কামাল গাবালা
গত ২৪ নভেম্বর রাতের অন্ধকারে মিসরে গণকবর খুঁড়তে হয়েছে। সিনাই উপদ্বীপে জুমার নামাজের সময় সুফি মসজিদে যে ভয়াবহ বোমা হামলা হলো, সেই হামলায় নিহত ব্যক্তিদের কবর। এই হামলায় ৩০৫ জন মারা গেছে, যার মধ্যে ২৭টি শিশু ও ১৬০ জন বয়স্ক মানুষ। আহত হয়েছে আরও ১২৮ জন।
এটি মিসরের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা। আর আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি ক্ষমতায় আসার পর এ নিয়ে মোট ১ হাজার ১৬৫টি হামলা হলো। এটা এক ক্রান্তিলগ্নও বটে, যখন মিসরে গণহারে হত্যার এক নতুন পর্ব শুরু হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে ২০১৩ সালের পর মিসরে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রায় ১ হাজার সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। এ বছরই সেখানে ২০০ হামলা হয়েছে। এই পূর্বাভাসও করা হচ্ছে যে উত্তর সিনাইয়ে এখন জীবিত সন্ত্রাসীর সংখ্যা ১ হাজার ছাড়াবে না। হামলার পর সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২৫ থেকে ৩০ জন হামলাকারী এই হামলা চালিয়েছে। এদের হাতে ইসলামি স্টেটের পতাকা ছিল। মসজিদের দরজা ও জানালা মিলিয়ে ঢোকা ও বেরোনোর যে ১২টি পথ ছিল, তার সব কটি স্থানেই এরা অবস্থান নিয়েছিল।
যারা হামলায় মারা গেছে, তারা মুসলমান। যারা হামলা করেছে তারাও মুসলমান। ফলে ইরাক ও সিরিয়ায় যেখানে আইএস পরাজিত হয়েছে এবং লিবিয়ায় তারা পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে থাকার পরও মিসরে কেন হামলার সংখ্যা বেড়ে গেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রধান প্রশ্নটি হচ্ছে যারা মসজিদ ও গির্জায় ভক্তদের ওপর হামলা করে, তারা কেমন প্রকৃতির মানুষ? আর যে উপদ্বীপ রীতিমতো সামরিক অঞ্চলে পরিণত হয়েছে এবং যেখানে মিসরীয় নাগরিকদেরও অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করতে হয়, সেখানে এ রকম বড় হামলা কীভাবে হচ্ছে?
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে এবং রাওদা মসজিদে হামলা নিয়ে সৃষ্ট সন্দেহের আগে এটা বলা দরকার যে এই হামলা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য স্থানের হামলার চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়, যদিও ভয়াবহতার দিক থেকে তা সবকিছু ছাড়িয়ে গেছে। এই হামলা যখন হলো, ঠিক সেই সময়েই মিসরীয় সরকার তুরস্কে এক গোয়েন্দা চক্রের সন্ধান পেল, যেটার সঙ্গে অতীতে কাতার পরিচালিত এক গোষ্ঠীর মিল আছে। একই সময়ে মিসরের এক আদালত লিবিয়ায় ২০১৫ সালে ২০ জন মিসরীয় খ্রিষ্টানকে শিরশ্ছেদ করার মামলায় বিবাদীপক্ষের ৭ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং ১০ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন।
অন্যদিকে এই হামলা যখন ঘটল, তখন সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যকার উত্তেজনা নতুন করে বেড়েছে। ব্যাপারটা হয়েছে কী, নিউইয়র্ক টাইমস সৌদি আরবের উত্তরাধিকারী যুবরাজকে উদ্ধৃত করে বলেছে, তিনি আয়াতুল্লাহ খোমেনিকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এই একই সময়ে আবার সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষকদের তালিকায় বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ ইউসেফ আল-কারাদাওয়িও আছেন, যাঁর সমর্থনে আছে কাতার।
যাহোক, মিসরে সন্ত্রাসী হামলা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে অনেকে আবার মিসরীয় সরকার ও সিসি জমানার গত চার বছরে সন্ত্রাসবাদ ও সহিংসতা মোকাবিলায় ব্যর্থতাকে চিহ্নিত করেছেন। তাঁরা সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় কেবল মিসরীয় সরকারের ‘অন্ধ প্রতিশোধ’ নীতির সমালোচনা করেন। তাঁরা বলেন, দেশটির সরকার এটা ভাবে না যে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এসব অভিযানের কী প্রভাব পড়ে। সরকার যে আদিবাসী অঞ্চলে সন্ত্রাসীদের হত্যা করে, তাতে সেখানকার মানুষের ক্রোধ আরও বেড়ে যায়। এ ছাড়া মিসরীয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা সিনাই উপদ্বীপের মানুষদের আপন করে নিতে পারেনি। এর বদলে তারা এদের সঙ্গে রুক্ষ রাজনীতি করেছে, আটক করে নির্যাতন ও নিপীড়ন করেছে। ইসরায়েলের হাত থেকে রক্ষা করার পর তারা বছরের পর বছর ধরে তাদের অবহেলা করেছে।
অনেকেই বিশ্বাস করেন, মিসর এক আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মুখে পড়েছে। এরা দেশটিকে ভেতর থেকে ধ্বংস করে দিতে চায়। এরা দেশটিকে মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃত্বে আসীন হতে দিতে চায় না এবং তাকে দীর্ঘ যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে চায়। এই তত্ত্বে বিশ্বাসীরা মনে করেন, যারা সিরিয়া ও ইরাককে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে এবং এর আগে লিবিয়া ও ইয়েমেনকে, তারা এখন মিসরে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চায়। বিদেশি গোয়েন্দাদের সহযোগিতায় তারা এটা করতে চায়।
অন্যরা মনে করেন, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মিসরের যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি হবে। এর সঙ্গে তাকে যেটা করতে হবে তা হলো গোষ্ঠীকেন্দ্রিক আদর্শ, দারিদ্র্য ও অজ্ঞতা দূর করতে হবে। এর সঙ্গে সিনাই পুনর্গঠন করতে হবে তাকে। অন্যরা মনে করে, এটা ইসরায়েলের ষড়যন্ত্র। সে চায় মিসর দুর্বল ও বিভক্ত থাকুক, যাতে গাজার সমস্যা সমাধানে ওখানকার মানুষের সিনাইয়ে পাঠানো যায়। মধ্যপ্রাচ্যের পুনর্বিন্যাসে এটি শতাব্দীর সেরা সম্ভাব্য চুক্তি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে যদিও তা এখনো আলোচনার টেবিলে আছে। সে কারণে অনেকেই মনে করেন, এই হত্যাযজ্ঞের পেছনে ইসরায়েলের গোয়েন্দা বাহিনী আছে।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
কামাল গাবালা: মিসরের আল-আহরাম পত্রিকার সাবেক ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।
সূত্র: প্রথম আলো
Discussion about this post