বাংলাদেশের ঢাকা উত্তর সিটি উপ-নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কমিশনের কাজে এটি প্রমাণ হয় যে তারা সরকারের উদ্দেশ্য বা সরকারের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করেছে। রেডিও তেহরানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে একথা বলেছেন সাপ্তাহিকের সম্পাদক, বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও উপস্থাপক গোলাম মোর্তজা।
তিনি আরো বলেন, নির্বাচনের ব্যাপারে আইনগত ফাঁক-ফোকর রেখে তফসিল ঘোষণার ক্ষেত্রে সরকারের একধরনের সায় ছিল অর্থাৎ নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক এটা যে সরকার চায় নি সেটা বলার মতো যথেস্ট যৌক্তিক কারণ আছে।
পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো। এটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
রেডিও তেহরান: জনাব গোলাম মোর্তজা, ঢাকা উত্তর সিটি উপ-নির্বাচন স্থগিত করেছে দেশের হাইকোর্ট। যে প্রেক্ষাপটে নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে তাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
গোলাম মোর্তজা: দেখুন, বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসকে যদি আমরা পর্যালোচনা করি তাহলে দেখা যায় একটি নির্বাচনী আসনে নতুন কিছু এলাকা সংযোজন করা হলে বা একটি এলাকাকে ভাগ করে নতুন কোনো একটি এলাকার সাথে সংযুক্ত করা হলে বা বাদ দেয়া হলে সেখানে একটা আইনি জটিলতা দেখা দেয়। আর এ ধরনের জটিলতা দেখা দিলে কোনো একজন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি যদি আদালতে যান তাহলে সাধারণত নির্বাচন প্রক্রিয়া একটা সাময়িক সময়ের জন্য স্থগিত করা হয়। এরকম ইতিহাস আমাদের দেশে অনেক আছে। আর সেই বিবেচনা থেকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপনির্বাচনের প্রসঙ্গটি যখন সামনে আসল এবং সেখানে যেহেতু নতুন ১৮ টি ওয়ার্ডকে সংযুক্ত করা হয়েছে আর সেই জায়গার হালনাগাদ ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়নি তখনই এ বিষয়টি নিয়ে আশঙ্কার কথাটা আমরা প্রকাশ করলাম। আমরা বলার চেষ্টা করলাম ভোটার তালিকা সম্পন্ন না করে যদি নির্বাচনের কথা বলা হয় তাহলে সেই নির্বাচন ঠিক সময়ে হবে না। নির্বাচনের বিরুদ্ধে রিট হবে এবং তা আটকে যাবে।
আমরা বিস্ময়করভাবে লক্ষ্য করলাম আমাদের এবং গণমাধ্যমের এই আলোচনাকে কোনোরকম গুরুত্ব না দিয়ে আইনগত জটিলতাকে বজায় রেখেই নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করল। আর তখনই আমাদের সেই আশঙ্কার জায়গাটি আরো স্পষ্ট হলো যে আদৌ ঠিক সময় নির্বাচন হবে কী না! ঠিক তাই হলো। নির্বাচন স্থগিত হয়ে গেল। এক্ষেত্রে আদালতের রায় নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই –কারণ এধরনের রিটে নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়। অতীতেও অনেকবার এধরনের ঘটনা ঘটেছে। আদালতের পক্ষ থেকেই এটাই করার কথা ছিল বলে আমি মনে করি।
রেডিও তেহরান: ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয় নি -এমন অভিযোগ এনে রিট করা হয় এবং হাইকোর্ট তার পক্ষে আদেশ দিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে- নির্বাচন কমিশন বিষয়টি না জেনেই তফসিল ঘোষণা করেছে? নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
গোলাম মোর্তজা: যদি নির্বাচন কমিশন আইনগত দিকটি না বুঝেই তফসিল ঘোষণা করে থাকে তাহলে বুঝতে হবে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য যে যোগ্যতা, সামর্থ্য,দক্ষতা এবং আইনগত জানার বিষয় থাকে সেটি বর্তমান কমিশন এবং কমিশনারদের নেই। এ বিষয়টি প্রমাণ হয়ে যায়।
অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন যদি জেনে বুঝে অর্থাৎ আইনগত জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে, রিট হতে পারে এসব জেনেই তফসিল ঘোষণা করে থাকে তাহলে বুঝতে হবে নির্বাচনটি না হোক এমটি যারা চায় তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য তফসিল ঘোষণা করেছিল নির্বাচন কমিশন। এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন সামনে আসবে সেটি হচ্ছে জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকার ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপনির্বাচন চায় না। আর সরকার জাতীয় নির্বাচনের আগে ডিএনসিসির উপনির্বাচন চায় না এরকম একটি প্রচারণাও ছিল আগ থেকেই। আর এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনের কাজের মধ্য দিয়ে এটি প্রমাণ হয় যে তারা সরকারের উদ্দেশ্য বা সরকারের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করেছে। আর সরকার নির্বাচন চাইবে না কেন সে প্রশ্ন খুব স্বাভাবিকভাবে আসবে।
এ বিষয়ে বলা যেতে পারে, সরকার হয়তো মনে করেছে এ মুহূর্তে ডিএনসিসির উপনির্বাচন হলে ফলাফল সরকারের পক্ষে বা আওয়ামী লীগের অনুকূলে নাও আসতে পারে। আর সেই ভাবনা থেকে জাতীয় নির্বাচনের বছরে সরকার এমন একটি নির্বাচন করতে চায় নি যে নির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ হবে। একইসঙ্গে নির্বাচনে পরাজিত হবে এমনটিও চায় নি সরকার। এ দুটো বিষয় ছিল সরকারের সামনে। এ দুটো বিষয়ের বিবেচনায় সরকারের জন্য সবচেয়ে ভালো পথ ছিলো যাতে করে নির্বাচনটি না হয়। প্রশাসক দিয়ে বা প্যানেল মেয়র দিয়ে যদি আাগামী জাতীয় নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এটি চালিয়ে নেয়া যায়। আমরা দেখলাম সেরকমই একটা ঘটনা ঘটল। তবে একথা আমি বলছি না যে নির্বাচন কমিশনকে সরকার বুদ্ধি দিয়ে এ কাজটি করিয়েছে কিন্তু নির্বাচন কমিশনের কাজের মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণ হয়েছে সরকার চেয়েছে বলেই নির্বাচন কমিশন জেনে-বুঝে এভাবে তফসিল ঘোষণা করেছিল।
রেডিও তেহরান: নির্বাচন কমিশনের ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দিন আহমদ বলেছেন, আইনি বিষয়গুলো পর্যালোচনা করেই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো বাধা নেই। তাদের এ বক্তব্য কতটা সঠিক?
গোলাম মোর্তজা: দেখুন, নির্বাচন কমিশনের ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দিন আহমদের বক্তব্য সঠিক হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ নির্বাচন কমিশন দৃশ্যমানভাবে ভোটার তালিকা প্রকাশ করে নি। আর ভোটার তালিকা প্রকাশ না করেই যদি নির্বাচন কমিশন বলে ভোটের কোনো আইনগত বাধা নেই এবং তফসিল ঘোষণা করে দিল সেটা তো ঠিক নয়। আমরা তো কোনোভাবেই একথা বলতে পারি না যে হাইকোর্ট নির্বাচন স্থগিত করে কাজটি ঠিক করে নি। হাইকোর্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে নির্বাচনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে এবং স্থগিত করেছে। আর যেহেতু নির্বাচন কমিশনের ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দিন আহমদ বলেছেন নির্বাচনে আইনগত কোনো বাধা নেই-তাহলে সেটা তারা আদালতে প্রমাণ করতে পারলেন না কেন? আর যেহেতু আদালতে প্রমাণ করতে পারেন নি ফলে বুঝতে হবে সচিব যা বলছে তা ঠিক নয়; আদালত যা করেছে সেটাই সঠিক।
রেডিও তেহরান: বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেছেন, ‘সরকার জানত, তারা এ নির্বাচনে হেরে যাবে, তাই তারা সুযোগ নিয়েছে।’ মির্জা ফখরুলের এ বক্তব্য কতটা গ্রহণযোগ্য?
গোলাম মোর্তজা: দেখুন, মির্জা ফখরুলের বক্তব্যটি বিএনপির অবস্থান থেকে তাদের একটি রাজনৈতিক বক্তব্য। যেহেতু বিরোধী দলে থাকলে একটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা যায় বিএনপি এখন সেরকম একটি সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। যেহেতু বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা এবং নানাকারণে এই মুহুর্তে ঢাকায় নির্বাচন হলে বিএনপির জেতার সম্ভাবনা ছিল বলে বিএনপি মনে করে। আমরাও তাই মনে করি যে বিএনপির একটি ভালো সম্ভাবনা ছিল। আর সেই জায়গায় যখন নির্বাচন স্থগিত হয়ে গেল সেখানে বিএনপির রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়ার মতো একটা অনুকূল পরিবেশ আছে বলেই মির্জা ফখরুল এই বক্তব্য দিলেন।
রেডিও তেহরান: জনাব গোলাম মোর্তজা, মিডিয়ার বিভিন্ন খবরে দেখা যাচ্ছে ডিএনসিসিরি উপনির্বাচন স্থগিতে সরকারি দল আওয়ামী লীগ বিএনপিকে দায়ি করছে আবার বিএনপি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ করছে। উভয় দলের মধ্যে এই পাল্টাপাল্টি অভিযোগ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
গোলাম মোর্তজা: দেখুন, গ্রহণযোগ্যতা বা যুক্তি থাক বা না থাক পাল্টাপাল্টি অভিযোগ আমাদের রাজনীতির একধরনের সংস্কৃতি হয়ে গেছে। আর ডিএনসিসির উপ নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কে রিট করল সেটা আসলে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। আইনগত ফাঁক রেখে তফসিল ঘোষণা করাটাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আর সেই কাজটি করেছে নির্বাচন কমিশন। এছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কেবলমাত্র নির্বাচন কমিশন না সরকারের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। নির্বাচনের ব্যাপারে আইনগত যে ফাঁক রয়ে গেছে সরকার বা স্থানীয় সরকার সে সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনকে কিছু বলে নি। আর সরকার কিছু না বলার কারণে এটা বোঝা যায় এরকম ফাঁক-ফোকর রেখে তফসিল ঘোষণার ক্ষেত্রে সরকারেরও একধরনের সায় ছিল অর্থাৎ নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক এটা যে সরকার চায় নি সেটা বলার মতো যথেস্ট যৌক্তিক কারণ আছে।
রেডিও তেহরান: সবশেষে জানতে চাইব- দু দলের প্রার্থী ঘোষণার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয়ের চেয়ে অর্থ-পরিচিতি গুরুত্ব পেয়েছে বলে অনেকেই অভিযোগ তুলেছেন। তারা বলছেন, দেশে অর্থের কাছে রাজনীতি পরাজিত হচ্ছে। আপনার মন্তব্য কী?
গোলাম মোর্তজা: দেখুন, এটি নতুন নয়; বহু বছর ধরে এমনটি হচ্ছে এবং পর্যায়ক্রমে এটি বাড়ছে। আর বাড়ার বড় কারণ হচ্ছে আমাদের রাজনীতি থেকে আদর্শের ব্যাপারটা কমে গেছে। রাজনীতির মাধ্যমে- রাজনীতিবিদরা টাকা-পয়সা আয় করে এবং তারা নীতি-নৈতিকতাকে গুরুত্বহীন করে দিয়েছে সে কারণে আমাদের রাজনীতিতে ক্লিন ইমেজের নেতা আসছে না। আর ক্লিন ইমেজের নেতা না থাকার কারণে বা কমে যাওয়ার কারণে স্পর্শকাতর জায়গাগুলোতে রাজনৈতিক দলের মধ্য থেকে ক্লিন ইমেজের নেতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সে কারণে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোর নির্বাচনে প্রতিটি রাজনৈতিক দল ক্লিন ইমেজের প্রার্থী খোঁজার চেষ্টা করছেন। আর যেহেতু দলের ভেতর থেকে ক্লিন ইমেজের প্রার্থী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সে কারণে বাইরে থেকে ব্যবসায়ীদের হায়ার করা হচ্ছে।
এখানে একটি বিষয় হলো ক্লিন ইমেজে আর অন্য বিষয়টি হচ্ছে রাজনীতিতে বর্তমানে অর্থের একটি ভয়ংকর প্রভাব তৈরি হয়েছে। এখন নির্বাচন করতে হলে অনেক টাকা খরচ করতে হয়। আর রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু টাকা খরচ করে নির্বাচন করে সেক্ষেত্রে যাদের প্রভাব আছে; যাদের টাকা আছে তারা নিজেরা টাকা ব্যয় করে নির্বাচন করেন এবং অন্য নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য দলকে টাকা দেন। সে কারণে বাংলাদেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল অর্থের কাছে একধরনের আত্মসমর্পন করেছে। নীতি-আদর্শের কাছে নতি স্বীকার করে তারা এখন বিত্তবানদেরকে খুঁজে বের করে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতে নমিনেশন দিচ্ছে। সাধারণভাবে রাজনীতির জন্য এটা খারাপ দিক।
অন্যদিকে সাধারণ মানুষের জন্য একটা ইতিবাচক দিক হয়তো থাকতে পারে। সেটি হচ্ছে- ধরুন আতিকুল ইসলাম একজন যোগ্য ব্যবসায়ী। তাকে যখন নমিনেশন দেয়া হয় তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন একটা অবস্থা তৈরি হয় যে আতিকুল একজন ভদ্র মানুষ ও যোগ্য ব্যবসায়ী ফলে তিনি নির্বাচিত হলে হয়তো দুর্নীতি করবেন না। তিনি ঢাকা শহরের মানুষের জন্য কাজ করবেন যেমনটি আনিসুল হক করেছিলেন। তাবিথ আউয়ালের ক্ষেত্রেও সেই একই ভাবনা মানুষের মধ্যে। কিন্তু পুরো প্রক্রিয়াটি রাজনীতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। রাজনীতিবিদরা হয়তো এখন বিষয়টি বুঝতে পারছেন না আগামী দিনে যখন বুঝবেন তখন আদৌ কিছু করার থাকবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
সূত্র: পার্সটুডে