মাসুমুর রহমান খলিলী
এ লেখার শিরোনাম মিডল ইস্ট আ্ইয়ের সম্পাদক ডেভিট হার্স্টের লেখা কলামের শিরোনামের কাছাকাছি। তিনি বলেছেন, রাত পেরিয়ে সকাল উঁকি দিচ্ছে ইসলামিস্টদের সামনে। হার্স্ট এটি বলেছেন প্রধানত মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতিকে অবলোকন করে। একথা সত্যি মধ্যপ্রাচ্য হলো পৃথিবীর হৃদপিন্ডের মতো। এখানকার ঘটনাপ্রবাহ বিশ্বের অনেক কিছুর অবয়ব গ্রহণে প্রধান ভুমিকা পালন করে। অধিকাংশ নবী রাসূল এই অঞ্চলে আসার কথাই জানা যায়। তবে পৃথিবীর অন্যান্য জনপদেও বিভিন্ন সময় সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছে। সম্ভবত পরিবর্তন ঘটছে সেসব অঞ্চলেও। ২০১৮ সাল মনে হচ্ছে নতুন বিশ্ব গঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পটভুমি তৈরি করবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব শাসনের বর্তমান ব্যবস্থাটি অবয়ব গ্রহন করে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ৫ সদস্য সারা বিশ্বে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের বলয় ভাগ করে নেয়। এই ভাগ বিভাজনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগের অন্যতম বিশ্ব শক্তি মুসলিম খেলাফত বা ইসলামী বিশ্বের নিয়ন্ত্রক কোন ভূমিকা ছিল না। ছোট বড় অনেক দেশে বিভক্ত এসব রাষ্ট্র বিশ্ব নেতাদের পরিকল্পনা বা আখাঙ্ক্ষার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। এখনো এর বড় কোন ব্যতিক্রম ঘটে গেছে তা বলা যাবে না। তবে নতুন একটি বিশ্ব ব্যবস্থা নির্মাণের ব্যাপারে যে আলোচনা হচ্ছে তাতে ইসলামী দুনিয়াকে সম্ভবত এড়িযে যাওয়া যাবে না।
২০১৭ সালের শেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ছিল বিশ্বের শক্তিমান পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের একটি সিদ্ধান্তকে নানা মতে বিভক্ত মুসলিম দেশসমুহের ফোরাম ওআইসির সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানানোর মধ্য দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র তার সব ক্ষমতা দিয়ে পবিত্র নগরী জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। আর ওআইসির সব সদস্য একমত হয়ে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে পূর্ব জেরুসালেমকে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের মধ্যে ১৪ এবং সাধারণ পরিষদের অধিকাংশ সদস্য আমেরিকান সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
মুক্ত বা উদার বিশ্বের উপর অমেরিকান নিয়ন্ত্রণ এখন যে ক্রমেই শিথিল হয়ে যাচ্ছে তারই একটি সংকেত এটি। একইভাবে বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণও যুক্তরাষ্ট্রের হাত থেকে সরে যাচ্ছে। চীন ধীরে ধীরে বিশ্ব অর্থনৈতিক পরাশক্তি হয়ে ওঠছে আর রাশিয়া সামরিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করে বিভিন্ন স্থানে জয়ী হচ্ছে। তুরস্ক ও ইরানসহ বিভিন্ন দেশের শাসন পরিবর্তনের আমেরিকার গোপন প্রচেষ্টা একের পর এক ব্যর্থ হচ্ছে।
গতানুগতিক বৈশ্বিক বলয়গুলো ভেঙে নতুন বলয় তৈরি হচ্ছে। এশিয়া এবং আফ্রিকায় সৌদি আরব ও ইরানের দুই প্রান্তিক অবস্থানের একটি মধ্যবর্তী অবস্থানে নেতৃত্ব দিচ্ছে তুরস্ক। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের আফ্রিকা সফরে সুদান তি্উনিশিয়াসহ কয়েকটি দেশের সাথে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি ও সমঝোতা হয়েছে্। কট্টরপন্থী ইসরাইলী ও পাশ্চাত্যের মিডিয়া এ নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ব্যক্ত করছে। তবে এসবের মধ্যেই একটি পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় আধিপত্যকামী শক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে প্রতিবেশি দেশগুলো একের পর এক বেরিয়ে যাচ্ছে। মালদ্বীপ শ্রীলঙ্কা ও নেপালের পর বাকি আছে বাংলাদেশ ও ভুটান। এই দুটি দেশেই ২০১৮ সাল নির্বাচনের মাধ্যমে শাসন পরিবর্তনের বছর। নেপালে পরিবর্তনের হাওয়া এই দুটি দেশেও পড়বে বলে মনে হচ্ছে। ইসরাইল যেভাবে ইসলামিস্টদের মধ্যপ্রাচ্যে দমিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে একইভাবে দক্ষিণ এশিয়ার ইসলামি শক্তিকে দমিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে ভারত। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাব হারানোর মানে শুধুমাত্র এই অঞ্চলের দেশসমুহের নিজস্ব সার্বভৌম নিয়ন্ত্রণই শক্তভিত্তি পাবে তাই নয় একই সাথে এখানকার ইসলামিক ও জাতীয়তাবাদী শক্তি তাদের মাটিতে কর্তৃত্ব ফিরে পাবে।
দক্ষিণ এশিয়ার আফ-পাক এলাকা হলো আমেরিকার প্রধান অগ্রাধিকার। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন ভারতকে সাথে নিয়ে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবার কৌশল নিয়েছে। কিন্তু এই কৌশল বাস্তবায়নের আগেই নানা বিপত্তি দেখা দিতে শুরু করেছে। আফগানিস্তানে ১৬ বছরে জয়ের চেষ্টার ব্যর্থতার দায়ভার পাকিস্তানের উপর চাপিয়ে নিয়ন্ত্রণে যাবার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সেখানে গড়ে উঠা চীন পাকিস্তান ইরান রাশিয়া অক্ষের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু করার মতো অবস্থা থাকবে বলে মনে হচ্ছে না।
২০১৮ সালে পরিবর্তনের বিষয়টির সবচেয়ে স্পষ্ট অবয়ব দেখা যায় মধ্যপ্রাচ্যে। ২০১৭ সাল ছিল সেখানকার জন্য এক অস্থির বছর। সিরিয়ায় রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপ বাশার আসাদের জন্য এক ধরনের বিজয় এনে দিয়েছে। ইয়েমেনে এখনো জয়ী হতে পারেনি সৌদি অক্ষ শক্তি। কাতারের সাথে বিরোধের পর দোহা সেখান থেকে সরে এসেছে। সুদানের সাথে বিরোধপূর্ণ দ্বীপ এলাকায় মিসরের মালিকানায় সৌদি স্বীকৃতির কারণে খার্তুম ইয়েমেন থেকে সরে এসেছে। সুদান ছিল সেখানে সৌদি বলয়ের পক্ষে সেনা সরবরাহকারী প্রধান দেশ। ইয়েমেন থেকে সরে আসার পর তুরস্কের সাথে ১৪টি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে সুদান।
এরদোগানের তিউনিশিয়া সফরের সময়ও দু’দেশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি হয়েছে। এসব কারণে বিন সালমান, বিন জায়েদ ও সিসি অক্ষের যে দাপট ২০১৭ সালে প্রবল হয়ে উঠেছিলো সেটি ঠান্ডা হাওয়ায় ম্রীয়মান হয়ে পড়ে বছরের শেষ দিকে।
এক বছর আগের তুলনায় এখন আরব বিশ্বের নতুন অবয়বের ধরনটি নিখুঁত নাটকের মতোই মনে হচ্ছে। সৌদি আরবের প্রভাব এখন সঙ্কুচিত। এটি ছয়টি উপসাগরীয় দেশের একক নেতা হিসাবে বছর শুরু করে এবং রাজনৈতিক ইসলামের উপর ডোনাল্ট ট্রাম্পের বক্তৃতা শুনতে মুসলিম দেশের ৫৫ জন নেতাকে রিয়াদ ডেকে নিয়ে যায়। অথচ বছরের শেষ হয় এই সমর্থনে এক ধরনের রক্তক্ষরণ দিয়ে। সৌদি আরব লেবাননকে এখন একেবারেই হারিয়ে ফেলেছে। একজন সুন্নি রাজনীতিবিদ মন্তব্য করেছেন, সৌদিরা হারিরিকে পদত্যাগে বাধ্য করার চেষ্টা করে নিজেদের যে ক্ষতি করেছে ইরান যদি সৌদি আরবের বিরুদ্ধে লেবাননের জনগণের মত গঠনের জন্য বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতো তাহলেও তেমন ফল পেতো না।
মোহাম্মদ বিন সালমান ভেবেছিলেন যে, যতদিন পর্যন্ত তার পক্ষে ট্রাম্প এবং ইসরাইল আছে ততদিন পর্যন্ত তার এজেন্ডা বাস্তবায়ন কোন ব্যাপারই নয়। কিন্তু তার এই হিসাবের মধ্যে তিনটি ভুল রয়েছে। তার প্রথম ভুল অনুমান হলো যে, ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসাবে পুরো মেয়াদ অব্যাহত থাকবেন। কিন্তু তার এক সময়ের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগি স্টিভ ব্যানন এ ব্যাপারে ভিন্ন কিছু বলেছেন। তিনি ভ্যানিটি ফেয়ারকে বলেছেন যে, প্রথম মেয়াদে সংবিধানের ২৫ তম সংশোধনী অনুযায়ী মন্ত্রিপরিষদ কর্তৃক পদচ্যুতি অথবা অভিসংশনের মাধ্যমে বিদায়ের এক অপ্রত্যাশিত শেষ পরিণতি থেকে রক্ষা পাবার ব্যাপারে তিনি ট্রাম্পের সামনে মাত্র ৩০ শতাংশ সুযোগ দেখছেন। আর ট্রাম্প ছাড়া, বিন সালমানের মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে মহা পরিকল্পনা যে টুকরো কাগজের মতো হয়ে যাবে তাতে সংশয়ের অবকাশ কমই রয়েছে।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো ইসরাইল নব্য সৌদি নেতাদের চেয়েও ওয়াশিংটনের রাজনীতির অনেক বেশি চটপটে পাঠক। দেশটির নেতারা দেখছেন মাঠে এখন নানা ঘটনা ঘটছে। আর সর্বশেষ উন্নয়ন হতে পারে জেরুসালেমের চারপাশে নির্মাণ করা বসতি প্রাচীরে শেষ ইট স্থাপন।
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু দ্রুত কাজ সেরে নেবার মানুষ। তিনি শুধুমাত্র বৃহত্তর জেরুসালেম এর পুরো দখল প্রতিষ্ঠাই শেষ করতে চান না, একই সাথে তিনি নিজে ক্ষমতায় থাকাকালেই ট্রাম্পের কাছ থেকে এটি পেতে চাইবেন। তিনি জানেন যুক্তরাষ্ট্রে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট যেই হোন না কেন, এই বিপর্যয়কর পথ তিনি অনুসরণ করতে চাইবেন না।
বিন সালমানের পরিকল্পনায় তৃতীয় ত্রুটি হলো জেরুসালেম নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি। ট্রাম্পের ঘোষণা ফিলিস্তিনি সংঘাতকে ইস্যু হিসাবে রাতারাতি সামনে নিয়ে এসেছে যা ২০১১ সালের আরব বিদ্রোহ এবং এরপর প্রতি বিপ্লবের মধ্যমে পেছনে চলে গিয়েছিল। সিরিয়া এখন আর প্রধান সমস্যা নয়। আবারও ফিলিস্তিন মধ্যপ্রাচ্যের মূল বিষয় হিসেবে সামনে চলে আসার ফলে, ফিলিস্তিনিদের সামনে তৃতীয় ইনতিফেদাহ ছাড়া কোন বিকল্প থাকবে না। ইসরাইলি নিরাপত্তা প্রধানরা ইতিমধ্যে মাঠের মেজাজ সম্পর্কে তাদের রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিদের সতর্ক করে দিয়েছেন। তারা বলেছেন, ২০১৪ সালের সংঘর্ষের প্রাক্কালে গাজায় যে উত্তেজনা ছিল সে অবস্থা এখন আবার দেখা যাচ্ছে।
প্রশ্ন হলো ২০১৮ সালের জন্য কি অপেক্ষা করছে? বাদশাহ হবার জন্য অপেক্ষমান নতুন সৌদি তরুণ রাজপুত্র হিসাবে বিন সালমানের উত্থানের মধ্যেই আঞ্চলিক কর্তৃত্বশালী হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় কাতারি শিবির পুনরায় সক্রিয় হয়েছে। দেশটি এখন তুরস্ক ও সুদান থেকে সামরিক এবং ইরান থেকে লজিস্টিক সহায়তা পাচ্ছে। এখন স্পষ্টত ইরান ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যে দুটি বলয় দেখা যাচ্ছে। ফিলিস্তিন ইস্যু আবার কেন্দ্রে ফিরে এসেছে। আর দুটি বলয়ের মধ্যে পার্থক্যের কেন্দ্রে রয়েছে এটি। ইসলামী আন্দোলন বা রাজনৈতিক ইসলাম শক্তিশালী খেলোয়াড় হিসাবে ফিরে আসছে।
ইয়েমেনের কার্ড হাতের বাইরে চলে যাওয়ায় মোহাম্মদ বিন সালমান ও মোহাম্মদ বিন জায়েদ উভয়েই ব্রাদারহুড সংশ্লিষ্ট দল আল ইসলাহ’র নেতাদের শরণাপন্ন হচ্ছেন। জর্দান ও আরব বিশ্ব জুড়ে জেরুসালেম নিয়ে বিক্ষোভের মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক ইসলামপন্থীরাও আরেকবার তাদের শক্তি দেখিয়েছে।
এর ফলে সৌদি আরব বা আমিরাত জেরুসালেম নিয়ে তাদের ভেবে রাখা কৌশল নিয়ে কাজ করতে পারছেন না। নতুন এই বছরটিকে তারা তাদের ইমেজ এবং নিজস্ব লাভ নিশ্চিত করে মধ্যপ্রাচ্যকে পূনর্বিন্যাস করার চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু বছরের শুরুতে তারা জেগে উঠেছেন গভীর মাথাব্যথা নিয়ে যা তারা নিজেরাই কৃতকর্মের মাধ্যমে কামাই করেছেন। মনে হচ্ছে নতুন বছরে মধ্যপ্রাচ্য নতুন অবয়বের দিকে এগিয়ে যাবে যেখানে রাজনৈতিক ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে।
সূত্র: অনলাইন বাংলা