অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
সম্প্রতি ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে আদালতের দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায়কে ঘিরে তোলপাড় শুরু হয়েছে সারা দেশে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তাঁর পর্যবেক্ষণে গণতন্ত্র, রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, সুশাসন, দুর্নীতি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপসহ বিভিন্ন বিষয়ে কড়া সমালোচনা করেছেন।
বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের, আরো নির্দিষ্ট করে বললে সরকার প্রধানের আমিত্ব ও দাম্ভিকতার বিষয়েও কড়া কথা বলেছেন প্রধান বিচারপতি তার পর্যবেক্ষণে। তিনি বলেছেন, ‘ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে পুরো জাতি, কোনো একজন ব্যক্তি নন।’
আদালতের ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায়ে সরকার ও সরকার প্রধানের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দাম্ভিকতা দেখানোর ক্ষেত্রে বাধা দেওয়ার মতো কোনো নজরদারি বা তদারককারী প্রতিষ্ঠান নেই। এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষারও ব্যবস্থা নেই। নির্বাহী দাম্ভিক নিয়ন্ত্রণহীন হওয়ায় আমলাতন্ত্র কখনোই দক্ষতা অর্জনে সচেষ্ট হবে না।’ তাঁর মতে, মেধা নয়, ক্ষমতার মাধ্যমেই এখন দেশের সব সরকারি প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
রায়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালে আমরা যে অলঙ্ঘনীয় ঐক্য গড়েছিলাম, তা শত্রুরা নস্যাৎ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। আজ আমরা একটি মুক্ত, স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশে বাস করি। অথচ আজ ঔদ্ধত্য এবং অজ্ঞতাকে আমরা প্রশ্রয় দিয়ে চলছি। কোনো একজন ব্যক্তি দ্বারা কোনো একটি দেশ বা জাতি তৈরি হয়নি। আমরা যদি সত্যিই জাতির পিতার স্বপ্নে সোনার বাংলায় বাঁচতে চাই, তাহলে এই আমিত্বর আসক্তি এবং আত্মঘাতী উচ্চাভিলাষ থেকে আমাদের মুক্ত থাকতে হবে। এই আমিত্ব হলো কেবল এক ব্যক্তি বা একজন মানুষ সবকিছুই করতে পারেন এমন ভাবনা।’
রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করছেন প্রধান বিচারপতির এই পর্যালোচনা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের স্বৈরাচারি মনোভাবের প্রতি ইঙ্গিত করেই দেয়া হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে জোরজবরদস্তি করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা দখল করে আছে। পুলিশ দিয়ে বিরোধী দল ও মতকে দমনে তারা সফল হওয়ায় তাদের ঔদ্ধত্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোনো রাজনৈতিক দলকে মিছিল মিটিং কিংবা রাস্তায় পা পর্যন্ত ফেলতে দেয়া হচ্ছে না। এমন অবস্থায় দুর্বল বিরোধী পক্ষকে হটিয়ে ২০২১ বা ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার উচ্চাভিলাষ পোষন করছে আওয়ামী লীগ। প্রধান বিচারপতি এই উচ্চাভিলাষের প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন।
প্রধান বিচারপতি আরো বলেছেন, ‘আমরা যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নগর–পরিকল্পনার দিকে তাকাই, তাহলে দেখি যেই ব্যক্তি তাদের নগরের পরিকল্পনা করেছেন, তাঁকেই তারা স্বীকৃতি দিয়েছে। দাসপ্রথা বিলুপ্তির জন্য আব্রাহাম লিংকনের স্ত্রী মেরি টড স্বীকৃতি পেয়েছেন। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আরও অনেকে স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে চারজন জেনারেলও রয়েছেন। কিন্তু আমাদের দেশে একটি রোগ আমাদের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে। আর সেই রোগের নাম “অদূরদর্শী রাজনৈতিকীকরণ”। এটা একটা ভাইরাস এবং দুর্ভাগ্যবশত আমাদের সংস্কৃতিকে তা এমন বিস্তৃতভাবে সংক্রমিত করেছে যে আমাদের নীতিনির্ধারকেরা এমন একটি ভবিষ্যৎ দেখতে বা কল্পনা করতেও পারছেন না যে ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে পুরো জাতি, কোনো একজন ব্যক্তি নন।’
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, প্রধান বিচারপতি এখানে ক্ষমতাসীন দল কর্তৃক সবকিছুতেই এক ব্যাক্তির অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকেই প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা এবং বিপরীতে অন্যদের নাকচ করার প্রবণতার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। প্রধান বিচারপতি যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরন দিয়ে বুঝাতে চেয়েছেন সে দেশে যে ব্যক্তি যেই অঙ্গনে কাজ করেছেন তাকে সেই অঙ্গনেই স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে এক ব্যক্তি ব্যতিত আর কোনো ব্যক্তির কোনো কৃতিত্বকে স্বীকৃতি দেয়া হয় না। বরং তার বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা বলে তাকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হয়।
এই রায়ে প্রধান বিচারপতি আরো লিখেছেন, ‘এই বাজে রোগের কারণে নীতিনির্ধারকেরা সবকিছু ব্যক্তিকরণ করে ফেলেছেন। তাঁরা তাঁদের ক্ষুদ্র এবং সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে একটি ভুয়া ও “মেকি গণতন্ত্র” প্রতিষ্ঠা করেছেন। আর এটা তাঁরা লজ্জাজনকভাবে আমাদের সংবিধানের অন্যায্য সুবিধা নিয়ে করেছেন। অথচ ১৯৭১ সালে আমাদের শহীদেরা রক্ত দিয়ে এ সংবিধান লিখেছিলেন। আমাদের অবশ্যই এই নোংরা “আমাদের লোক” মতবাদ পরিহার করতে হবে। পরিত্যাগ করতে হবে এই আত্মঘাতী “আমি একাই সব” দৃষ্টিভঙ্গি।
আদালত কর্তৃক রাজনীতি, গনতন্ত্র, সরকার ব্যবস্থা নিয়ে এমন জ্বালাময়ী রায় বাংলাদেশে নজিরবিহীন। বিশেষ করে সরকারি দল বা সরকার প্রধানের আমিত্ব, ঔদ্ধত্য, দাম্ভিকতার ব্যপারে ইঙ্গিত করে আদালতের পর্যালোচনায় আওয়ামী লীগ হতবাক হয়েছে। আপিল বিভাগের সাতজন বিচারপতির মধ্যে পাঁচজন বিচারপতি প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন। এর আগে ১৯৯৬-২০০১ ক্ষমতায় থাকাকালে সুপ্রিমকোর্টের ফুল বেঞ্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রং হেডেড অর্থাৎ মাথা খারাপ, পাগলি বলে রায় দিয়েছিলো।
Discussion about this post