চাকুরীর সুযোগ ছেড়ে বাংলাদেশের সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বর্তমানে শিক্ষকতা করছেন। তিনি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নন, বড় কোন প্রশাসনিক পদেও তিনি নেই। তথাপি এই কথা নি:সন্দেহে বলা যায় তিনিই সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে আলোচিত শিক্ষক। শিক্ষকতার পাশাপাশি তার সাহিত্যকর্ম, মিডিয়ায় শিক্ষা ও রাজনীতি বিষয়ক কলাম এবং টেলিভিশনে প্রানোচ্ছল উপস্থিতি তাকে বরাবরই সংবাদের শিরোনাম করে রেখেছে।
শনিবার রাতে ড. জাফর ইকবাল আবারও খবরের শিরোনাম হলেন তবে সেটা উপরোক্ত কারনে নয়, বরং একেবারেই অনাকাঙ্খিত। টেলিভিশনের স্ক্রলের মাধ্যমেই সারা বাংলাদেশের মানুষ হঠাৎ জানতে পারলো ড. জাফর ইকবাল সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছেন। তার নিজেরই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিজ্ঞান বিষয়ক অনুষ্ঠানে ভাষন দিয়েছিলেন শনিবার বিকেলেই। তার পরপরই তিনি হামলার শিকার হন। আমরা ড. মুহাম্মাদ জাফর ইকবালের উপর এই কাপুরোষিচিত এবং ন্যাক্কারজনক হামলার তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাই।
ড. জাফর ইকবাল বর্তমান সরকারের আস্থাভাজন ব্যক্তিত্ব। তিনি সরকারের গুড বুকে আছেন। তাই তিনি সৌভাগ্যবান। রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তার চিকিৎসার তদারকি করছেন। হামলাকারীকে ধরতে আইন শৃংখলা বাহিনীকে নির্দেশও দিয়েছেন। হামলার পর থেকে জাফর ইকবাল কখনোই মৃত্যু শংকায় ছিলেন না। সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরাও তেমন কোন ইংগিত দেননি। তারপরও প্রধানমন্ত্রী তাকে জরুরী ভিত্তিতে তাকে ঢাকায় আনার নির্দেশ দেন। নির্দেশ পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব তার নিজস্ব এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে করে ড. ইকবালকে ঢাকায় নিয়ে আসেন এবং রাতেই তাকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়।
আহা, জাফর ইকবাল স্যার আপনি কত সৌভাগ্যবান। সিলেটে এর আগেও বহু সাধারন নারী, ছোট শিশু, কিশোর বর্বরোচিত হামলার শিকার হয়েছে, কিন্তু তারা এত ভাল ভাগ্য নিয়ে জন্মায়নি। আপনি সেই সুযোগ পেয়েছেন। দোয়া করি আপনি জলদি সুস্থ হয়ে যান।
ইতোমধ্যেই অধ্যাপক জাফর ইকবাল এখন শঙ্কামুক্ত আছেন মর্মে বিভিন্ন পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে জানতে পারলাম। মিডিয়াগুলো অবশ্য আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) সূত্রে এই খবরটা জানিয়েছে।
অন্যদিকে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ইতোমধ্যেই হামলাকারীকে আটকের পর সনাক্ত করতেও সক্ষম হয়েছে। তার নাম ফয়জুর রহমান ওরফে ফয়জুল (২৪)। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী কুমারগাঁওয়ের শেখপাড়ার বাসিন্দা ফয়জুর রহমান। তাঁর মূল বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই। ঘটনার পরপরই শেখপাড়ার বাসাটি তালাবদ্ধ করে ফয়জুলের পরিবারের সদস্যরা চলে গেছেন। শনিবার সন্ধ্যায় শেখপাড়ার বাসাটিতে গিয়ে কাউকে খুঁজেও পাওয়া যায়নি। তাঁদের বাসাটি তালাবদ্ধ। কুমারগাঁও বাসস্টেশনের দুজন প্রত্যক্ষদর্শী ফয়জুলের পরিবারের সদস্যদের একসঙ্গে চলে যেতে দেখেছেন। তাঁরা কোথায় যাচ্ছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘মেডিকেলে যাচ্ছি।’
এলাকাবাসী জানিয়েছেন, ফয়জুল মাদ্রাসাশিক্ষার্থী বলে এলাকায় পরিচয় দিতেন। তবে কোন মাদ্রাসায় পড়েন- এ বিষয়ে এলাকার কেউ জানাতে পারেননি।
অন্যদিকে শনিবার রাত ১২টা নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের ওই বাসাটিতে তল্লশি শুরু করে পুলিশ। সে সময় বাসাটি বাইরে থেকে তালা লাগানো থাকায় পুলিশ তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। তালাবদ্ধ বাসার ভেতরে ফয়জুরের মামা ফজলুর রহমান অবস্থান করছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রাত সোয়া ১টার দিকে থানায় নিয়ে আসা হয়।
আটক এই মামা সুনামগঞ্জ জেলা কৃষকলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক। আমরা এভাবে বলতে চাইনা। ব্লেম গেম কৌশলটি আওয়ামী লীগের নোংরা কৌশল। যখনই তথাকথিত প্রগতিশীল কোন ব্যক্তি সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয় তখনই কালবিলম্ব না করে এমনকি কোন ধরনের তদন্ত ছাড়াই হামলার জন্য ইসলামপন্থী জনগোষ্ঠীকে দায়ী করা হয়। অসংখ্য নিরীহ মানুষকে হয়রানি করা হয়। জাফর ইকবালের উপর হামলাকারীকে এরই মধ্যে মাদ্রাসা ছাত্র হিসেবে পরিচয় দেয়া হচ্ছে যদিও সে কোন মাদ্রাসার ছাত্র তা কোন সূত্রই নিশ্চিত করতে পারছেনা। আমরা আশা করবো, সরকার এই সন্ত্রাসী হামলাকে ইস্যু বানিয়ে নিরীহ মাদ্রাসা ছাত্রদের হয়রানি করবেনা।
জাফর ইকবাল স্যারেরা সৌভাগ্যের বরপুত্র। দুনিয়ার এই ক্ষনস্থায়ী জীবনে যতটা সম্মান ও মর্যাদা পাওয়া যায়, তার সবটুকুই তারা পেয়েছেন। তেমন একজন মানুষ সন্ত্রাসী হামলার শিকার হওয়ায় এটা প্রমানীত হয় যে বাংলাদেশের আইনশৃংখলা পরিস্থিতির কি ভীষন অবনতি হয়েছে। তার মত মানুষ যিনি পুলিশী নিরাপত্তা পান, যিনি সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট তিনি যদি তার নিজ কর্মস্থলে এভাবে নির্যাতিত হন, তাহলে আমরা সাধারন আমজনতা আসলে কতটা নিরাপদ?
সরকার যদি ইতোপূর্বে সংঘঠিত সব ধরনের অন্যায় ও সন্ত্রাসী হামলাগুলোকে নিয়ে রাজনীতি না করে সঠিকভাবে তদন্ত করে প্রকৃত হামলাকারীদেরকে বিচারের আওতায় আনতো তাহলে হয়তো আমরা সমস্যার মূলে যেতে পারতাম। তা না করে সরকার করেছে ঘৃন্য প্রতিহিংসার রাজনীতি। তারা সেই ঘটনাগুলোকে প্রতিপক্ষ দমনের কাজে ব্যবহার করেছে। আইনশৃংখলা বাহিনীকে স্বাধীনভাবে কাজও করতে দেয়নি। আমরা আশা করবো, এবার অন্তত তা হবেনা। এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত এবং প্রকৃত হামলাকারীদের বিচার এখন সময়ের দাবী।