ডঃ রূপক ভট্টাচার্য
গত কয়েক বছর ধরে মানবাধিকার লঙ্ঘন, নির্বিচারে গ্রেফতার, গুম, দীর্ঘসময় অন্তরীণ রাখা এবং বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ডের সাক্ষী হয়ে আছে বাংলাদেশ। এছাড়াও সাংবাদিক ও বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) কর্মীদের উপর নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতন এবং চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর সরকারের আরোপিত নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। অধিকন্তু, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ও কিছু পশ্চিমা দেশের চোখে বাংলাদেশ সরকার ‘সামাজিক সহিংসতা’ থেকে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
এই ধরনের হতাশাজনক ঘটনাগুলি তুলে ধরা হয়েছে ২০১৭ সালের ৬ জুলাই নিউইয়র্ক ভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) প্রকাশিত এক রিপোর্টে। এইচআরডব্লিউর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৬ সালের মধ্যে অন্তত ৯০ জন গুমের শিকার হয়েছে। দীর্ঘ সময় আটক রাখার পর তাদের অধিকাংশকে আদালতে হাজির করা হয়, আটক বন্দীদের মধ্যে হত্যা করার ঘটনা ঘটেছে ২১টি আর ৯ জনের কোন হদিসই পাওয়া যায়নি। রিপোর্টে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ৪৮ জনের নিখোঁজ হবার তথ্য পাওয়া গেছে। এর পাশাপাশি, নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা অবস্থায় তীব্র নির্যাতন ও বাজে ব্যবহারের অভিযোগ তো রয়েছেই।
মানবাধিকার গ্রুপটি জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের ২০১৬ সালের মানবাধিকার প্রতিবেদনে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশ সরকারের কঠোর জঙ্গিবাদ বিরোধী কার্যক্রমের ফলে বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ড, টাকার জন্য আটক রাখা, গুম, অত্যাচার, নির্যাতন এবং মানবাধিকারের অন্যান্য অপব্যবহার বেড়ে গেছে। এই প্রতিবেদনটিতে প্রান্তিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের হত্যা এবং চরমপন্থী মত অন্যদের উপর চাপিয়ে দেয়া, বাল্য ও জোরপূর্বক বিয়ে, বিশেষভাবে নারী ও শিশুদের উপর লিঙ্গ-সহিংসতা, কর্ম পরিবেশ এবং শ্রম অধিকারের অপব্যবহারের ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ অনলাইন বক্তৃতা ও সংবাদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে আর নাগরিকদের গোপনীয়তার অধিকার অব্যাহতভাবে লঙ্ঘন করছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষকরা দু:খ প্রকাশ করে বলেছে যে, বাংলাদেশ সরকার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্থানীয় মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হবার পরও এসব ‘ঘৃণ্য কার্যক্রম’ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের মত অনুযায়ী, ‘মানুষকে আটকে রাখার ক্ষেত্রে, তাদের অপরাধ বা নির্দোষতা এবং তাদের শাস্তি নির্ধারণ এমনকি তাদের জীবিত থাকার অধিকার রয়েছে কিনা সে সম্পর্কেও একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী।’
গুম, অপহরণ, নির্বিচার আটক এবং বিচার বহির্ভুত মৃত্যুর জন্য নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে প্রধানত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্যদেরকে দায়ী করা হয়। বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার বিরুদ্ধেও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। রিপোর্টে এছাড়াও বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বিরোধী কর্মীদের আটক করে ইচ্ছাকৃতভাবে পায়ে গুলি করে পংগু করে দিচ্ছে। ভিক্টিমসরা দাবি করেছে যে, পুলিশ তাদের হেফাজতে নিয়ে যায় এবং তারপর তারা বলে যে তারা সশস্ত্র অপরাধীদের সাথে ক্রসফায়ারে আত্মরক্ষা করতে অথবা সহিংস বিক্ষোভের সময় গুলি চালিয়েছে। এর শিকারদের মধ্যে সন্দেহভাজন অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িতরা যেমন রয়েছে তেমনিভাবে রয়েছে বিরোধী দলগুলোর সদস্যরাও।
২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বিরোধী দলের সহিংস আন্দোলন, রাস্তায় ভাঙচুর ও অব্যাহত হরতাল ও অবরোধের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কিন্তু সরকারের এই ধরনের পদক্ষেপে ‘উচ্চমাত্রার’ বাড়াবাড়ির জন্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পক্ষ সমূহ থেকে ব্যাপক সমালোচনা সৃষ্টি হয়। এর বাইরে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্য-প্রণোদিত হত্যাকান্ড এবং সুপরিচিত সাংবাদিক ও বিরোধীদলীয় নেতাদের গুমের রিপোর্টও রয়েছে ।
এই সব কিছু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মধ্য-বাম জোট এবং প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর নেতৃত্বে মধ্য ডান জোট এই দু’টি প্রধান রাজনৈতিক পক্ষের মধ্যে তিক্ত ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সৃষ্ট বলে উল্লেখ করা হয়। এই ধরনের ঘটনাগুলো সমাজের অতি মাত্রায় রাজনৈতিক মেরুকরণ প্রবণতা থেকে সৃষ্ট যা থেকে এমনকি রাষ্ট্রের সবচেয়ে সৃজনশীল অংশ বুদ্ধিজীবী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্নায়বিক কেন্দ্রের ছাত্ররাও মুক্ত নয়।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোও একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় মানুষ স্বাভাবিকভাবে যেসব অধিকার উপভোগ করে তা লঙ্ঘনের জন্যও আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করে। তারা বলেছে, বেশকিছু নতুন আইন সম্প্রতি কার্যকর করা হয়েছে যা মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সীমিত করেছে। মানবাধিকার কর্মীরা বলেছে যে, এনজিওদের বিদেশি অর্থায়ন সূত্র নিরীক্ষণের জন্য অক্টোবর ২০১৬ সালে ফরেন ডোনেশন (ভলান্টারী অ্যাক্টিভিটি) রেগুলেশন অ্যাক্ট পাস করা হয়। এটি মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবি সংস্থাগুলোর স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগকে নিয়ন্ত্রিত করবে। এই আইনটিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের (পিএমও) নিয়ন্ত্রণাধীন এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর অনুমোদন ছাড়া বিদেশি তহবিল প্রাপ্তির উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকার প্রেস কাউন্সিল আইন সংশোধনেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে যার মাধ্যমে সংবাদপত্র বন্ধ করার ব্যবস্থাও এর ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হচ্ছে। কয়েকজন সিনিয়র ও সম্মানিত ব্যক্তিসহ বাংলাদেশের সাংবাদিকরা বর্তমান সরকারের প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছে অব্যাহতভাবে। দেশের শীর্ষ ইংরেজী দৈনিক ‘ডেইলি স্টার’ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজ আনাম এর বিরুদ্ধে ৫৪টি উদ্দেশ্যমূলক মানহানি মামলা করা হয়েছে। তাছাড়া, বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান ও পত্রিকাটির আরো কিছু সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক মানহানি এবং ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার’ অভিযোগ এনে ৫৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকার প্রভাবশালী সরকারি ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রমের সমালোচনাকারীদের বিরুদ্ধে প্রায়ই বিতর্কিত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ব্যবহার করে। এই আইনে পুলিশকে ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে’ এমন অভিযোগ উত্থাপন করে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার জন্য কোনও ওয়ারেন্ট ছাড়াই যে কাউকে গ্রেফতার করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। নাগরিক অধিকার গ্রুপগুলো বলেছে, সরকার একটি সংশোধনী আনার মাধ্যমে জামিনের বিধান রহিত করে এটাকে একটি কালো আইনে পরিণত করেছে। এই ধরনের পদক্ষেপগুলি ধর্মীয় ঘৃণা এবং রাষ্ট্রদ্রোহের উপাদান ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার বন্ধ করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে বলে সরকার যুক্তি দেখালেও বাস্তবে এর অপব্যবহারই বেশি নজরে আসছে।
সরকারের ‘উদ্বেগের’ আরেকটি ক্ষেত্র হলো এনজিওগুলির ক্রমবর্ধমান প্রভাব। দক্ষিণ এশীয় সব দেশের মধ্যে বাংলাদেশে সম্ভবত বিভিন্ন কর্মকান্ডে জড়িত সর্বাধিক সংখ্যক এনজিও রয়েছে। দেখা যায় যে, বাংলাদেশের এনজিওগুলো রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি ‘প্রভাব বলয়’ গড়ে তুলেছে । আওয়ামী লীগ নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে তাদের দৃঢ়ভাবে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনার চেষ্টা করছে।
আসলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে পেছনের নিয়ে যাবার প্রবণতা হিসাবে দেখা উচিত। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে যেখানে সরকারি অঙ্গ, কার্যকরী প্রতিষ্ঠান এবং পেশাদার গোষ্ঠিগুলো সরকারি দলের অধিভুক্ত বা কমপক্ষে সহানুভূতিশীলতার ভিত্তিতে রাজনীতিগতভাবে মেরুকরণ হয়ে গেছে সেখানে এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সর্বশেষ এইচআরডব্লিউ রিপোর্টটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে বাংলাদেশ সরকারের একজন উচ্চ-সমালোচক ব্যক্তিত্বের অদৃশ্য হওয়ার দুই দিন পর এটি প্রকাশ হওয়ার কারণে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্রমাগত মানবাধিকার লঙ্ঘন বাংলাদেশে একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশটিতে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা। সাম্প্রতিক সময়ে, নিখোঁজ রাজনৈতিক কর্মীদের ২২ জন মা ‘মায়ের আকুতি’ (মাদার কল) নামের একটি অনুষ্ঠানে তাদের ছেলেমেয়েদের অবস্থান সম্পর্কে জানাতে আওয়ামী লীগ সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে।
আর দেরি না করেই নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা কমাতে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নিয়ে সরকারের একটি উদার গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ইমেজ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। এইচআরডব্লিউ দ্রুত, নিরপেক্ষ ও স্বাধীন তদন্তের মাধ্যমে মানবাধিকার লংঘন বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। একইসাথে এর শিকার পরিবারের প্রশ্নের জবাব প্রদান করে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে সরকারকে অবিলম্বে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার অভিযোগের সমাপ্তি টানারও ব্যবস্থা করতে হবে।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি বাংলাদেশের সামনে গণতান্ত্রিক শাসনের চ্যালেঞ্জেরই একটি অংশ। আওয়ামী লীগ সরকার আইনের শাসন ফিরিয়ে আনতে নিঃসন্দেহে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তবে সরকারকে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য আরও কিছু করতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকান্ডে স্বচ্ছতা আনতে সরকার তাদের কর্মকান্ড নিরীক্ষণের জন্য জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা গঠনের সম্ভাবনা পরীক্ষা করতে পারে। এই ধরনের সংস্থা ইতিমধ্যেই কিছু কার্যকরী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আর মানবাধিকারের বিষয়গুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তাদের অভিজ্ঞতা থেকে সহায়তা নিতে পারে।
(ডঃ রূপক ভট্টাচার্য নয়াদিল্লী ভিত্তিক স্বাধীন রাজনৈতিক বিশ্লেষক)
সূত্র: সাউথ এশিয়ান মনিটর
Discussion about this post