অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
নিজের অতীত কর্মকাণ্ড ভুলে গিয়ে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান খায়রুল হক। দেখা যাচ্ছে একই পথে হাটছেন সুপ্রিম কোর্টের আরেক সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকও। তিনিও ভুলে গেছেন সংসদকে নিয়ে তার দেয়া সেই বক্তব্য ও নিজের দুর্নীতির কথা।
রোববার একটি আলোচনা সভায় বিচারপতি মানিক ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে অযাচিত মন্তব্য করেছেন। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় পাকিস্তানের আইএসআই লিখে দিয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। এজন্য প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে পদ এবং দেশ ছাড়তে হবে বলেও তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।
খায়রুল হকের মতো তার এ বক্তব্য নিয়েও এখন সারাদেশে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। সবাই বিচারপতি মানিকের সংসদকে নিয়ে সেই বক্তব্য ও তার দুর্নীতির কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। এমনকি সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদও এনিয়ে তার সমালোচনা করেছেন। অ্যানালাইসিস বিডির অনুসন্ধানে উঠে এসেছে তার অতীত অপরাধনামা।
২০১২ সালে সংসদের তৎকালীন স্পিকার ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের দেয়া একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে বিচারপতি মানিক সংসদ ও স্পিকারকে নিয়ে কটাক্ষ করেছিলেন। স্পিকারের উকালতির সনদ বাতিলেরও দাবি তুলেছিলেন বিচারপতি মানিক। এনিয়ে তখন সংসদ ও সংসদের বাইরে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। স্পিকার আব্দুল হামিদ তখন বলেছিলেন, হাইকোর্টের বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী জাতীয় সংসদ এবং সংসদের স্পিকার সম্পর্কে কটাক্ষ করে সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। সংসদে আমার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একজন বিচারপতি সংবিধানের ৭৮(১) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করে সংসদ সম্পর্কে, আমার সম্পর্কে যে সব মন্তব্য করেছেন, তা কোনো বিবেকবান মানুষ উচ্চারণ করতে পারেন কি না, আমার সন্দেহ আছে।
বিচারপতি মানিকের এমন মন্তব্যে তখন সংসদ উত্তাল হয়। মহাজোটের এমপিরা মানিকের অপসারণে স্পীকারের রুলিং দাবি করেন। প্রয়াত সুরঞ্জিত সেন বলেছিলেন, যদি প্রধান বিচারপতি উদ্যোগ নিয়ে জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন না করেন, তাহলে সংসদ তার সার্বভৌমত্ব রক্ষায় পূর্বের ক্ষমতা ফিরিয়ে এনে এই বিচারপতিকে অপসারণ করবেন।
তোফায়েল আহমেদ বিস্ময় প্রকাশ করে পয়েন্ট অব অর্ডারে বলেছিলেন, বিচারপতি মানিককে আমাদের সাবেক আইনমন্ত্রী খসরু সাহেব নিয়োগ দিয়েছিলেন। বিএনপি ক্ষমতায় এসে তাকে নিশ্চিত করেনি। আবার আমরা ক্ষমতায় এসে তাকে স্থায়ী করেছি। সে কিনা সংসদকে নিয়ে এমন মন্তব্য করে! বিচারপতি মানিকের কাজ হলো মানুষকে অপমান করা। এটা তার টেনডেনসিতে (প্রবণতায়) পরিণত হয়েছে। এই বিচারপতি মানিক বিমানের থার্ড ক্লাসের টিকিট কেটে বিজনেস ক্লাসে বসে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা সম্ভব না হওয়ায় তিনি বিমানের কর্মকর্তাকে তলব করেন। কতটা নির্লজ্জ হলে এমন করা সম্ভব।
আর পয়েন্ট অব অর্ডারে সরকার দলের আর এক সংসদ সদস্য শেখ সেলিম বলেছিন, সংসদের সার্বভৌমত্বে হুমকি স্বরূপ আদালতের এমন আদেশ সংবিধানের সরাসরি লঙ্ঘন। এই বিচারপতিই রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল অপরাধ করেছেন। এই বিচারপতির উচিত সংসদের কাছে নিজের অপরাধ স্বীকার করে বলা আমার ভুল হয়েছে, আমি সংবিধান লঙ্ঘন করেছি আমাকে ক্ষমা করে দিন।
এরপর ১২ সালের ১৮ জুন স্পীকার আবদুল হামিদ সংসদে রুলিং দেন। তিনি মানিকের বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতিকে ব্যবস্থা নিতে বলেন।
স্বাধীনতার পর দেশের বিচার বিভাগে মানিকের মতো এমন দুর্নীতিবাজ বিচারপতি আর কখনো আসেনি। দুর্নীতি ও প্রতারণার দায়ে তার বিরুদ্ধে বিদেশেও মামলা হয়েছে। তিনি দুর্নীতি ও প্রতারণা করে লন্ডনে বাড়ি করেছেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও প্রতারণার ২৯টি সুনির্দিষ্ট প্রমান দৈনিক আমারদেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দিয়েছিলেন। প্রধান বিচারপতির কাছেও দেয়া হয়েছিল।
তিনি হাইকোর্ট বিভাগে ২০০৩ সালের ২ জুলাই পর্যন্ত অস্থায়ী বিচারপতি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। রাষ্ট্রপতি ও সুপ্রিম জুডিশিয়ালের কাছে পেশ করা আবেদনে বলা হয়, সুপ্রিমকোর্টের আচরণবিধি অনুযায়ী বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি থাকা অবস্থায় ভিন্ন কোনো চাকরি করতে পারেন না। অথচ তিনি বিচারপতি থাকা অবস্থায় লন্ডনে ঋণের আবেদনে নিজেকে সেখানে একটি কোম্পানির মার্কেটিং ম্যানেজার হিসেবে দাবি করে আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন।
তারপর, ২০১২ সালের ২৫ জুন জিসান নাসিম নামে এক ব্যক্তি লন্ডনের আদালতে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা দায়ের করেন। জিসান নাসিম পাকিস্তানি নাগরিক। দায়ের করা মামলার দাবি অনুযায়ী ওই ব্যক্তির কাছে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী নিজেকে ইমিগ্রেশন অ্যাডভাইজার হিসেবে পরিচয় দেন। ইমিগ্রেশন অ্যাডভাইজার হিসেবে তিনি ওই ব্যক্তিকে লন্ডন ওয়েস্টমিনস্টার কলেজে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন এবং বলেন, এই কলেজের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা রয়েছে। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী ইমিগ্রেশন অ্যাডভাইজারের পাশাপাশি নিজেকে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের একজন বিচারপতি হিসেবে পরিচয় দিয়ে তাকে কলেজটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। এতে জিসান নাসিম আশ্বস্ত হয়ে বিচারপতি মানিকের পরামর্শে সেই কলেজে ভর্তি হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এজন্য লন্ডনের স্থানীয় মুদ্রায় ১৫ হাজার পাউন্ড ক্ষতিপূরণের মামলা দায়ের করেন তিনি।
এভাবেই বিচারপতি থাকাকালীন শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক দুর্নীতি-প্রতারণা ও সংসদকে নিয়ে অযাচিত মন্তব্য করে পদে পদে সংবিধান ও শপথ লঙ্ঘন করেছেন। কিন্তু তিনিই আজ কথা বলছেন সর্বোচ্চ আদালতের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে। বলছেন রায় নাকি প্রধান বিচারপতির হাতের লেখা নয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, খায়রুল হকের মতো তিনিও নিজের অতীত কর্মকাণ্ড ভুলে গেছেন।
Discussion about this post