শেখ নজরুল
ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলা ভাষা চর্চার ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলায় মূলত মুসলিম শাসকরাই বাংলা ভাষা চর্চার পথ উন্মুক্ত করেন। হিন্দু শাসকরা সংস্কৃতকেই তাদের নিজেদের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন সবসময়। পাশাপাশি বাংলা ভাষার উচ্ছেদ-সাধনের সকল প্রচেষ্টাও হিন্দু শাসকরা চালিয়েছেন।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, পাল রাজাদের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই আর্য হিন্দুরা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রায় দুইশত বৎসর ধরে বাংলাদেশ তাদের শাসনাধীন ছিল। কিন্তু এই সময়ের মধ্যেও কি বাংলা ভাষার প্রতি তারা কোনোরূপ দরদ দেখিয়েছে? -মোটেই না। এ সম্পর্কে বহুভাষাবিদ পণ্ডিত ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেনঃ
“আমরা হিন্দু-কালের কোনো বাঙ্গালা সাহিত্য পাই নাই। হিন্দু সেনরাজগণ সংস্কৃতের উৎসাহদাতা ছিল ৷ ব্রাহ্মণেতর ধর্মের সহিত সংশ্লিষ্ট বলিয়াই সম্ভবতঃ তাহারা বাংলা ভাষার প্রতি বিদ্বিষ্ট ছিল।” [বাঙ্গালা ব্যাকরণ]
কোনোরূপ সাহায্য করা তো দূরে থাক, বাংলা ভাষার উচ্ছেদ-সাধনের জন্যই তারা প্রয়াস পেয়েছিল। সুপণ্ডিত ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক ঠিকই বলেছেনঃ
“বাংলার শেষ হিন্দু রাজা ছিলেন লক্ষ্মণ সেন ৷ তাঁহার সভায় ধোয়ী, উমাপতি ধর প্রভৃতি কবি এবং হলায়ুধ মিশ্র প্রভৃতি পণ্ডিত ছিলেন। কিন্তু নানা পণ্ডিত ও কবির সমাবেশে তাহার রাজধানীতে যে সংস্কৃত ভাষা চর্চার ও পাণ্ডিত্য প্রকাশের সাংস্কৃতিক পরিবেশ গড়িয়া উঠে, তাহা জয়দেবের গীত-গোবিন্দের মাধ্যমে সমগ্র উত্তর ভারতে প্রভাব বিস্তার করিলেও বাংলা ভাষা চর্চার কোনো আয়োজন তথায় ছিল না।”
আরও একটি মূল্যবান মন্তব্যও তিনি করেছেনঃ
“১২০৩ খ্রীষ্টাব্দে তুর্কীবীর ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজী লক্ষণ সেনকে লক্ষণাবতী হইতে বিতাড়িত করিয়া বাংলায় সংস্কৃত চর্চার মূলে কুঠারাঘাত হানিয়া বাংলা চর্চার পথ উন্মুক্ত করেন।” [মুসলিম বাংলা-সাহিত্য]
বস্তুতঃ মুহম্মদ বিন বখতিয়ারের হাতে বঙ্গ বিজয় বাংলা ভাষার পক্ষে এক মহামুক্তির দিন । মুসলমানদের দ্বারা বঙ্গ-বিজয় না হইলে আর্যদের হাতে যে বাংলাভাষা লোপ পাইত অথবা শুদ্ধিকৃত হইয়া ভিন্নরূপ ধারণ করিত, তাহাতে কোনই সন্দেহ নাই। সেন রাজাদিগের অল্প পরিসর সময় রেখার মধ্যেই আর্য ব্রাহ্মণগণ আইন করিয়া বাংলা ভাষার উৎখাত সাধনের প্রয়াস পাইয়াছিলেন। তাঁহারা এই নির্দেশ দিয়াছিলেন যে, যদি কোনো আর্য হিন্দু বেদ, পুরাণ, রামায়ন, মহাভারত ইত্যাদি ধর্মশাস্ত্রসমূহ কোনো মানব ভাষায় (অর্থাৎ বাংলা ভাষায়) আলোচনা করে, তবে তাহাকে ‘রৌরব’ নামক নরকদণ্ড ভোগ করিতে হইবে।
“অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চারিতানি চ।
ভাষায়ং মানবঃ শ্রত্বা রৌরবং নরকং ব্ৰজেৎ।”
ইহাই সংস্কৃতের সহিত বাংলা ভাষার প্রথম সংঘাতের ফল।
তথ্যসূত্রঃ
সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, ৪৬ পৃষ্ঠা।
নাজিরুল ইসলাম মোহাম্মদ সুফিয়ান, বাঙ্গালা সাহিত্যের নূতন ইতিহাস, ৪৬-৫০ পৃষ্ঠা।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-মাহবুবুল আলম, পৃষ্টা৩৩।