হাসান রূহী
গতকাল সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ভারতের প্রাক্তন গরুবাদী রাষ্ট্রপতি প্রণব মূখার্জীর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা এদেশের একদল মানুষের গ্রুপ ছবি ভাইরাল হয়েছে। আশাব্যঞ্জক ঘটনা হলো এই ছবিটি পোস্ট করে কাউকেই ইতিবাচক কোন মন্তব্য করতে দেখিনি। বরং ভারতের মাত্রাতিরিক্ত আগ্রাসনের বিরুদ্ধেই ছিল তাদের ক্ষোভ।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি যে ভারতীয় অযাচিত হস্তক্ষেপ করেছেন, তিনি এই প্রণব বাবু। এমনকি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের পেছনে তার কতবড় কারসাজি রয়েছে তার কিয়দংশ তিনি নিজেই স্বলিখিত বইয়ে তুলে ধরেছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত আত্মজীবনীমূলক লেখা বই ‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস ১৯৯৬-২০১২’-এ বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের নানা বিষয় তিনি অনেকটা খোলামেলাই আলোচনা করেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতির অনেক সঙ্কটপূর্ণ সময়ে তার বিতর্কিত ভূমিকা ও অবস্থানের কথা কোনো রাখঢাক না রেখেই তুলে ধরেছেন। তাতে দেখা যায় বাংলাদেশে বর্তমানে সংবিধান, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও রাজনৈতিক সঙ্কটের পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে, তার নেপথ্যে প্রণব বাবুই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন।
হয়তো ভাবছেন কেন আমি শুধু শুধুই প্রণব বাবুকে দোষ দিচ্ছি! কেন তাকে চিত্রায়িত করছি সঙ্কট সৃষ্টির মূলহোতা হিসেবে? তার জবাব তিনি তার আত্মজীবনীতেই লিখেছেন। তিনি লিখেছেন “শেখ হাসিনা যখন কারাবন্দি তখন বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা তাকে ছেড়ে চলে যান। তাদের অনেকেই পরে যখন আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন, আমি তাদের বলি, যখন কেউ বিপদে পড়ে তখন তাকে পরিত্যাগ করা অত্যন্ত অনৈতিক কাজ। আমি তাদের ভর্ৎসনা করি। এটা ঠিক, শেখ হাসিনা আমাদের পরিবারের অত্যন্ত নিকট বন্ধু। আমি যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হই তখন বাংলাদেশের সাহায্য করার জন্য অনেক উদ্যোগ নিই এবং আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করানোর জন্য কূটনৈতিক চাপ তৈরি করি। ২০০৮ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো এবং শেখ হাসিনা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী হলেন। এরপর শেখ হাসিনা ২০১০ সালে ভারতে আসেন এবং তার সফর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এক মাইলফলক বলে স্বীকৃত হয়ে রয়েছে।”
এতো তিনি তার কর্মকান্ডের শেষ দিকের কথা তুলে ধরেছেন। কিন্তু এর আগের অনেক কথাই রয়ে গেছে আড়ালে। তবে এটুকু তো বলাই যায়, মইন উ আহমেদকে ভারতে ডেকে নিয়ে ২০০৮ সালের যে হাইব্রিড নির্বাচনের আয়োজন করা হয়েছিল তার পেছনে পুরো কারসাজি ছিল এই প্রণব বাবুর। আর এ পর্যন্ত আনতে এবং বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরে বাংলাদেশের রাজপথ রঞ্জিত করে রাজনৈতিক সঙ্কটের বীজ বপন করা হয়েছিল তা জাতির কাছে এখন অনেকটাই স্পষ্ট। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব ছিল ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করা, সেই তাদেরকে দিয়েই বিভিন্ন বিতর্কিত কাজ করিয়ে ২ বছর অবৈধভাবে ক্ষমতায় রেখে হাইব্রিড নির্বাচনের জন্ম দেয়া হয়। এরপর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির কলঙ্কিত নির্বাচনে সারা বিশ্বকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কিভাবে প্রণব বাবুরা নির্লজ্জভাবে সমর্থন জানিয়েছিল তাও দেশের মানুষ দেখেছে।
দেশের মানুষ আরও দেখেছে ভারতের স্পন্সরে বাংলাদেশে পরিচালিত ‘আমি খাড়াইয়া যামু, আপনি বসাইয়া দেবেন’ মার্কা বিচার। যে বিচারের নামে মিথ্যাচার করে হত্যা করা হয়েছে এদেশের রাজনীতিতে আদর্শ উপস্থাপনকারী এক ঝাঁক মেধাবী, নৈতিকতা সম্পন্ন, আগ্রাসনবিরোধী সাহসী নেতৃত্ব। দেখেছে কিভাবে এদেশ থেকে গুম করে নিয়ে মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী সুখরঞ্জন বালী, তুখোড় রাজনীতিক সালাহ উদ্দীন আহমেদের মত ব্যক্তিদেরকে বছরের পর বছর ভারতে বন্দী করে রাখা হয়েছে।
সম্প্রতি সেই কুচক্রী প্রণব বাবুর বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে এদেশের কিছু রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের আসল চেহারা। প্রভূভক্ত হয়ে আবেগে গদগদ ভঙ্গিতে ছবি তুলতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে এসব চেহারা। আর সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে তাই ক্ষোভের প্রকাশ করেছে তরুণ প্রজন্ম। ঘৃণা প্রকাশ করেছে এই লাঞ্ছনাকর ছবি নিয়ে। অবশ্য এ ফটোশুটে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুলকেও অনেকটা নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করতে দেখা গেছে।
একটি দেশকে ধ্বংস কিংবা করতলগত করতে সেদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রন করা খুব বেশী জরুরী। আর প্রণব বাবুর হাত ধরে ভারত সে কাজটি করেছে বেশ দক্ষতার সাথেই। প্রশ্ন হচ্ছে প্রণব বাবুর পেছনে অবস্থান নেয়া রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের হাতে দেশ থাকবে? নাকি এদেশের তরুণ প্রজন্ম দেশ রক্ষার জন্য আরও একবার এগিয়ে আসবে? যদি এদেশের তরুণ প্রজন্ম বাবুদের পাঠানো ফেনসিডিলের বোতল ছেড়ে দেশ রক্ষায় মনযোগী হয়ে ওঠে, আর শুধু ভার্চুয়াল জগতে ক্ষোভ প্রকাশ করেই দায়িত্ব শেষ না করে, তবে প্রণব বাবুদের রাহুগ্রাস থেকে এখনও মুক্তি সম্ভব। অন্যথায় সিকিমের মতই ইতিহাস হয়ে থাকবে এ ছোট্ট মানচিত্র। ফিকে হয়ে যাবে লাল সবুজের গৌরব।
লেখক: ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট