অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসার পরই আওয়ামী লীগ সরকারের বৈধতা নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলসহ আইন বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছিলেন। বিএনপি-জামায়াত এখনও বর্তমান সরকারকে ভোটার বিহীন অবৈধ সরকার বলেই আখ্যায়িত করে থাকে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য প্রথমেই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চেয়েছিল বিচার বিভাগকে। বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে নিতে তারা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস করেছিল। এনিয়ে একজন আইনজীবী রিট করলে দীর্ঘ শুনানির পর সর্বোচ্চ আদালত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ বলে ঘোষণা করেছেন। এতে করে বড় ধরণের হোচট খায় সরকার।
অপরদিকে, নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধির গেজেট প্রকাশ করতে দীর্ঘ দিন সরকারকে সময় দিয়ে আসছে সুপ্রিমকোর্ট। নিম্ন আদালতের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়ে সরকার এনিয়ে টালবাহানা করে পরে গত বৃহস্পতিবার শৃঙ্খলাবিধির খসড়া সুপ্রিমকোর্টে জমা দিয়েছে। এতেও সুপ্রিমকোর্টের দেয়া পরামর্শের উল্টোটা করেছে বলে অভিযোগ করেছেন আদালত। আদালতের বক্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
এদিকে, আইনমন্ত্রীর ক্ষোভ প্রকাশের একদিন পর অর্থাৎ মঙ্গলবার বাতিল হওয়া ষোড়শ সংশোধনীর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছেন আদালত। প্রকাশিত রায়ে নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি সংক্রান্ত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন আদালত। এ রায়ের ফলে নিম্ন আদালতও এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে চলে এসেছে। নিম্ন আদালতের বিচারকদের ওপর সরকার এখন আর কোনো খবরদারি করতে পারবে না।
আর ষোড়শ সংশোধনীর পূর্ণাঙ্গ রায়ে আদালত বর্তমান সংসদকে অকার্যকর বলে মন্তব্য করেছেন। দেশের মানবাধিকার হুমকির মুখে এবং ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতার আরও অপব্যবহার করার দিকে ঝুঁকছে বলেও আদালত তার রায়ে উল্লেখ করেছেন।
সর্বোচ্চ আদালতের আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়েছে, ‘মানবাধিকার হুমকির মুখে, দুর্নীতি অবাধ, সংসদ অকার্যকর, মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত কয়েক কোটি মানুষ আর প্রশাসনে অব্যবস্থাপনা মারাত্মক।
আদালত বলেছেন, প্রযুক্তির উন্নয়ন আর অপরাধের পরিবর্তনশীল মাত্রায় নাগরিকদের জীবন ও নিরাপত্তা অত্যন্ত অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে। রায়ে বলা হয়, ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম নয় আর এসবের সামগ্রিক ফল হলো একটি পঙ্গু সমাজ, এমন একটি সমাজ যেখানে একজন ভালো মানুষ ভালো কোন স্বপ্ন আদৌ দেখে না। কিন্তু‘ মন্দ লোকজন আরও কিছু সুবিধা আদায় করে নিতে নিরন্তর প্রচেষ্টায় রয়েছে।’ রায়ে আরো বলা হয়, ‘এমন একটি পরিস্থিতিতে নির্বাহীরা উদ্ধত আর অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যাচ্ছে আর আমলাতন্ত্র কখনই কার্যকর হওয়ার দিকে ঝুকবেনা।
আদালত বলেন, ‘স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও আমরা কোন সরকারি প্রতিষ্ঠানকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সক্ষম হইনি। ভারসাম্য নিশ্চিত করার কোন ব্যবস্থা নেই। কোন পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা সক্রিয় নয়। ফলে ক্ষমতায় থাকা লোকজন ক্ষমতার আরও অপব্যবহার করার দিকে ঝুঁকছে আর তারা ক্ষমতার যথেচ্ছা ব্যবহারের ধৃষ্ঠতা দেখাচ্ছে।’
রাজনীতি প্রসঙ্গে আরও বলা হয়েছে, ‘রাজনীতি এখন আর ফ্রি নেই। এটা এখন অত্যন্ত বাণিজ্যিক আর চালকের আসনে রয়েছে অর্থ যা কাজের ধারা এবং এর গন্তব্য নিয়ন্ত্রন করে। দেশের সকল সরকারি প্রতিষ্ঠানকে এখন নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষমতা, মেধা নয়। পরিহাসের বিষয় হলো, অটল সংকল্প আর অদম্য উদ্যোম নিয়ে আমরা দেশকে একটি সামরিক ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের থাবা থেকে মুক্ত করতে পেরেছিলাম, কিন্তু আমরা সেই দেশে নিজেদের কাছেই পরাজিত।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিগত ৮ বছর যাবত বিরোধী রাজনৈতিক দল, সমালোচকগণ ও দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলো যে বক্তব্য দিয়ে আসছে, আদালতের রায়ে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। এতদিন যাবত সরকার শাসনের নামে বেপরোয়া দুঃশাসন চালিয়ে আসছে। সরকার কারো কথাকেই কোনো পাত্তা দিচ্ছে না। আদালতের এ রায় এদেশের গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে।
তাদের মতে, আদালত যেখানে সংসদকে অকার্যকর বলেছে, সেখানে এ সংসদের বৈধতা নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর তোলা প্রশ্ন আরও জোরালো হবে। এছাড়া সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী ও ১১৬ অনুচ্ছেদকে আদালত অবৈধ বলে ঘোষণা দিয়েছে। সংসদকে অকার্যকর বলেছে। এখন শুধু বাকী একদলীয় সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করা।
Discussion about this post