মন্ত্রী পদে থেকে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করে শপথ ভঙ্গের কাজ করেছেন বলে মনে করছেন বিশিষ্ট আইনজীবীরা। তাদের মতে, মন্ত্রীর বক্তব্যে দৈন্যতাই ফুটে উঠেছে। এ ধরনের ব্যক্তিরা কিভাবে মন্ত্রী পদে বহাল থাকে- সে প্রশ্নও তুলেছেন তারা। এ ধরনের অভিযোগেই গত বছর খাদ্যমন্ত্রীকে পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা করেছিলেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। রায়ে আপিল বিভাগ বলেছিলেন, তিনি (খাদ্যমন্ত্রী) শপথ ভঙ্গ করেছেন।
বৃহস্পতিবার ঢাকা আইনজীবী সমিতি ভবনের জিল্লুর রহমান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ করে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, ‘তার (প্রধান বিচারপতি) যদি সামান্যতম জ্ঞান থাকে, সামান্যতম বুঝ থাকে, তাহলে তার স্বেচ্ছায় চলে যাওয়া উচিত। তা না হলে সেপ্টেম্বর মাস থেকে আইনজীবীরা তার বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবেন। এখন আর চোখ বুজে থাকার কোনো সুযোগ নেই। আর কোনো রক্তচক্ষু সহ্য করব না। অবশ্যই আমরা তার অপসারণ চাই।’
প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে খাদ্যমন্ত্রীর এ বক্তব্য দিতে পারেন কিনা- জানতে চাইলে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, ‘খাদ্যমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে নীতিনৈতিকতা ও শিষ্টাচারের দৈন্যতাই ফুটে উঠেছে। আমাদের দুর্ভাগ্য এ ধরনের ব্যক্তিরাই বছরের পর বছর মন্ত্রী পদে বহাল থাকেন।’ এই বক্তব্য দিয়ে খাদ্যমন্ত্রী আদালত অবমাননা করেছেন কিনা জানতে চাইলে ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘যাদের নিজেদের আত্মসম্মান বোধ নাই, তাদের পক্ষে অন্যের মানসম্মানের বিষয়টা অনুধাবন করা অসম্ভব।’
প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের বক্তব্য প্রসঙ্গে সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ যুগান্তরকে বলেন, ‘উচ্চ আদালতের রায় নিয়ে খাদ্যমন্ত্রী যা বলছেন, তা আদালত অবমাননার চেয়েও বেশি। এটা অশালীন বক্তব্য। একজন মন্ত্রীর কাছে দেশের মানুষ এটা আশা করে না। মন্ত্রী হিসেবেও তিনি শপথ ভঙ্গ করেছেন। এর আগেও এই খাদ্যমন্ত্রী প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে আপত্তিকর বক্তব্য দিয়ে আদালত অবমাননার দায়ে পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা দিয়েছেন। এটা হয়তো তিনি ভুলে গেছেন। কারণ কামরুল ইসলাম প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে যে বক্তব্য দিয়েছেন- তা একজন মন্ত্রী দিতে পারেন না।’
এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার মইনুূল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘দেশে এখন ভদ্রতা, শিষ্টাচার এগুলো এখন নাই। এই নিয়ে চিন্তা করে লাভ নাই। নির্বাচন ছাড়া এই ধরনের একটা সরকারকে যে জাতি সহ্য করতে পারে, তাদের তো এগুলো সহ্য করতেই হবে। একজন মন্ত্রী প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে এ ধরনের কথা বলতে পারেন না। পাগলের দেশেও এটা হয় না। আমরা একটা অসভ্য ব্যবস্থার মধ্যে আছি।’
মন্ত্রীর বক্তব্যে শপথ ভঙ্গ হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আইনকানুনের কথা নয়, এটা সভ্যতার কথা। প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে পৃথিবীর কোনো দেশের মন্ত্রী এই ধরনের কথা বলেন না। আমরাও চাই না, বারবার আদালত অবমাননার বিষয়টি সামনে আনা হোক। মন্ত্রীর বক্তব্য অশালীন।’
আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ.ম রেজাউল করিম যুগান্তরকে বলেন, ‘সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর পূর্ণাঙ্গ রায়ের বিষয়ে আমরা শনিবার (আজ) বৈঠকে বসছি। সেখানে সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। এরপর সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের অবস্থান জাতিকে জানাব।’ তিনি আরও বলেন, ‘যে যা বলছেন, তা বিচ্ছিন্নভাবে বলা হচ্ছে। ব্যক্তি বিশেষের বক্তব্য নিয়ে এখন কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’
বিশিষ্ট আইনজীবীদের এই মন্তব্য সম্পর্কে জানতে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের মোবাইল নম্বরে কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।
উল্লেখ্য, গত বছর এক অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতিকে সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে বাদ দিয়ে পুনরায় জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর আপিল শুনানি করাসহ তাকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেছিলেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম। এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আদালত অবমাননা হয়েছে বলে মন্ত্রীকে অর্থদণ্ড দেয়া হয়। তিনি শপথভঙ্গ করেছেন বলেও রায়ে উল্লেখ করেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাসহ পাঁচ বিচারপতি রায়ে বলেন, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম তাদের শপথভঙ্গ করেছেন। একই অভিযোগ আনা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বিরুদ্ধেও। তার বক্তব্য নিয়েও একই রায় দেয়া হয়। ওই সময় আইন বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ রায়ের পরে আইনগতভাবে ওইদিন থেকেই খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম পদচ্যুত হয়েছেন। পাবলিক সার্ভেন্ট (ডিসমিসাল অন কনভিকশন) অর্ডিন্যান্স-১৯৮৫ অনুযায়ী আদালতের রায়ে সরকারি কোনো কর্মচারীর ১ হাজার টাকার বেশি জরিমানা হলে তারা আপনা-আপনিভাবে বরখাস্ত হয়েছেন বলে ধরে নেয়া হবে। ওই আইন অনুসারে ৫০ হাজার টাকা জরিমানার সময় থেকেই খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বরখাস্ত হয়েছেন। আর সর্বোচ্চ আদালত বলছেন, তারা শপথ লংঘন করেছেন।
সূত্র: যুগান্তর
Discussion about this post