মাসুদ মজুমদার
৫ জানুয়ারির ক্ষত সরকার বোধকরি শুকাতে দিতে চায় না। চার বছর অবাধ ক্ষমতাচর্চার কৃতিত্ব দাবি সেটাই স্মরণ করিয়ে দেয়। আশা ছিল, ৫ জানুয়ারির কৃতিত্ব না দেখিয়ে বর্তমান সরকার অনুশোচনায় দগ্ধ হবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বাকশাল ধরনের কোনো খারাপ স্মৃতি আর লালন করবে না। অন্তত ৫ জানুয়ারি নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে না, যদিও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে সরকার গঠনের পরপরই আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতি ও অবস্থান দুটোই পাল্টে ফেলে। তাদের অঙ্গীকার ছিল, দ্রুত একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ বিরোধী জোটকে এমনভাবে কোণঠাসা করা শুরু করল- যার জের এখনো চলছে।
এ বছরও বিরোধী দলকে ৫ জানুয়ারির কর্মসূচি পালন করতে দেয়া হয়নি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল একতরফা, ভোটার উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী এখন ভোটার হার উল্লেখ করে বক্তব্য দিয়ে দৃঢ়তা প্রদর্শন করতে চাচ্ছেন। ১৫৩ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন একেবারে বিনা ভোটে- কোনো ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই। সেখানে ভোটাররা নিজেদের পছন্দমতো কোনো প্রার্থী বাছাই করার বিন্দুমাত্রও সুযোগ পাননি। এখন আওয়ামী লীগ ৫ জানুয়ারির সব দায় চাপিয়ে দিচ্ছে বিরোধী জোটের ওপর। তাই কর্তৃত্ববাদী অবস্থান আরো কঠোর করেছে।
দুনিয়া জানে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল বিরোধী জোটবর্জিত, বিতর্কিত এবং গণতন্ত্রের বিচারে অগ্রহণযোগ্য। তাই বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট ৫ জানুয়ারিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। কিন্তু এ নিয়ে চার বছর কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেয়া হয়নি বিরোধী জোটকে। জনসভার জন্য আবেদন করেও মাঠ পায়নি বিরোধী জোট। কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। কারণ, পুলিশ সভা পণ্ড করে দেয়। এ ধরনের সভা পণ্ড করা, সমাবেশ করার অধিকার কেড়ে নেয়া- শুধু গণতান্ত্রিক শিষ্টাচারের খেলাপই নয়, এটিও ৫ জানুয়ারির ফলোআপ। এর মাধ্যমে ৫ জানুয়ারির কলঙ্ক ঢাকা পড়েনি। বরং সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণের আরো একটি খারাপ নজির সৃষ্টি হলো, যা কোনো গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আসলেই ৫ জানুয়ারি এদেশে গণতন্ত্র ও নির্বাচন কাঠামোর গলায় ছুরি চালিয়ে গণতন্ত্রকে ধরাশায়ী করে রেখেছে। তারপর গণতন্ত্রের সংজ্ঞা পাল্টে দেয়ার জন্য ‘আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্রে’র কথা বলা হলো। ভিন্ন সুরে বলা হলো ‘উন্নয়ন বেশি, গণতন্ত্র কম’।
এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন না করেও আওয়ামী লীগ চার বছর ধরে দাপটের সাথে এবং ভিন্নমত উপেক্ষা করে একতরফা সরকার পরিচালনা করে আসছে। সংসদে নামকাওয়াস্তে একটি বিরোধী দল রাখা হয়েছে- যা সংসদীয় রীতিনীতির সাথে শুধু সাংঘর্ষিকই নয়, নজিরবিহীনও বটে। গণতন্ত্রের সাথে বিরোধী দলের ধারণাও পাল্টে দেয়া হলো। অথচ গণতন্ত্রে বিরোধী দল অপরিহার্য ও সংসদীয় রীতিনীতির অংশ। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলবিহীন সংসদের অস্তিত্ব কল্পপনাও করা হয় না।
বাস্তবে বর্তমান সংসদে কোনো বিরোধী দল নেই। পুতুল খেলার মতো যে বিরোধী দল ও নেত্রীর অভিনয় চার বছর ধরে হলো, সেটি আরেক কলঙ্কের জন্ম দিয়েছে। কার্যত বিরোধী দলহীন সংসদ জনগণের কাছে কোনো আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। অপর দিকে, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকতা গড়ে ওঠারও কোনো সুযোগ দেয়া হয়নি। শুধু সংসদে নয়, সংসদের বাইরেও কার্যত কোনো বিরোধীদলীয় স্রোত প্রবাহিত হওয়ার সুযোগই সরকার দেয়নি। সব কিছু কুক্ষিগত করার একটা অন্তহীন চেষ্টায় সরকার ছিল সব সময় তৎপর। পেশা নির্বিশেষে সব ফোরাম দখলের মাধ্যমে দলীয়করণ ষোলকলায় পূর্ণ করা হলো। ফলে বিগত চার বছর একদলীয় অবয়বের সরকার একতরফা দেশ পরিচালনা করে একটি খারাপ নজির সৃষ্টি করেছে। ফলে শুধু সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতাই ক্ষুণœ হয়নি, দেশে গণতন্ত্রচর্চা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। গণ-আকাক্সক্ষা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কারণে আইনের শাসনই শুধু ভূলুণ্ঠিত হয়নি, গণতন্ত্রচর্চা ধারাবাহিকতার অভাবে মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার চরমভাবে উপেক্ষিত হয়েছে। জনগণের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে এক ধরনের একদলীয় পুলিশি ব্যবস্থার কারণে। এত কিছু করার পরও এখনো চর দখলের মতো আচরণ করছে- ছাত্রলীগসহ সব অঙ্গসংগঠন। তারপরও ক্ষমতার স্বাদ মিটছে না। আরো চাই!
৫ জানুয়ারি গণতন্ত্রের জন্য শুধু কলঙ্কতিলক তো বটেই- সরকারের বাড়াবাড়ির মন্দ নজির হয়েও নানা ধরনের মন্দ উপসর্গ সৃষ্টি করেছে। দেশে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিকতা পেয়েছে। জবাবদিহিতা শূন্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকেছে। অধিকন্তু, নির্বাচনব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থাই শুধু নষ্ট হয়নি, নির্বাচনব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিকতাও মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। এর ফলে স্থানীয় নির্বাচনও বিতর্কিত হয়ে পড়েছে।
গণতন্ত্রের দাবি অনুযায়ী, ভিন্নমত হিসেবে হলেও ৫ জানুয়ারির ব্যাপারে বিরোধী দল ও জোটের কথা বলার অধিকার ছিল। এটা করুণার বিষয় নয়, দয়া-দাক্ষিণ্যের ব্যাপারও নয়। ‘৫ জানুয়ারির ধারাবাহিকতা’য় সেই অধিকারও কেড়ে নেয়া অত্যন্ত নিন্দনীয়। এটি জাতির প্রত্যাশাকে আবার হোঁচট খাইয়েছে। অজানা আশঙ্কাগুলোকে বাড়িয়ে দিয়েছে। আগামী নির্বাচন নিরপেক্ষ করার সদিচ্ছা আবারো প্রশ্নবিদ্ধ হলো। এটা আস্থার সঙ্কট কমাল না, বরং বাড়িয়ে দিয়েছে।
এত কিছুর পরও দেশের জনগণ আশা করে, তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী শেষ পর্যন্ত বিরোধীদলীয় স্রোত প্রবাহিত হওয়ার সুযোগ পাবে। একতরফা নির্বাচনের প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করা থেকে সরকার বিরত থাকবে। গণতন্ত্রের রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে একটি গ্রহণযোগ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের প্রেক্ষাপট সৃষ্টির লক্ষ্যে বিরোধী দল ও মতকে প্রয়োজনীয় সুযোগ দেয়া হলে সরকারও লাভবান হতো। মত প্রকাশের স্বাধীনতা অবারিত হতো। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন জাতিকে কিছুই দেয়নি, বরং ‘গণতান্ত্রিক স্বেচ্ছতার’ উপহার দিয়েছে। সেই সাথে দমনপীড়ন, হামলা-মামলার নতুন নজির সৃষ্টি করেছে। গুম, অপহরণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যার প্লাবন বইয়ে দিয়েছে। দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিকতায় উন্নীত করেছে। ভিন্নমত উপড়ে ফেলার অবিরাম চেষ্টা চলেছে।
বলে রাখা ভালো, আওয়ামী লীগ চাইলেও ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত অবস্থান পাল্টে দিতে পারবে না। এটা ইতিহাস হয়ে গেছে। এর দায়দায়িত্ব নিরূপণের সময় এসে গেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচন অতীত ভুল সংশোধনের একটা উপায় হতে পারে। জনগণ নিজের খেয়ালখুশিমতো ভোট দিতে পারলে অতীতচারী হওয়ার বেশি প্রয়োজন বোধ করবে না। নয়তো আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে গণতন্ত্রের ভাগ্য নির্ধারণের। এবার আর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির পুনরাবৃত্তি ঘটবে না, ঘটবে রাজনীতিবিদদের ভাগ্যবিপর্যয়। এমনটি ঘটে গেলে গণতন্ত্র অধরা সোনার হরিণ হয়ে যাবে।
সূত্র: নয়াদিগন্ত