নতুন বছরের শুরুতেই রাজপথে নামছে দেশের বড় দুই দল। ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সারা দেশে শোডাউনের চিন্তা-ভাবনা করছে। ২০১৪ সালের ‘৫ জানুয়ারির’ নির্বাচনের দিনটিকে আওয়ামী লীগ ‘গণতন্ত্র রক্ষা দিবস’ ও বিএনপি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। এবারও দিনটি পালনে প্রস্তুতি নিচ্ছে দুই দল। এ লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে ঢাকা মহানগর উত্তর এবং দক্ষিণের উদ্যোগে রাজধানীর দুই অংশে দুটি কর্মসূচি পালন করবে আওয়ামী লীগ। জেলা-উপজেলায় যথাযথভাবে দিনটি পালনের নির্দেশনা দিয়ে চিঠিও দেয়া হয়েছে।
ওই সময় বিএনপির আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার নিয়ে রাজধানীর শিল্পকলায় সেমিনারও করবে ক্ষমতাসীন দল। অন্যদিকে দিনটিতে ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপক শোডাউন করতে প্রস্তুত মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী অথবা নয়াপল্টনে সমাবেশসহ সারা দেশে কালো পতাকা নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির।
দিনটিকে ঘিরে রাজনৈতিক মহলসহ সব শ্রেণী-পেশার মানুষের বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের চলতি মেয়াদ শেষের বছর হওয়ায় নানাভাবে এটি এবার গুরুত্ব পাচ্ছে।
তাছাড়া এর আগের বছরগুলোয় এই দিনটিকে ঘিরে মাঠ উত্তপ্ত হওয়ার নজির রয়েছে। তাই সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কা কেউ উড়িয়ে দিচ্ছে না। যদিও বিএনপি সহসা মাঠ গরম করার নীতি থেকে সরে এসেছে। তাদের লক্ষ্য- শক্তি ক্ষয় না করে নির্বাচন পর্যন্ত সময়টি স্বাভাবিকভাবে অতিক্রম করা। তাই সরকারের অনুমতি পেলেই কেবল ঢাকায় সমাবেশ বা কালো পতাকা মিছিল করবে দলটি। না হলে প্রতিবাদের ভাষা ঘরোয়া সভার মধ্য দিয়ে শেষ হবে।
এদিকে দিনটিকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও বেশ সতর্ক। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় তারা সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দুই দল একই স্থানে সমাবেশের ডাক দিলে ১৪৪ ধারা জারিসহ যে কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হবে না তারা।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে টানা দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। ওই নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। অনেকটা একতরফা নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে নানান সমালোচনা আছে। যদিও আওয়ামী লীগ সেটি মানতে নারাজ। তাদের বক্তব্য কেউ নির্বাচনে না এলে তাদের কী করার আছে। সবকিছু সংবিধান অনুযায়ী হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, অনেক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির অপচেষ্টা সত্ত্বেও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন হয়েছিল বলেই দেশে গণতন্ত্র সমুন্নত আছে। দেশ গণতান্ত্রিক চর্চায় এগিয়ে যাচ্ছে, গণতান্ত্রিক ধারা শক্তিশালী হয়েছে। কেননা স্থানীয় বা জাতীয় যে নির্বাচনই বলুন, সেগুলো সুষ্ঠু হচ্ছে, মানুষ নির্বিঘেœ-নির্ভয়ে এবং স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারছে। একটি গণতান্ত্রিক সরকার দেশ পরিচালনা করছে বলে সেটি সম্ভব হয়েছে।
জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী যুগান্তরকে বলেন, ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক দিন। দেশের গণতন্ত্রের কফিনে এদিন শেষ পেরেক ঠুকে দেয়া হয়। তিনি বলেন, ওই নির্বাচনে একতরফাভাবে জয়ী হয়ে অনেকটা গায়ের জোরে দেশ চালাচ্ছে ক্ষমতাসীনরা। তাই বিনা ভোটে নির্বাচিত সরকারের জনগণের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই।
তিনি বলেন, হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আন্দোলন করে যাচ্ছে বিএনপি। ৫ জানুয়ারি কলঙ্কজনক দিনটিকে স্মরণ করিয়ে দিতে গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আমরা নিশ্চয় কর্মসূচি পালন করব। কি ধরনের কর্মসূচি পালন করা হবে তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে আমরা জনগণের শান্তি ও স্বস্তির জন্য সংঘাত-সংঘর্ষ এড়াতে চাই।
রাজধানীর দুই অংশে সমাবেশ করবে আ’লীগ : আসছে ৫ জানুয়ারি চতুর্থবারের মতো ‘গণতন্ত্র রক্ষা দিবস’ হিসেবে পালন করবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এ লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে ঢাকা মহানগর উত্তর এবং দক্ষিণের উদ্যোগে রাজধানীর দুই অংশে দুটি কর্মসূচি পালন করবে দলটি।
দলটির নেতারা জানান, দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম প্রেসিডিয়ামের বৈঠকে দিনটি যথাযথভাবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর আলোকে রাজধানীতে দুটি জনসভায় ব্যাপক লোক সমাগমের মাধ্যমে বছরের প্রথম কর্মসূচিটি পালন করা হবে। এর মাধ্যমে আগামী নির্বাচনের লক্ষ্যে বছরব্যাপী রাজপথে থাকার বার্তা দেয়া হবে। আগামীতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে- এমন বার্তা দিয়ে নেতাকর্মীদের সে লক্ষ্যে কাজে নেমে পড়ার আহ্বান জানাবেন কেন্দ্রীয় নেতারা। বলা হবে সেদিন আওয়ামী লীগ নির্বাচন করেছিল বলেই গণতন্ত্র অক্ষুণ্ণ রয়েছে। একই সঙ্গে নির্বাচন ঠেকাতে বিএনপি-জামায়াতের জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন এবং ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড তুলে ধরা হবে।
এছাড়া এ শোডাউন হবে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের উপনির্বাচনের একটি গ্রাউন্ড ওয়ার্ক। বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর জমায়েত এবং সাধারণ মানুষের উপস্থিতি নিশ্চিত করার মাধ্যমে সাংগঠনিক শক্তির জানান দেয়া হবে। দিবসটিকে কেন্দ্র করে বিএনপি কোনো ধরনের ‘বিশৃঙ্খলা’ সৃষ্টির চেষ্টা করলে ‘দাঁতভাঙা জবাব’ দেয়ার প্রস্তুতি থাকবে বলেও জানান দলটির একাধিক নেতা। এসব কর্মসূচি পালনে ইতিমধ্যে সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদেরও নির্দেশনা পৌঁছে দেয়া হয়েছে।
ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলছেন, ২০১৮ সালের ৫ জানুয়ারি পাঁচ বছর মেয়াদি বর্তমান সরকারের ৪ বছর পূর্ণ হবে। সেজন্য দিনটিকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। কারণ বিএনপিবিহীন এই নির্বাচন নিয়ে দেশের ভেতরে-বাইরে নানা চাপে ছিল আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, ৫ জানুয়ারি রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ এবং রাসেল স্কয়ারে ঢাকা মহানগর উত্তর আনন্দ সমাবেশ করবে। পরদিন জাতীয় শিল্পকলা মিলনায়তনে নির্বাচন ঠেকানোর আন্দোলনের নামে পেট্রলবোমা মেরে বিএনপি-জামায়াত যাদের পুড়িয়ে মেরেছিল এবং হতাহত করেছিল, তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সেমিনার করা হবে। এতে দেশি-বিদেশি অতিথিদের সামনে আবার বিএনপি-জামায়াতের নাশকতার ভিডিওচিত্র প্রদর্শন করা হবে। আর হতাহতদের পরিবারের সদস্যদের বর্ণনায় তুলে ধরা হবে বিভীষিকাময় সেই দিনগুলো এবং ঘটনার ভয়াবহতা। এছাড়া ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে জেলা-উপজেলার কর্মসূচিতেও বিএনপির জ্বালাও-পোড়াওয়ের চিত্র সারা দেশে প্রচার করা হবে।
সংঘাত এড়িয়ে শোডাউনের চিন্তা বিএনপির : ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে সারা দেশে ব্যাপক শোডাউন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। দিনটিকে কেন্দ্র করে কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হচ্ছে। দলটির নীতিনির্ধারকদের কয়েকজন যুগান্তরকে জানান, ওইদিন রাজধানীসহ সারা দেশে ব্যাপক শোডাউন করার চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে অনেকেই পরামর্শ দিচ্ছেন। বিকল্প হিসেবে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে কালো পতাকা মিছিল করার কথা ভাবা হচ্ছে। তবে ঢাকাসহ সারা দেশে একযোগে বেশ কিছু কর্মসূচি পালন করা হবে।
দলটির এক সূত্র জানায়, অনুমতি না দিলে জোর করে সমাবেশ করবে না বিএনপি। কারণ দলটির হাইকমান্ড এ মুহূর্তে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়াতে চায় না। সরকারের অনুমতি না পেলে শেষ পর্যন্ত রাজধানীতে সমাবেশ না হলেও ঢাকার বাইরে সব বিভাগীয় ও জেলা শহরে বিক্ষোভ সমাবেশ পালিত হবে।
দলের একটি অংশ মনে করেন, ৫ জানুয়ারি উপলক্ষে বিএনপিকে রাজপথে নামার সুযোগ হয়তো সরকার দেবে না। উল্টো উসকানিমূলক বক্তব্যের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরা বিএনপিকে উসকে দেয়ার চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু এ মুহূর্তে সরকারের উসকানিতে পা দেয়া ঠিক হবে না। দিনটিকে কেন্দ্র করে সংঘাত-সংঘর্ষ হলে নেতাকর্মীদের নামে দেয়া হতে পারে নতুন মামলা। গ্রেফতার করা হতে পারে সক্রিয় নেতাদের। তাই সবকিছু বিবেচনা করে আপাতত নতুন কোনো ঝামেলায় যেতে চান না ওই অংশের নেতারা।
জানতে চাইলে বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানী যুগান্তরকে বলেন, ২ জানুয়ারি ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি থাকবেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। পরের দুই দিন তার আদালতে হাজিরা দেয়ার কথা রয়েছে। এ নিয়ে নেতাকর্মীরা ব্যস্ত থাকবেন। তার জানামতে ৫ জানুয়ারি নিয়ে দলের হাইকমান্ড এখনও চূড়ান্ত কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করেনি।
তবে দলটির তরুণ এ নেতা বলেন, ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন করে দেশের গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে আওয়ামী লীগ। গণতন্ত্র হত্যা দিবসটিকে দেশের মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিতে গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপির দায়িত্ব। সেক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি নেয়া হতে পারে বলে জানান তিনি।
সূত্র: যুগান্তর