এ কি ‘সর্ষের মধ্যেই ভূত’? যে জাতিসংঘ মিয়ানমারের রাখাইনে স্থানীয় সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানকে ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’ বলে আখ্যা দিয়েছে, সেই জাতিসংঘেরই দায়িত্বরত নেতৃত্ব নাকি এই ভয়াবহ সংকটের বিষয়টি চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
জাতিসংঘেরই একজন সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা, কয়েকজন ত্রাণকর্মী ও স্থানীয় সূত্রের বরাত দিয়ে তৈরি করা এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এ কথা জানিয়েছে আন্তর্জাতিক একটি সংবাদমাধ্যম। সূত্রগুলো বলছে, খোদ মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসংঘের মিশন প্রধানই মানবাধিকার উপদেষ্টাদের ‘স্পর্শকাতর রোহিঙ্গা এলাকায়’ পরিদর্শনে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন।
ওই সংবাদমাধ্যমটি এই অভিযোগ যাচাইয়ে যোগাযোগ করলে জাতিসংঘের মিয়ানমার মিশন তা ‘পুরোপুরি অস্বীকার’ করে।
কিন্তু মিয়ানমারের ভেতরের ও বাইরের সূত্রগুলো সংবাদমাধ্যমটিকে বলছে, এবার নতুন করে সহিংসতা ছড়ানোর চার বছর আগে রাখাইনে মানবিক সংকট তৈরি হলে জাতিসংঘ কান্ট্রি টিমের (ইউএনসিটি) প্রধান রেনাতা লক-ডেসালিয়েন সংকটটি সুরাহার প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ান।
কানাডিয়ান ওই কূটনীতিক সেসময় প্রথমত, রোহিঙ্গা অধ্যুষিত স্পর্শকাতর এলাকায় প্রবেশে মানবাধিকার নেতৃত্বকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন; দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গাদের পক্ষে গণপ্রচারণা বন্ধের চেষ্টা করেন এবং তৃতীয়ত, সেসময়ের সংঘাতের ধারাবাহিকতা ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞে’ পরিণত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশকারীদের কোণঠাসা করে ফেলেন, এমনকি অনেককে চাকরিচ্যুতও করে ফেলেন।
মিয়ানমারে ইউএনসিটি প্রধানের কার্যালয়ের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করা ক্যারোলিন ভ্যান্ডেনাবিলে নামে এক ত্রাণকর্মী জানান, তিনি চার বছর আগেই জাতিগত নিধনযজ্ঞের সংকেত দেখতে পেয়েছিলেন। ১৯৯৩ সালের শেষ থেকে ১৯৯৪ এর শুরু পর্যন্ত রুয়ান্ডায় গণহত্যার সময় সেখানে দায়িত্ব পালন করেন এই নারী ত্রাণকর্মী। সেই অভিজ্ঞতা থেকে ক্যারোলিন জানান, মিয়ানমারে পৌঁছানোর পরই রুয়ান্ডার মতোই উদ্বেগজনক আলামত দেখা যায়।
এই ত্রাণকর্মী বলেন, আমি তখন রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের বিষয়ে একদল বিদেশি ও বার্মিজ ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলছিলাম। এক বার্মিজ আমাকে হতবাক করে বললো, ‘এই রোহিঙ্গা কুত্তাদের মেরে ফেলা উচিত’। কোনো মানুষকে এই পর্যায়ে অবাঞ্ছিত করার আলামতটা হলো যে, আপনি এমন সমাজে আছেন যেখানে ব্যাপারটার স্বাভাবিক গ্রহণযোগ্যতা আছে।
ক্যারোলিন জানান, তিনি এক বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করেছেন রেনাতার সঙ্গে, যিনি আফগানিস্তান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, রুয়ান্ডার মতো সংঘাতকবলিত দেশে দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। রেনাতার কার্যালয়ের আবাসিক সমন্বয়ক পদে দায়িত্ব পালনকালে রাখাইনে ক্রমেই উষ্ণ হতে থাকা রোহিঙ্গা সংকটে জাতিসংঘের তৎপরতা সামনে থেকে দেখেছেন ক্যারোলিন।
তিনি জানান, ২০১২ সালে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সংখ্যাগুরুদের সংঘাত বাঁধলে শতাধিক মানুষ প্রাণ হারায়। উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে লাখোধিক রোহিঙ্গা। তারপর থেকেই রাখাইনে সহিংসতা বেড়েছে, রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে। সেসময় থেকেই রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ সরবরাহকারীদের বাধা দেওয়া হয়েছে এবং ত্রাণবাহী গাড়িতে হামলার ঘটনাও ঘটেছে।
ক্যারোলিনের মতে, এই অবস্থা জাতিসংঘ ও অন্যান্য ত্রাণ সহযোগিতা সংস্থাকে জটিল পরিস্থিতে ফেলে দেয়। তারা বুঝতে পারলো, মানবাধিকার এবং বাস্তুহারা রোহিঙ্গাদের পক্ষে কথা বললে বৌদ্ধদের সহিংস অংশ ও মগরা ক্ষুব্ধ হবে। সেজন্য সহিংসতা থামানোর পদক্ষেপের বদলে রাখাইনে দীর্ঘ-মেয়াদী উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেয় জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থা। তারা সেসময় অভিমত দেয় যে, রাখাইন অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়ে গেলে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে অন্যদের উত্তেজনা কমে যাবে।
এই ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে জাতিসংঘের কর্মীদের ওপর একপ্রকার নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়, যেন রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার বা সে সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো কথা না বলা হয়। সেসময় জাতিসংঘের রাখাইন বিষয়ক অনেক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতেই রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার এড়িয়ে যাওয়া হয়। এই সুযোগে মিয়ানমার সরকারও তারপর থেকে রোহিঙ্গাদের তাদের নাগরিক হিসেবে অস্বীকার করতে থাকে। এমনকি এই শব্দটি ব্যবহার পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে তাদের ‘বাঙালি’ বলে আখ্যা দিতে থাকে।
ক্যারোলিন বলেন, আমার দায়িত্ব পালনকালে খুব কম কর্মকর্তাই রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সাবলীলভাবে কথা বলার ইচ্ছে দেখাতেন। এখন রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারে জাতিসংঘের অভ্যন্তরীণ একটি তদন্তে দেখা যাচ্ছে, বন্ধ দরোজার ওপাশে আসলে সমস্যাটিকে একপেশে করে ফেলা হয়েছে।
রাখাইনে ত্রাণ সহায়তায় দায়িত্বরত কয়েকটি সংস্থার একাধিক সূত্র জানায়, সেসময় এমন অবস্থা দাঁড়ায়, মিয়ানমারে জাতিসংঘের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার বিষয়ে বার্মা কর্তৃপক্ষকে কিছু জিজ্ঞেস প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এ বিষয়ে ক্যারোলিন বলেন, এটা তখন সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, রোহিঙ্গা সমস্যা অথবা জাতিগত নিধনযজ্ঞের সতর্কতা নিয়ে জাতিসংঘের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে প্রসঙ্গ তোলা ছিল একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।
এই ত্রাণকর্মীর মতে, আপনি এমন নীতি হয়তো নিতে পারেন, কিন্তু এরও তো একটা পরিণতি আছে। আপনাকে বৈঠকে ডাকা হবে না, পরিদর্শক দলকে অনুমোদন দেওয়া হবে না, বিরুদ্ধবাদী কর্মীদের চাকরি খেয়ে দেওয়া হবে, অন্যদের বৈঠকে হেনস্তা করা হবে। এমন পরিবেশ তৈরি করা হয় যে, এই ইস্যুতে কথাই বলা যাবে না। এজন্য রোহিঙ্গা ইস্যু বর্তমান নেতিবাচক পরিণতিতেই পৌঁছালো।
ক্যারোলিন জানান, ওই সময় জাতিসংঘের মানবাধিকার সহায়তা সমন্বয় বিষয়ক কার্যালয়ের (আনোচা) প্রধানকে এ ধরনের বৈঠক থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে বাইরে রাখা হতো। ক্যারোলিনকে প্রায়ই বলা হতো, কখন আনোচা প্রধান শহরের বাইরে যান, তা খেয়াল করতে, যাতে তারা বৈঠক করতে পারেন।
এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমটি আনোচা প্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। কিন্তু সংবাদমাধ্যমটি বলছে, জাতিসংঘেরই আরও কয়েকটি সূত্র তাদের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
মিয়ানমারে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূতের দায়িত্ব পালন করা টমাস কুইনতানা জানান, তাকেও রেনাতা রাখাইনে যেতে বারণ করেছিলেন। কারণ জানতে চাইলে রেনাতা আর কোনো জবাব দেননি কুইনতানাকে। যদিও পরে কুইনতানা সেখানে গিয়েছিলেন, কিন্তু এক্ষেত্রে তাকে অসহযোগিতাই করেন ইউএনসিটি প্রধান।
মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসংঘের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, রোহিঙ্গাদের বিসর্জন দিয়ে আমরা রাখাইনের অন্য জনগোষ্ঠীকে তুষ্ট করতে কাজ করছিলাম। মিয়ানমার সরকার জানে, আমাদের কীভাবে ব্যবহার এবং প্রভাবিত করতে হয়, তারা এখনও তাই করছে। তবু আমরা কিছু শিখতে পারিনি। আমরা কখনোই রোহিঙ্গাদের পক্ষে দাঁড়াতে পারিনি, কারণ আমরা চাইনি সরকার ক্ষুব্ধ হোক।
রাখাইনের সেই সংঘাতকালে জাতিসংঘের প্রধান কার্যসূচি নিরীক্ষায় ২০১৫ সালে একটি কমিটি গঠিত হয়। ‘পিচ্ছিল ঢালুস্থান: ভিকটিমকে সহায়তা নাকি নিপীড়নের পদ্ধতিকে সমর্থন’ শিরোনামের ওই নিরীক্ষা সংবাদমাধ্যমটির হস্তগত হয়েছে। এতেই প্রধানত জানা গেছে মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসংঘ মিশনের তৎপরতা।
জাতিসংঘের মহাসচিব পদে আন্তোনিও গুতিয়েরেস দায়িত্বগ্রহণের পর গত এপ্রিলে তৈরি করা এক স্মারকে মিয়ানমারে সংস্থাটির তৎপরতাকে ‘স্পষ্টত অকার্যকর’ বলে উল্লেখ করা হয়। ওই স্মারকের পর জাতিসংঘের পক্ষ থেকে স্বীকার করা হয়, রেনাতাকে ‘ঘুরপাক’ খাওয়ানো হচ্ছিল, কিন্তু তার দায়িত্বপালন নিয়ে কিছু বলার নেই।
এ বিষয়ে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি’র ঘনিষ্ঠ মিত্র বলে পরিচিত সাবেক সেনা কর্মকর্তা শ্যু ম্যন বলেন, রেনাতার দৃষ্টিভঙ্গি নিরপেক্ষ এবং তিনি পক্ষপাতী নন। যারা রোহিঙ্গাদের প্রতি পক্ষপাতী, তারাই কেবল রেনাতাকে পছন্দ করেন না এবং তার সমালোচনা করেন।
এ বিষয়ে রেনাতার সাক্ষাৎকার চাওয়া হলে তিনি তা দিতে অস্বীকার করেন। আর ইয়াঙ্গুনে নিযুক্ত জাতিসংঘের মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ সংলাপে রেনাতা বাধা দিয়েছেন বলে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, আমরা তার সঙ্গে পুরোপুরি ভিন্নমত পোষণ করি। কিভাবে রাখাইনে শান্তি ও নিরাপত্তা, মানবাধিকার, উন্নয়ন ও মানবিক সহায়তা কার্যক্রমকে সহযোগিতা করা যায়, সে বিষয়ে জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর সঙ্গে সবসময় সমন্বয় করেছেন জাতিসংঘের এই আবাসিক কো-অর্ডিনেটর।’
একটি সূত্র বলছে, জাতিসংঘ এখন রাখাইনে তাদের তৎপরতার তদন্তের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমন তদন্ত শ্রীলঙ্কায় তামিল গেরিলাদের সঙ্গে সরকারি বাহিনীর গৃহযুদ্ধের অবসানের পর হয়েছিল, ওই তদন্তের প্রতিবেদন অবশ্য এখনও হাতে আসেনি।
গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ার পর ৪ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। এই অভিযানের ফলে বাস্তুহারা হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে ৫ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। অভিযানকালে রোহিঙ্গাদের অজস্র বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে সেনাসদস্য ও মগরা।
সূত্র: বাংলানিউজ
Discussion about this post