অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
আবারো আলোচনায় আসছে ২০০১ সালে কথিত ধর্ষণের শিকার হওয়া সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার সেই পূর্ণিমা রাণী শীল। ১৭ বছর পর বিষয়টি আবার সামনে এনেছেন সরকারের তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। সম্প্রতি প্রতিমন্ত্রী তারানা তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে পূর্ণিমা রাণী শীলকে নিয়োগ দিয়েছেন। তারানা হালিমের এ উদ্যোগকে অনেকেই স্বাগত জানিয়েছেন।
তবে, বিতর্ক দেখা দিয়েছে প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমের দেয়া বক্তব্য নিয়ে। পূর্ণিমা রাণী শীল বিএনপি-জামায়াতের লোকদের দ্বারা ২০০১ সালের ৮ অক্টোবরে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে তারানা হালিম তাকে ব্যক্তিগত পিও হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। তারানার এ বক্তব্য নিয়ে এখন বিতর্ক চরমে। কারণ, পূর্ণিমার কথিত ধর্ষণের ঘটনাটি নিয়ে তখনই বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল।
২০০১ সালের ৮ অক্টোবর সন্ধ্যার পর পূর্ণিমার বাবা, ভাই ও তাকে পারিবারিক বিরোধ থেকে কিছু লোক মারধর করেছিল। এ ঘটনার পর এলাকার একজন ডাক্তার তাদেরকে প্রাথমিক চিকিৎসাও দেয়। ওই সময় পূর্ণিমা ধর্ষণের কোনো অভিযোগ করেনি। এক সপ্তাহ পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও ঢাকার ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির লোকদের সঙ্গে গোপন বৈঠকের পর হঠাৎ পূর্ণিমা একদিন অভিযোগ করলেন তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এ ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসনও তখন তাজ্জব বনে যায়।
এর আগে পূর্ণিমার বড় বোন রেখা রাণী শীলকে দিয়েও তার পরিবার একটি ধর্ষণের ঘটনা সাজিয়েছিল। তদন্তের পর অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলে ১৩ হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে ঘটনার নিষ্পত্তি ঘটায়। পূর্ণিমা রাণী শীলের ধর্ষণ ঘটনা শুনার পর তখন লোকজন বলছিল এটাও তার বোনের ধর্ষণের ঘটনার মতোই সাজানো ধর্ষণ।
পূর্ণিমা রাণীর ধর্ষণের ঘটনা যে সাজানো ছিল এনিয়ে তখন বিভিন্ন গণমাধ্যমে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ২০০১ সালের ১৫ নভেম্বর দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় ‘‘পূর্ণিমার জবানবন্দি’’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। অ্যানালাইসিস বিডির পাঠকদের জন্য সেই প্রতিবেদনের কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলোঃ
“উল্লাপাড়া পুলিশ প্রশাসন অনিল চন্দ্র শীলের কন্যা অপহরণ ও ধর্ষণের দুই নম্বর অভিযোগ নিয়ে অনেকটা দিশেহারা অবস্থায় রয়েছে। স্থানীয় পুলিশ কর্তাদের বক্তব্য, পূর্বদেলুয়া গ্রামের অনিল চন্দ্র শীলের কন্যাদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ নতুন নয়। বিগত সরকারের আমলেও ঐ ধরণের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
১৯৯৮ সালের ৬ জুলাই অনিল চন্দ্রের স্ত্রী বাসনা রাণী বাদী হয়ে তার অপর এক কন্যা রেখা রাণী শীলকে অপহরণ ও ধর্ষণের চেষ্টা হয়েছে উল্লেখ করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আইনে থানায় মামলা করেন। কিন্তু পরে ঐ অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল হয়। বাসনা রাণীও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তার বক্তব্য, মারামারির একটা মামলায় আমাদের সবাইকে আসামি করা হয়েছিল। তার কাউন্টার হিসেবেই ঐ মামলা। পরে মামলা না টিকলে অপর পক্ষের চিকিৎসা খরচ বাবদ ১৩ হাজার টাকা দিয়ে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলি।
পুলিশের ভাষ্য, পূর্ণিমা রাণী শীল ঘটনার ৮ দিন পর সিরাজগঞ্জ জেলা সদরে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ১৬৪ ধারায় তার ওপর পাশবিক নির্যাতনের জবানবন্দি দিয়ে আসবে তা ছিল আমাদের কাছে অকল্পনীয়। থানার একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আমার দীর্ঘদিনের পেশাগত জীবনে অনেক ধর্ষণের মামলার তদন্ত করেছি। কিন্তু এ ধরণের অদ্ভুত অভিযোগের কথা আগে কখনো শুনিনি। কয়েকজন মিলে তাদের লাম্পট্য চরিতার্থ করছে আর তাদের বড় ও ছোট ভাইয়েরা এবং অন্যান্য নিকট আত্মীয়স্বজন মেয়েটিকে ধরে রাখছে, আবার এই অপকর্মের জন্য পূর্ব পরিকল্পিতভাবে কনডমের ব্যবহার হচ্ছে-এতোটা কি সম্ভব?
আরেক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ঘটনার পর দিনই সিরাজগঞ্জের এএসপি সার্কেল নূর হোসেন স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে পূর্বদেলুয়াতে অনিল চন্দ্র শীলের বাড়ি পৌছেছিলেন।ঐ সময় ভিকটিম বা তার অভিভাবকদের কেউ অপহরণ বা ধর্ষণের কথা বলেনি। এরপর ১০ অক্টোবর উল্লাপাড়া থানায় অনিল চন্দ্র শীল একটি এজেহার দায়ের করেন। তার ছেলে গোপাল চন্দ্র শীলের লেখা এজেহারে পূর্ণিমা রাণীকে ধর্ষণ করা হয়েছে এমন কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি।বলা হয়েছে, গ্রামের লোকজন এগিয়ে আসতে থাকলে আসামিরা পালিয়ে যাওয়ার সময় আমার মেয়েকে জোরপূর্বক টানাহেচড়া করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আকবর মেম্বরের হস্তক্ষেপের কারণে আসামিরা পূর্ণিমাকে নিয়ে যেতে পারেনি।
এডিএম শেখ আব্দুল আহাদ নিজে পূর্বদেলুয়ারে এসে অনিল চন্দ্র শীল, বাসনা রাণী ও পূর্ণিমার কাছে ঘটনা জানতে চান। কিন্তু তারা কেউ তখন ধর্ষণের কথা জানাননি। ১০ অক্টোবর উল্লাপাড়া সদর হাসপাতালে ভর্তির সময়েও পুর্ণিমাকে তার ভাষা অনুযায়ী মারপিটের মাধ্যমে আহত রোগী হিসেবে ভর্তি করা হয়। ঐ সময়ও এডিএম শেখ আব্দুল আহাদ পূর্ণিমাকে কিছু ঘটে থাকলে তা নির্ভয়ে বলার অনুরোধ জানান। কিন্তু ১১ অক্টোবর সকাল পর্যন্ত পূর্ণিমার ভাষ্য ছিল, ওসব কথা আমাদের মানসম্মান ক্ষতি করার জন্য রটানো হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট প্রশাসন সূত্র জানায়, পূর্ণিমা অস্বীকার করার পরও প্রশাসনের কাছে খবর আসে একটি বিশেষ মহল পূর্ণিমাকে দিয়ে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে ঘোরানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছে। ঢাকা থেকে সন্দেহভাজন লোকজনের উপস্থিতি বাড়ছে। এডিএম ঐ পরিস্থিতিতে উল্লাপাড়া থানার ওসি আবুল হোসেন মোড়লকে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দেন। সন্দেহভাজন লোকজন যাতে পূর্ণিমাকে যাতে কোনোভাবে প্রলুব্ধ করতে না পারে। কিন্তু এতে কোনো কাজ হয়নি। ১০ অক্টোবর সারারাতই পূর্ণিমার সঙ্গে কথা বলা অব্যাহত থাকে। পরদিন সকাল পৌনে ১১ টার দিকে পূর্ণিমা হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. আব্দুস সামাদকে বলেন, আমাকে ধর্ষণ করা হয়েছে।
পরে পুলিশের কাছে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে পূর্ণিমা বলেছে, ৮ অক্টোবর সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টার দিকে তার বাবা-ভাইয়ের জন্য ভাত নিয়ে যাওয়ার পথে ১০/১৩ জন তাদের ওপর হামলা করে। পাশের ইসমাইল পুলিশের বাড়ির কলাঝারে আশ্রয় নেয়। যুবকেরা টর্চ লাইট দিয়ে তাকে খুজতে থাকলে সে পুলিশের বউয়ের কাছে আশ্রয় চায়। কিন্তু পুলিশের বউ তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। ঐ যুবকেরা তাকে ধরে নিয়ে পাশের হাটের পাশে একটি কচুক্ষেতে নিয়ে জামা খোলে একের পর এক সবাই ধর্ষণ করে। তারা তখন কনডম ব্যবহার করে। ওই সময় সাধন, অসীম ও আকবর মেম্বর ঘটনার জায়গায় আসে এবং আমাকে বাচায়। এরা উলঙ্গ অবস্থায় আমাকে বাড়ি নিয়ে আসে। আমার প্যান্ট ও ওড়না পাওয়া যায়নি।
এদিকে উদ্ধারকারী হিসেবে পূর্ণিমা যাদের নাম বলেছে তাদের কাছে তার বক্তব্যের সমর্থন মিলছে না। পূর্ণিমার গৃহশিক্ষক সাধণের ভাষ্য, আমি একটু পরে গিয়েছি। আকবর যখন তাকে নিয়ে আসে তখনই আমি তাদের বাসার কাছে পৌছাই। পূর্ণিমাকে তখন উলঙ্গ অবস্থায় পাওয়া গেছে এ তথ্য সঠিক নয়।
সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য ওয়াসীমের ভাষ্য, চিল্লাচিল্লি শুনে আমরা দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যাই। পূর্ণিমাকে ওদের বাড়ির গেটের কাছেই আকবর মেম্বরের সাথে বাসায় ঢুকতে দেখি। তার ওপর কোনো অত্যাচার হয়েছে বলে তখন আমার মনে হয়নি।
আর আকবর মেম্বরের ভাষ্য, অনিলের বাড়ির কিছু পশ্চিমে বেল্লালের বাড়িতে বসে আমি টিভি দেখছিলাম। তখন ৭টা বাজে। ওই সময় হৈ হুল্লা শুনে আমি বেরিয়ে আসি।দেখতে পাই পাড়ার ছেলেদের সাথে অনিলের বউ ও মেয়েরা মারামারিতে লিপ্ত। আমি ছেলেদের ধমক দিলে অনেকে ভেগে যায়। পূর্ণিমার হাতে এসময় চিকন কতগুলো কঞ্চি দেখি। ঐ কঞ্চি দিয়ে সে ছেলেদের সাথে মারামারি করছিল। কঞ্চিগুলো কেড়ে নিয়ে তাকে তার বাড়ির দিকে নিয়ে যায়। ঐ সময় ওয়াসীম এবং গ্রামের আরও অনেকেই ছিলেন। অনিলের বউ কেঁদে বলছিল দেখ কি রকম মাইর দিছে।
আর ইসমাইল পুলিশের বউ সুফিয়ার ভাষ্য, পূর্ণিমা আমার কাছে এসে আশ্রয় চেয়েছে এ তথ্য সঠিক নয়। ওদের কেউ আমাদের বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরে আসে না।”
মানবজমিন পত্রিকার এই প্রতিবেদন থেকে বিষয়টি একেবারেই পরিষ্কার যে পূর্ণিমা রাণী শীলের ধর্ষণের ঘটনাটি ছিল একেবারেই সাজানো ও পরিকল্পিত।
এছাড়া ২০০১ সালের ১১ নভেম্বর দৈনিক দিনকাল পত্রিকায় ‘‘উল্লাপাড়ায় পূর্ণিমা রাণী শীল ধর্ষণের ঘটনা: নানা মুখে নানা কথা’’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, “১১ অক্টোবর পূর্ণিমা রাণী শীল হাসপাতালের আবাসিক ডাক্তারকে ধর্ষণের কথা জানানোর পরই ডা. আব্দুস সালাম তাকে ছাড়পত্র দিয়ে সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তির জন্য পাঠান। কিন্তু হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসার পরই নিখোঁজ হয়ে যায় পূর্ণিমা রাণী শীল। বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করেও পুলিশ তাকে পায়নি। পরে ১৩ অক্টোবর শ্যামলীপাড়াস্থ গনেশ চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে পূর্ণিমাকে উদ্ধার করা হয়। এরপর তাকে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়। ১৬ অক্টোবর সিভিল সার্জনের নিকট রিপোর্ট পেশ করে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, পূর্ণিমার যৌনাঙ্গে ক্ষতের চিহ্ন রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের যোগসাজশে ঢাকা থেকে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতৃবৃন্দ পূর্ণিমা রাণী শীল ও তার পরিবারকে ঢাকায় নিয়ে আসে ও সংবাদ সম্মেলন করে। এছাড়া ধর্ষণের স্বপক্ষে প্রমাণের জন্য সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতালের ডা. আব্দুল আউয়ালের যোগসাজশে কৃষক লীগ নেতা খোরশেদ আলমের তত্ত্বাবধানে পূর্ণিমাকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।”
২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে চরম ভরাডুবির পর বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোট সরকারকে ঘায়েল করার জন্য আওয়ামী লীগ তখন সংখ্যালঘু ট্রাম্প কার্ড হাতে নিয়েছিল। নিজেরাই হিন্দুদের বাড়িঘর দখল, ভাঙচুর ও নারীদের ধর্ষণ করে প্রতিবেশ দেশ ভারতসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বলতো যে বিএনপি-জামায়াত সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে।
প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম তার পিও সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার পূর্ণিমা রাণী শীলের যে ধর্ষণের কথা বলেছেন, এটাও ছিল তাদের পরিকল্পনারই অংশ। পরিকল্পিতভাবেই একজন নির্দোষ মেয়েকে তারা ধর্ষিতার খেতাব নিতে বাধ্য করেছে।