ইকতেদার আহমেদ
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অনুসৃত হয় পৃথিবীর এমন সব রাষ্ট্রে সরকার পরিবর্তনের একমাত্র পদ্ধতি হলো অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন। একটি নির্বাচনকে অর্থবহ এবং দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে হলে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে যে সংস্থাটি নিয়োজিত, সর্বপ্রথম সে সংস্থাটিকে নিরপেক্ষ হতে হয় এবং এটি পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সৎ, দক্ষ, যোগ্য ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হওয়ার আবশ্যকতা দেখা দেয়। আমাদের দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত। এটি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান এবং এ কমিশনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার পদে যারা আসীন হন তারা সবাই শপথের অধীন। শপথ গ্রহণ করাকালীন অপরাপর বিষয়ের পাশাপাশি তাদের ব্যক্ত করতে হয়- তারা সংবিধানের সংরক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করবেন এবং তাদের সরকারি কার্য ও সরকারি সিদ্ধান্তকে ব্যক্তিগত স্বার্থের প্রভাবে প্রভাবিত হতে দেবেন না।
নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিকভাবে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। সংবিধানের বর্তমান বিধান অনুযায়ী মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে গেলে, ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে এবং মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে, ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হয়। যেকোনো জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠান-পূর্ববর্তী নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা হালনাগাদসহ নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ করে থাকে।
নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে যে বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হয় তা হলো- নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব দলের জন্য সমসুযোগ সংবলিত মাঠ, নির্বাচনে অবতীর্ণ সব দলের প্রার্থীদের নির্বিঘ্নে মনোনয়নপত্র দাখিলের ব্যবস্থা, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নির্বিঘ্নে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ, ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে নির্বিঘ্নে ভোটদানের সুযোগ, সব দলের প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের ভোটকক্ষে উপস্থিতি, যেকোনো প্রার্থীর সপক্ষে জাল ভোট প্রদান কঠোরভাবে প্রতিরোধ এবং সব দলের প্রার্থীর প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ভোট গণনা-পরবর্তী প্রিজাইডিং অফিসার ও প্রতিনিধিদের স্বাক্ষর সংবলিত ফলাফল বিবরণীর অনুলিপি প্রতি প্রার্থীর প্রতিনিধিকে হস্তান্তর।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী এ যাবৎকালে ১০টি সংসদ নির্বাচনে তিনটি দল যথা- আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি বিজয়ী হয়ে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করে। উপরোক্ত ১০টি নির্বাচনের মধ্যে যে নির্বাচনগুলো দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়, এর প্রতিটিতে দলীয় সরকার বিজয়ী হয়। অপর দিকে দলীয় সরকারবহির্ভূত সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনে দলীয় সরকার পরাভূত হয়। তৃতীয়, অষ্টম, নবম ও দশম- এ চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রথমোক্ত দু’টিতে জাতীয় পার্টি ও বিএনপি এবং শেষোক্ত দু’টিতে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। এ নির্বাচনগুলোতে এ তিনটি দলের জয়ের ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত সহযোগিতা করেছিল, এমন অভিযোগ এক দল অপর দলের বিরুদ্ধে করে এলেও ভারত এ ব্যাপারে নিশ্চুপ।
১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সংসদ নির্বাচনটি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বর্জনের ঘোষণা দিয়ে এটি প্রতিহতের ডাক দেয়। তখন আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হয়েছিল- এ নির্বাচনে যে দল অংশ নেবে, সে দল হবে জাতীয় বেঈমান। এ নির্বাচনটি অনুষ্ঠানের অব্যবহিত আগে দেখা গেল অকস্মাৎ আওয়ামী লীগ আন্দোলন থেকে সরে এসে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দেয়। পরে আওয়ামী লীগের বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছে, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর আওয়ামী লীগ প্রধানের সাথে টেলিফোনালাপ-পরবর্তী দলটি চাপে পড়ে নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য হয়েছে। সে নির্বাচনটিতে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে বলপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করে অবৈধভাবে ক্ষমতাসীন হওয়া সামরিক শাসক এরশাদের শাসনামলকে সাংবিধানিক বৈধতা দেয়ার জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তার দলের বিজয়ী হওয়া অত্যাবশ্যক ছিল।
বিএনপির বর্জন সত্ত্বেও সে নির্বাচনটিতে জনমতের প্রতিফলনে প্রদত্ত ভোটের ভিত্তিতে ফলাফল ঘোষিত হলে এরশাদের দল জাতীয় পার্টির পরিবর্তে আওয়ামী লীগই যে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হতো, এ প্রশ্নে নিরপেক্ষ রাজনীতি ও নির্বাচন বিশ্লেষকদের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। এ নির্বাচনটিতে অংশগ্রহণ-পরবর্তী নিশ্চিত বিজয় থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে আওয়ামী লীগের আশা ভঙ্গ হয় এবং দলটি নির্বাচন-পরবর্তী দুই বছরের মাথায় সংসদ থেকে পদত্যাগ করলে সেই সংসদ ভেঙে দেয়া হয়। এরশাদের পতন-পরবর্তী অনুষ্ঠিত কর্মরত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ী হওয়ার ব্যর্থতা যে আন্দোলনের পিঠে ছুরিকাঘাত করে, এরশাদ সরকারের অধীন নির্বাচনে অংশগ্রহণ অন্তত এ সত্যটি উপলব্ধি করতে সে সময়কার দলীয় নীতিনির্ধারকদের অনেকে সমর্থ হয়েছে।
২০০১ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত সপ্তম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রদত্ত ভোটের হিসাব-নিকাশের ব্যবধানের সাথে আসনপ্রাপ্তির ব্যবধানের তারতম্যে হতবাক ও বিস্মিত হয়ে পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয়। এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগের সংসদ ছাড়া বাংলাদেশের অপর কোনো সংসদ এর আগে মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। এ নির্বাচনের ফলাফল বিষয়ে আওয়ামী লীগ বরাবর সন্ধিহান থাকলেও দীর্ঘ দিন ধরে সরাসরি কাউকে দায়ী করে আওয়ামী লীগ প্রধান কোনো বক্তব্য দেননি। এ বিষয়ে দীর্ঘ দিনের নীরবতা ভেঙে গত বছর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে দলের অঙ্গসংগঠনের অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদানকালে প্রধানমন্ত্রী সে নির্বাচনটিতে পরাজয়ের জন্য ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা RAW এবং সে দেশের বিদেশ মন্ত্রকের সাউথ ব্লকের কূটকৌশলকে দায়ী করেন। আওয়ামী লীগ প্রধানের এ বক্তব্য-পরবর্তী অদ্যাবধি ভারতের RAW বা সাউথ ব্লক বা সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য বা বিবৃতি দেয়া হয়নি। আর বক্তব্য না দেয়ার কারণে এ দাবির সত্যতার বিষয়টি কোনো ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়েনি।
২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির যে শোচনীয় পরাজয় ঘটে তা দলটির জন্য ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ফলাফলের সম-অভিজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ। এ নির্বাচনটি অনুষ্ঠান-পরবর্তী ভারতের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়, নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত করার জন্য ভারত আওয়ামী লীগকে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ দিয়েছিল। বিএনপি প্রধানের পক্ষ থেকেও একাধিকবার ভারতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত বক্তব্য উচ্চারিত হয়। সে নির্বাচনটি অনুষ্ঠানকালীন প্রণব মুখার্জি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। পরে তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অবসর-পরবর্তী তার সম্প্রতি প্রকাশিত বই ‘কোয়ালিশন ইয়ার্স ১৯৯৬-২০১২’এ উল্লেখ করেন- ‘হাসিনা ও খালেদা দুই বেগমকে কারান্তরীণ হতে মুক্তি এবং সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদের নিরাপদ প্রস্থানে তিনি কার্যকর ভূমিকা রেখেছিলেন।’
এখানে কার্যকর ভূমিকা যে বিষয়টির ইঙ্গিত দেয় তা হলো, সে সময় প্রণব মুখার্জি ও মইন ইউ আহমেদের সাথে পারস্পরিক আলাপের মধ্য দিয়ে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ী হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিতকরণ এবং তৎপরবর্তী আওয়ামী লীগ নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে আলাপের মাধ্যমে মইন ইউ আহমেদের সসম্মানে সেনাপ্রধান থেকে অবসর-পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রে নিরাপদে পাড়ি দেয়ার পথ সুগম। প্রণব মুখার্জির বইয়ে উল্লিখিত বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত সাবেক সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদের কাছ থেকে কোনো বক্তব্য না আসায় অবলীলায় এটিকে সত্য মর্মে গ্রহণ করা যায়।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচন তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বর্জন করে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল-পরবর্তী দলীয় সরকারের অধীন সংসদ বহাল থাকাবস্থায় এ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়। এরশাদ নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির অবস্থানও এ নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিপক্ষে ছিল। এ নির্বাচনটি অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বিশেষ বিমানযোগে ঝটিকা সফরে ঢাকায় এসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং জাতীয় পার্টি প্রধান এরশাদের সাথে একান্ত বৈঠক করেন। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার সাথে সুজাতা সিংয়ের আলোচনার বিষয়বস্তু গণমাধ্যমে প্রকাশিত না হলেও এরশাদের সাথে কী আলোচনা হয়েছিল তা এরশাদ নির্দ্বিধায় গণমাধ্যমের কাছে প্রকাশ করেন। এরশাদ দাবি করেন, সুজাতা সিং তার সাথে আলাপকালে তার দল যেন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, সে বিষয়ে ভারতের অবস্থানের কথা জানিয়ে অন্যথায় এ দেশে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে মৌলবাদের উত্থান হবে মর্মে তাকে সতর্ক করেন। উল্লেখ্য, সুজাতা সিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালীন ভারতে কংগ্রেস দল ক্ষমতাসীন ছিল। ইতিহাসের নির্মম পরিহাস সুজাতা সিং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যে তথাকথিত মৌলবাদের উত্থানে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন, তার সফরের পরবর্তী বছর ভারতে অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনে তার চেয়ে অধিক উগ্র হিন্দুত্ববাদী মৌলবাদের উত্থান তার নিজ দেশে ঘটে। স্বভাবতই প্রশ্ন দেখা দেয়, যারা নিজ দেশে মৌলবাদ মোকাবেলায় অক্ষম, তারা কী করে অপর দেশে তথাকথিত মৌলবাদের উত্থানকে হুমকি হিসেবে দেখে।
দশম সংসদ নির্বাচনে একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য উন্মুক্ত ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৪টি আসনের প্রার্র্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এরূপ নির্বাচন সংবিধানসম্মত কি না তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। এ নির্বাচনটির প্রাক্কালে নির্বাচনে অংশ নেয়ায় অনীহ জাতীয় পার্টি প্রধান এরশাদকে অসুস্থতার নামে সিএমএইচে ভর্তি হতে বাধ্য করা হয়। অপর দিকে এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদকে জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে এনে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ করানো হয়। এ নির্বাচনটি প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অনুপস্থিতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ও অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় এটি অনিয়ম, অস্বচ্ছতা, কালিমা ও কলুষতায় ভরপুর ছিল। নির্বাচনটিতে যে ১৫৬টি আসনে ভোটগ্রহণের কার্যক্রম চলে, তাতে ভোটার উপস্থিতি খুবই নগণ্য ছিল। এ নির্বাচনটি ভারত ও ভুটানের দু’জন করে চারজন পর্যবেক্ষক ব্যতীত অপর কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের নির্বাচনী পর্যবেক্ষকেরা পর্যবেক্ষণ করেননি এবং প্রচলিত নিয়মনীতির ব্যত্যয়ে উপরোল্লিখিত চারজন নির্বাচন পর্যবেক্ষকের পর্যবেক্ষণ সংশ্লেষে সাকুল্য ব্যয়ভার নির্বাচন কমিশন বহন করে।
এ দেশের সচেতন মানুষের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে, ভারতের কূটকৌশল ও সমর্থনের কারণেই তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে এরূপ একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ও অংশগ্রহণবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠান-পরবর্তী ক্ষমতায় বহাল থাকা সম্ভব হয়েছে। দশম সংসদ নির্বাচনটি অনুষ্ঠানকালীন এটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ও অংশগ্রহণবিহীন হওয়ার কারণে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল, নেহায়েত সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে এবং এক বছরের মধ্যে প্রকৃত অর্থেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রতি ভারতের অব্যাহত সমর্থনের কারণে আওয়ামী লীগ নির্বাচন বিষয়ে তার ব্যক্ত প্রতিশ্রুতি থেকে ফিরে এসে বলতে শুরু করে, নির্ধারিত মেয়াদান্তে ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে দলীয় সরকারের অধীন একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের এক বছরের কিছু অধিক সময় অবশিষ্ট থাকাবস্থায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ঢাকায় সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ‘যৌথ পরামর্শ কমিশন’-এর বৈঠকে এলেও মূলত তিনি একাদশ সংসদ নির্বাচন বিষয়ে আওয়ামী প্রধান শেখ হাসিনা, বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়া এবং জাতীয় পার্টি নেত্রী রওশন এরশাদের সাথে সাক্ষাৎ করে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং এতে সব দলের অংশগ্রহণ যেন নিশ্চিত হয় তার ওপর জোর দেন।
বাংলাদেশ অভ্যুদ্বয়-পরবর্তী বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয়ে ভারত যেভাবে প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপ করে আসছে, পাকিস্তান ছাড়া উপমহাদেশের অন্যান্য রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও ভারতের অনুরূপ হস্তক্ষেপ দৃষ্টিগ্রাহ্য। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তিধর রাষ্ট্র চীন বিশ্বব্যাপী উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশে তার উপস্থিতি ও প্রভাব বাড়ানোর যে পরিকল্পনা নিয়েছে তা থেকে বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের অপরাপর রাষ্ট্রও বাইরে নয়। উপমহাদেশের অপরাপর রাষ্ট্রের সাথে চীনের অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানো ভারত সহজভাবে মেনে না নিয়ে এটিকে তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক স্বার্থের পরিপন্থী হিসেবে দেখতে চায়। আর এ কারণে উপমহাদেশের যেসব রাষ্ট্র চীনের সাথে সহযোগিতা বাড়ানোর হাত প্রশস্ত করতে চায়, ভারত সেসব রাষ্ট্রের ওপর রুষ্ট।
পৃথিবীর যেকোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একটি সরকারের মেয়াদ অবসান-পরবর্তী কোন ধরনের সরকারের অধীনে কী পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তা নির্ধারণের দায়িত্ব জনমতের প্রতিফলনে সরকারের ওপর ন্যস্ত। ইতঃপূর্বে নির্বাচন বিষয়ে জনমতের বিপরীতে ভারতের আকাক্সক্ষায় আমাদের দেশের মানুষ একাধিকবার নিরপেক্ষ নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ভোট প্রদানে বিফল হয়েছে অথবা কাক্সিক্ষত ফলাফল পেতে ব্যর্থ হয়েছে। এ বিষয়ে চারটি নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভারতের যে নগ্ন হস্তক্ষেপ ঘটেছিল, তা বিভিন্ন সময়ে এ দেশে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা, বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়া এবং জাতীয় পার্টি প্রধান এরশাদের বক্তব্যে ফুটে উঠেছে। আগামী নির্বাচনে ভারতের অনুরূপ হস্তক্ষেপ ঘটুক, তা এ দেশের মানুষের প্রত্যাশার অতীত। আর তাই অতীতের নিরপেক্ষ নির্বাচন ভারতের ইচ্ছায় প্রভাবিত হওয়ার কারণে দেশটির ইচ্ছাধীন নির্বাচন কখনো আমাদের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার জন্য সহায়ক নয়।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
সূত্র: নয়াদিগন্ত
Discussion about this post