অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
এ বছরের শেষ দিকে একাদশ সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। নির্বাচনের বাকি একবছর সময়ও নেই। এমন প্রেক্ষাপটেই হঠাৎ করে মন্ত্রীসভায় বড় ধরণের রদবদল করলো শেখ হাসিনা সরকার। এই রদবদলকে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা তাদের নির্বাচনী কৌশলের অংশ হিসাবেই বর্ণনা করছেন।
তবে বিশ্লেষকরা এই রদবদলকে শরিক দল বিশেষ করে বাম দলগুলোর সাথে আওয়ামী লীগের সম্পর্কের অবনতি হিসেবেই দেখছেন। তাদের মতে, নির্বাচনের আগে বামপন্থি দলগুলোর সাথে দূরত্ব তৈরি করে ইসলামি দলগুলো ও ইসলামপ্রিয় মানুষের আস্থা অর্জনে চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার।
দেখা যাচ্ছে, রদবদলের প্রভাব বেশি পড়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক দলগুলোর নেতাদের উপর। শরিক দলগুলো যেমন জাতীয় পার্টি ও বামদলগুলো থেকে যারা মন্ত্রিসভায় রয়েছেন, তাদেরই অনেকের দায়িত্ব পরিবর্তন ও খর্ব করা হয়েছে।
ক্ষমতাসীন জোটের শরীক ওয়ার্কাস পার্টির নেতা রাশেদ খান মেননকে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, সেটিকেও তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় বলেও মজা করে বলেছেন আকাশ থেকে তিনি মাটিতে নেমেছেন।
বাংলাদেশ বিমান এবং সিভিল এভিয়েশনের ব্যবস্থাপনা নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে মি. মেননের ব্যাপারে অনেক দিন ধরেই অসন্তোষ ছিল। ২০১৬ সালের নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাঙ্গেরি সফরে যাওয়ার সময় বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে সেই বিমান জরুরি অবতরণ করাতে হয়েছিল। এ নিয়ে সরকারের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যেও ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। এখন মি. মেননকে সরিয়ে অন্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়ার পিছনে এসব বিষয় অন্যতম কারণ হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের আরেক শরিক জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে বহাল থাকলেও সেখানে তারানা হালিমকে প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ করে তাঁর একক ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগপন্থী সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। সেই প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের বিশ্বস্ত একজনকে তথ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে বসানো হলো বলে দলের মধ্যেই ধারণা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে একসময়ের বাম নেতা বর্তমান আওয়ামী লীগের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদেরও একক ক্ষমতাকে খর্ব করা হয়েছে। নতুন শপথ নেয়া কাজী কেরামত আলীকে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছে। সকল পর্যায়ের পরীক্ষাগুলোতে অনবরত প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং সম্প্রতি সহনীয় পর্যায়ে ঘুষ খাওয়াসহ দুর্নীতি নিয়ে মন্তব্য করায় নাহিদকে নিয়েও আওয়ামী লীগের ভিতরে ব্যাপক সমালোচনা হয়।
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির বিতর্কিত একতরপা নির্বাচনের পর পরিস্থিতি সামাল দিতে ও ক্ষমতা ধরে রাখতে বাম দলসহ শরিক দলগুলোর কয়েকজন নেতাকে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয় শেখ হাসিনা সরকার। এনিয়ে আওয়ামী লীগের ভিতরে ক্ষোভ ছিল এবং ঐ মন্ত্রীদের কাজ নিয়ে বিভিন্ন সময় দলটির ভিতরে সমালোচনাও হয়েছে। এখন মন্ত্রিসভার রদবদলে শরিক দলগুলোর মন্ত্রীদের মন্ত্রণালয়ে আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়েছে বলে দলটির নেতাদের অনেক মনে করেন।
অ্যানালাইসিস বিডির অনুসন্ধানে জানা যায়, বিএনপিকে মোকাবেলা করে ক্ষমতা ধরে রাখার স্বার্থে বাম দলগুলোর সাথে জোটবদ্ধ হলেও তাদেরকে কখনোই বিশ্বাস করতে পারেনি আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পেছনে বাম দলগুলোর অবদান ও হত্যার পর জাসদের ইনুসহ বামদলগুলোর উল্লাস শেখ হাসিনা কখনোই ভুলে যাননি। তাই তাদেরকে জরুরি দরকারের সময় কাজে লাগালেও প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে ছুঁড়ে ফেলতেও দেরি করেন না তিনি।
রাশেদ খান মেনন মন্ত্রনালয়ে থাকাবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর বিমানে ত্রুটিকে তাই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। দলটির নেতারা মনে করে বামদলগুলো এখন মুখে যতই বঙ্গবন্ধুর গুণকীর্তন করুকনা কেনো তারা বিষাক্ত সাপ। সুযোগ পেলেই ছোবল মারতে তারা একটুও দেরি করবে না।
এদিকে, সরকারি দলের এমন আচরণে বাম দলগুলোও পড়েছে বিপাকে। তারা সরকারের সাথে মিশে থেকে কোনোভাবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে বহুদিন ধরে। কিন্তু এখন যদি সরকারি দল তাদেরকে ছেড়ে দেয় তাহলে অস্তিত্ব ধরে রাখাই তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। খালেদা জিয়াকে আক্রমণ করে অনবরত বক্তব্য এবং বঙ্গবন্ধুর গুণকীর্তনের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে খুশি করার যেই প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন হাসানুল হক ইনু। তার সেই প্রচেষ্টাও হয়তো বিপলে যাচ্ছে।
মোটকথা অনেক কাঙ্খিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে কঠিন সংকটেই পড়তে যাচ্ছে বাম দলগুলো। আগের ন্যায় আওয়ামী লীগে সওয়ার হওয়ার সুযোগ হয়তো তাদের এবার হবে না। আওয়ামী লীগ নিজেদের স্বার্থেই এমনটি আর করবে না। কারণ ইতোমধ্যেই বাম দলগুলোকে প্রশ্রয় দেয়ায় তারা ইসলামি দলগুলো ও দেশের সিংহভাগ ইসলামপ্রিয় মানুষের কাছে নিজেদেরকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আগামী নির্বাচনের আগে অবশ্যই এই অবস্থার পরিবর্তন তাদেরকে করতে হবে।