পিলখানা হত্যাকাণ্ড ছিল স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ওপর প্রত্যক্ষ হুমকি। একইসঙ্গে সেনা কর্মকর্তা হত্যার ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত ছিল বলে বিডিআর হত্যা মামলার রায়ে মন্তব্য করেন হাইকোর্ট। রায় ঘোষণার সময় উচ্চ আদালত তাদের পর্যবেক্ষণে তুলে ধরেন সেদিনের লোমহর্ষক সব তথ্য। তারা বলেন, সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করাই ঘটনার শেষ নয়, লাশের চেহারা পাল্টে দিতে মৃতদেহে পেট্রল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া, বেয়নেট দিয়ে আঘাত করে লাশ বিকৃতির মতো বীভৎসতা ছিল। এমনকি আসামিরা সেনা কর্মকর্তা এবং তাদের স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের মৃতদেহের প্রতি শ্রদ্ধা না দেখিয়ে পুরুষ ও নারীদের লাশ একসঙ্গে মাটিচাপা দেয়।
২০১৭ সালের ২৬ নভেম্বর ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিলের রায় দেওয়া শুরু করেন বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বৃহত্তর হাইকোর্ট বেঞ্চ। বেঞ্চের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার।
অপরাধীদের নৃশংসতার কথা তুলে ধরে আদালত বলেন, ‘নারী, শিশুসহ গৃহকর্মীকেও পাশবিকতা থেকে রেহাই দেওয়া হয়নি। অভিযুক্তরা বিদ্রোহের জন্য অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, নৃশংস হত্যাকাণ্ড, অমানবিক নির্যাতন, বাড়ি ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ, অস্ত্রাগার ও ম্যাগাজিন ভেঙে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুণ্ঠন, গ্রেনেড বিস্ফোরণ, সশস্ত্র মহড়ার মাধ্যমে সন্ত্রাস ও জনজীবনে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি, লাশ গুম, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতা বিনষ্টের চক্রান্তসহ নানাবিধ জঘন্য অপরাধকর্ম সংঘটিত করে।’
আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের পর ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য কিছু লাশ ম্যানহোলের ভেতরে, কিছু লাশ স্যুয়ারেজ লাইনের ভেতর ও অধিকাংশ লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে বিডিআর হাসপাতালের মরচুয়ারিতে ও এমটি গ্যারেজের পাশে গণকবর দেওয়া হয়। সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করেই বিদ্রোহীরা ক্ষান্ত হয়নি। বরং লাশের চেহারা পাল্টে দেওয়ার জন্য মৃতদেহে পেট্রল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। বেয়নেট দিয়ে আঘাত করে লাশের চেহারা বিকৃত করে। আসামিরা সেনা কর্মকর্তা এবং তাদের স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের মৃতদেহের প্রতি কোনও প্রকার শ্রদ্ধা না দেখিয়ে সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসন প্রতিপালন না করে পুরুষ ও নারীদের লাশ অর্ধউলঙ্গ অবস্থায় একসঙ্গে মাটিচাপা দেয়। এমনকি গণকবরের ওপর ইট, কাঠ, গাছপালা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখে ক্যামোফ্লেজ সৃষ্টি করে, যাতে সেখানে গণকবর আছে তা বোঝা না যায়।’
আদালত ২০০৯ সালের এই ট্র্যাজেডির মূল লক্ষ্য বলতে গিয়ে রায় পড়ার সময় উল্লেখ করেন, এর উদ্দেশ্য ছিল সেনা কর্মকর্তাদের জিম্মি করে যে কোনও মূল্যে দাবি আদায় করা, বাহিনীর চেইন অব কমান্ড ধ্বংস করে এই সুশৃঙ্খল বাহিনীকে অকার্যকর করা।
দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করার উদ্দেশ্যে এটি ঘটানো হয়েছিল উল্লেখ করে আদালত বলেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিডিআরকে সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করার চেষ্টা হয়েছিল।’
পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের তথ্য দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ওই সময়ের গোয়েন্দাদের নিষ্ক্রিয়তা তদন্তের মাধ্যমে খুঁজে বের করা উচিত বলে সুপারিশ করেন হাইকোর্ট। আদালত বলেন, ‘কোনও রকম ষড়যন্ত্র ছাড়া এত বড় হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে না।’
তথ্যসূত্র: বাংলা ট্রিবিউন