অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
পশ্চিমা দেশগুলোর ‘মিস ওয়ার্ল্ড’ প্রতিযোগিতা তথা বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতা মূলত নারীর দেহ প্রদর্শনীরই একটি প্রতিযোগীতা, যে কারণে এই প্রতিযোগিতা নিয়ে বিতর্ক চলে আসছে বহুদিন ধরে। এই প্রতিযোগীতার মাধ্যমে নারীকে ভোগ্য পণ্যের মতই সবার সামনে উপস্থাপন করা হয়। বিশেষ করে মুসলিমপ্রধান দেশগুলোই এর বেশি সমালোচনা করে আসছে।
কিন্তু হঠাৎ করেই এ বছর থেকে বাংলাদেশে এই বিতর্কিত প্রতিযোগীতার আমদানি করেছে কিছু কর্পোরেট গ্রুপ। এতে যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়েছেন দেশের সাধারণ, সুশীল ও ধর্মপ্রিয় মানুষ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ এ নিয়ে ব্যপক ক্ষোভ প্রকাশ করছে।
বাংলাদেশে প্রথমবারের মত মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশের ফ্র্যাঞ্চাইজ নিয়ে এসেছে অন্তর শো-বিজ এবং অমিকন ইন্টারটেইনমেন্ট। গত ২৮ জুলাই থেকে এর রেজিস্ট্রেশন শুরু হয় এবং গতকাল শুক্রবার (২৯ সেপ্টেম্বর) এই বিতর্কিত প্রতিযোগিতার গ্র্যান্ডফিনালে অনুষ্ঠিত হয়।
গত ২৭ জুলাই মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘এ ধরনের আয়োজনে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিযোগীরা বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারবে। আর বিশ্ববাসী জানবে, আমাদের নারীরা অন্য দেশের নারীদের চেয়ে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই।’ তিনি বলেন- ‘নারীরা তাঁদের মেধা, সৌন্দর্য, মনন এবং পোশাক-পরিচ্ছদের মধ্য দিয়ে একটা দেশের প্রতিনিধিত্ব করবে। সুতরাং সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় আমাদের অংশগ্রহণে কোনো অসুবিধা নেই।’
নারীদেরকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করার বিতর্কিত একটি প্রতিযোগীতা নিয়ে মুসলিম প্রধান বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে সমালোচনার ঝড় উঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জুড়ে। সরকারি সমর্থনে এমন একটি বিতর্কিত প্রতিযোগীতা বাংলাদেশে আয়োজন করায় সমালোচিত হয়েছে সরকারও।
সুন্দরী প্রতিযোগীতাকে নেতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করে প্রথম আলোতে একজন পাঠক মন্তব্য করেছেন- “মিস ওয়ার্ল্ড, মিস ইউনিভার্স এবং ‘মিস আর্থ’ সুন্দরী প্রতিযোগিতা হিসেবে বিশ্বে প্রচলিত রয়েছে। আসলে এগুলো বর্তমান কর্পোরেট জগতে পুরুষদের ভোগ প্রবণতা উস্কে দেওয়ার কার্যকর পন্থা। যার টাকা আছে সে এই বাছাইকৃত সুন্দরীদের ভোগ করবে। আগের দিনের রাজা বাদশারা হেরেমে যা করতো সেটার আধুনিক সংস্করণ আর কি! বাংলাদেশের সাবান আর টিভি কোম্পানির এই জাতীয় অনুষ্ঠানের বিশিষ্ট বিচারক একজন প্রতিযোগীকে কমেন্টস দিয়েছেন, “তোমার পারফরমেন্স ভালো হয়েছে তবে আজকে আমি তোমার যৌবনের আবেদনটা পেলাম না!!” বুঝুন ঠ্যালা।”
আশ্চর্যের ব্যপার হলো এই প্রতিযোগীতায় দেহ প্রদর্শনীর মাধ্যমে নারীদেরকে বাজারি পণ্য বানালেও বাংলাদেশের নারীবাদিরা এ ব্যপারে কোনো উচ্চবাচ্চ্যই কখনো করেনি। প্রথম আলোতে আরেকজন পাঠক তাদের উদ্দেশ করে মন্তব্য করেছেন- “মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিগুলি নারীদের তাদের পন্যের মত ব্যবহার করছে আর নারী অধিকারগুলি চুপ মেরে আছে।”
এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এনিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সকল শ্রেণীর মানুষ। ওবায়দুর রহমান নামে একজন মন্তব্য করেছেন- “নিজের দেহ ভাড়া দিয়ে বা প্রর্দশন করে আয় করা সম্মানের কিছু নয়। অতি প্রাচীন কাল থেকেই যদিও তা চলে আসছে। সুন্দরী প্রতিযোগীতা বা নাটক সিনেমায় অহেতুক শরীর প্রর্দশন করে আজকাল কিছু নারী পুরুষ পয়সা আয় করছে। সমাজে তাদের নাকি কদর ও খুব। শুধু কি নাটক সিনেমা? কর্পারেট হাউজ গুলিতে গেলে এমন বহু নারী দেখবেন যাদের কাজেই হল নিজেকে পন্যর মত অন্যর কাছে তুলে ধরা। একদল শক্ত সামর্থ অলশ লোক এই বলে ভিক্ষা করে যে তাদের কোন কাজ নেই । তেমনি এই লোকগুলিও শরীর বিক্রির আগে এমন বহু যুক্তি দাড় করায়। যে মানুষ নিজের শ্রম আর মেধা দিয়ে আয় করে সেই প্রকৃত মানুষ। আর যারা কায়দা করে অর্থ উপার্জন করে এদের জন্য শুধুই ঘৃনা।”
দুর্নীতি দমন কমিশন(দুদক) এর উপ পরিচালক ড. মোহাম্মদ জহিরুল হুদা তার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে সুন্দরী প্রতিযোগিতা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে লিখেছেন- “মেয়েদের প্রতি তত দিন পর্যন্ত সহিংসতা বন্ধ হবে না, যত দিন না পর্যন্ত তারা নিজেদেরকে ভোগ্য পণ্য হওয়া বন্ধ করবে।”
এদিকে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হওয়া মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহনকারী প্রতিযোগীদের উদ্দেশ করে পুরুষ বিচারকদের কতিপয় কটু মন্তব্যও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ভাইরাল হওয়া সেই পোষ্টগুলোতে বলা হচ্ছে- ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ এর বাছাই পর্বে একটা মেয়ে জিনস, টপস আর টপসের উপর লং একটা কোট পরে স্টেজে আসল। জাজদের আসনে দুইজন পুরুষ, একজন মহিলা বসা। একজন পুরুষ জাজ বলল, ‘তুমি কোটটা খুলে ফেলো, তোমাকে যদি নাই দেখতে পারি তাহলে তোমাকে আমরা কিভাবে সিলেক্ট করব?’ মেয়েটা কোট খুলে ফেলল। আর তিন জোড়া চোখ মেয়েটাকে খুব ভালমত দেখতে লাগল।
ভাইরাল হওয়া পোষ্টগুলোর আরেক যায়গায় বলা হয়েছে- “অন্যদের থেকে তুলনামূলক শালীন পোশাক পরা একটি মেয়েকে একজন জাজ প্রশ্ন করল, ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ হতে গিয়ে তোমাকে যদি কোন ডিসঅনেস্টির মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তুমি কি যাবে? মেয়েটা বলল, না। জাজ বলল, আমার মনেহয় তোমার আরও শেখার বাকি আছে। পরবর্তী সময়ের জন্য অপেক্ষা করো।”
ভাইরাল হওয়া এই তথ্যগুলোর সত্যতা যাছাই করা সম্ভব না হলেও সচরাসচর সুন্দরী প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠানগুলোতে বিচারকরা এমন আচরণই করে থাকেন। নারীকে ভোগ্য পণ্য বানানোর মিশন নেয়া এসব কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারের পক্ষ থেকেই সমর্থন দেয়া হয়। নারীবাদি সংগঠনগুলোর চোখেও এসব কর্মকাণ্ড অপরাধের পর্যায়ে পড়েনা। এছাড়া টাকার খেলায় কেউই তাদের বিরুদ্ধে উচ্চবাচ্চ করার সাহস পায় না।
বাংলাদেশের সাধারন ও ধর্মপ্রিয় মানুষ সুন্দরী প্রতিযোগীতাকে চরিত্র ধ্বংসের হাতিয়ার হিসেবে মনে করছে। তাদের মতে এই পশ্চিমা বিতর্কিত এই প্রতিযোগীতা ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে কোনোভাবেই চলতে পারে না। ইসলামি দলগুলোও ভবিষ্যতে এরকম অনুষ্ঠান আয়োজন হলে রাজপথে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
প্রত্যেক জনগোষ্ঠীই তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে তাদের জাতিসত্তার পরিচয় তুলে ধরতে চায়। কিন্তু আমরা হলাম এর সম্পূর্ণ বিপরীত। আমদানি করা সংস্কৃতির পূজা করতেই আমরা বেশি ভালবাসি। পাশ্চাত্যের উলংগ সংস্কৃতির চর্চা করে আমরা এখন উলংগ হয়ে পথে বসেছি। সংস্কৃতি চর্চার নামে দেশে আজ যা চলছে তা ভাবতেও কষ্ট লাগে। একটি মুসলিম দেশে সংস্কৃতির নামে যে ধরনের অশ্লীল বেহায়াপনা চালু হয়েছে তা আমাদের জাতিসত্তাকে একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছে। আমরা যেন একেবারে ভুলে গিয়েছি আমাদের পরিচয় ও অতীত ইতিহাস।
Discussion about this post