এহসান রফিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। থাকতেন সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলে। তিন মাস আগে শাখা ছাত্রলীগের সহ সম্পাদক ওমর ফারুক (মার্কেটিং) তার ক্যালকুলেটর ধার নেন। কিন্তু ফেরত দিচ্ছেন না। এহসান ক্যালকুলেটর ফেরত দিতে ফারুককে চাপ প্রয়োগ করে। ফারুক শরণাপন্ন হয় সংগঠনের ‘বড় ভাই’দের। তাদের কাছে ফারুক অভিযোগ করে এহসান শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বড় ভাইরা প্রথমে হলের টিভি কক্ষে এহসানকে নিয়ে যায়। সেখানে তার মোবাইল ও ফেসবুক ঘেঁটে শিবির সংশ্লিষ্টতা না পাওয়ায় নিয়ে যাওয়া হয় হল সভাপতি তাহসান আহমেদ রাসেলের ১৬ নম্বর কক্ষে। এসময় কয়েক দফা মারধরের শিকার হন এহসান। পরে হল সভাপতি তার কক্ষেই ‘সালিশি আদালত’ বসান। বিচার শুরু করেন। বিচারেও এহসানের শিবির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এহসান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে যেতে চাইলে হল গেটে ওমর ফারুকের নেতৃত্বে একদল ছাত্রলীগ নেতাকর্মী আক্রমণ করে। তাদের মারধরে এহসান চোখে মারাত্মক আঘাত পান। ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার চোখের কর্ণিয়া। উন্নত চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকরা তাকে ভারত যাওয়ার পরামর্শ দেন। গত ৭ই ফেব্রুয়ারি এ ঘটনা ঘটে।
শুধু এহসান নয় এভাবে প্রতিনিয়তই ছাত্রলীগের সালিশি আদালতের সামনে দাঁড়াতে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। গত বছর সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে সভাপতি সোহানুর রহমানের এক কর্মী সাধারণ সম্পাদক আসিফ তালুকদারের আরেক কর্মীকে মারধর করে। ঘটনা মীমাংসার জন্য তারা দুইজন হলের গেস্টরুমে আদালত বসিয়েছিলেন। একই বছর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে গেস্টরুমে ছাত্রলীগের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের এক নেতাকে শিবির বলে মারধর করে বের করে দেয়া হয়।
২০১৬ সালের ৪ঠা নভেম্বর হলের যুগ্ম সম্পাদক সারওয়ার হোসেন (বর্তমানে সভাপতি) তার কক্ষে আদালত বসিয়ে ৩০ জন শিক্ষার্থীকে হল থেকে বের করে দেন। একই বছরের ২রা মার্চ সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে হাফিজ মোল্লা নামে এক শিক্ষার্থী নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার পরিবারের অভিযোগ, শীতের দিনে ঠাণ্ডার মধ্যে গভীর রাত পর্যন্ত বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখায় সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। সালিশি বিচার ছাত্রলীগ নেতার কক্ষ ছাড়াও হলের গেস্টরুমে হয়। এসব সালিশের সিদ্ধান্তই আবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য চূড়ান্ত। সিদ্ধান্ত না মানলেই নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন।
আদালত বসানোকে শিক্ষার্থীরা ‘গেস্টরুম’ হিসেবে অভিহিত করে। প্রায় প্রতি রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে গেস্টরুম বসে। গেস্টরুমগুলো ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপের সিনিয়রদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। সেখানে তারা নবীন শিক্ষার্থীদের আচরণ শেখানোর নামে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে। ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে অংশ নিতে বাধ্য করানো হয়। হলে ওঠানো ও হল থেকে বের করে দেয়া নিয়ন্ত্রিত হয় এই গেস্টরুম থেকে। গেস্টরুমে নবীন শিক্ষার্থীদের আসা বাধ্যতামূলক। কেউ না আসলে তাকে দিতে হয় চড়া মাশুল।
গেস্টরুমে কী শেখানো হয় জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূর্যসেন হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, রাজনৈতিক বড় ভাইকে সালাম দিয়ে হাত মেলানো, হ্যান্ডশেক করার সময় বড় ভাইয়ের হাতে চাপ না দেয়া, হ্যান্ডশেকের সময় বাঁ হাত পেছনের দিকে রাখা, বড় ভাইদের সামনে না হাসা, ক্যান্টিন ও পাঠকক্ষে জ্যেষ্ঠদের আসনে না বসা, দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের না জানিয়ে সিনিয়রদের কাছে বিচার না দেয়া।
এসব না করলে কী হয় জানতে চাইলে কবি জসীম উদ্দীন হলের এক শিক্ষার্থী জানান, এগুলো ঠিকমতো না করলে সিনিয়ররা মা-বাপ তুলে গালি দেয়। জোর গলায় ধমক দেয়। মাঝে মাঝে হল থেকেও বের করে দেয়। তবে গেস্টরুমে নির্যাতন করা হয় না বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন প্রিন্স। তিনি বলেন, হলের গেস্টরুমে কোনো শিক্ষার্থীকে নির্যাতন করা হয় না। সেখানে সিনিয়ররা জুনিয়রদের বিভিন্ন ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেন। শাসন করেন যেন সেগুলো জুনিয়ররা সংশোধন করে নেয়।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় ও হল প্রশাসন ছাত্রলীগের এমন কর্মকাণ্ডের বিষয়ে অবগত থাকলেও কোনো পদক্ষেপ নেন না। কোনো শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রশাসন তদন্ত কমিটি করেই তাদের দায় সারেন। কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী বলেন, কোনো হলে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের গেস্টরুমে নিয়ে নির্যাতনকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কখনো প্রশ্রয় দেবে না। আমরা যখনই শুনেছি, তখনই ব্যবস্থা নিয়েছি। তবে তিনি সুনির্দিষ্টভাবে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেননি। এছাড়াও সাম্প্রতিক ঘটনাটিসহ গেস্টরুমের কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বন্ধে আমরা হল প্রাধ্যক্ষদের সঙ্গে কথা বলছি, আরো বলবো। এটা কোনো ভাবেই গ্রহণ করা হবে না।
সূত্র: মানবজমিন