মাসুদ মজুমদার
সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর থেকে ওবায়দুল কাদের দলের প্রধান মুখপাত্র। ছাত্রজীবন থেকে তাকে জানি। ওবায়দুল কাদের একসময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা। আবেগমিশ্রিত গদ্যে বক্তব্য উপস্থাপনে তার নিজস্বতা সবার জানা। এটা একধরনের ফিতরাত বা স্বভাব। বিএনপির কোনো কোনো নেতা তার গলা টেনে টেনে বক্তব্য দেয়া নিয়ে রসিকতা করেন। রাজনীতিতে এমনটি হয়। তবে কারো স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে রসিকতা কি না করলেই নয়? ওবায়দুল কাদের যখন ছাত্রলীগের সভাপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে পরিচিত মুখ, তখন আমরাও ছাত্র হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ছাত্ররাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম। আমাদের মাঝে বয়সের দুস্তর ব্যবধান থাকার কথা নয়। ছাত্রজীবন শেষে একপর্যায়ে ওবায়দুল কাদের দৈনিক বাংলার বাণীতে যোগ দিয়েছিলেন। সে সময় আমরা ক’জন মিলে একটা সাপ্তাহিক চালাতে শুরু করলাম। ইত্তেফাকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আখতার উল-আলম, যিনি কিনা ‘লুব্ধক’ নামে খ্যাত ছিলেন; তার কলামটি তখন ইত্তেফাকের অনেক বেশি পাঠকনন্দিত কলাম ছিল। আমাদের অফিস ছিল মতিঝিলে, ঠিক বাংলার বাণীর উল্টো দিকে। ‘সাপ্তাহিক পল্লীবাংলা’র অফিসে প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় আড্ডা জমাতেন আখতার উল-আলম ভাই। ইত্তেফাক ছিল তার কর্মক্ষেত্র, দিন শেষে ক্লান্তি নিয়ে আড্ডায় মেতে উঠতেন আমাদের অফিসে, সম্ভবত ক্লান্তি দূর করার জন্য। তিনি ছিলেন আমাদের সাপ্তাহিকটির অঘোষিত উপদেষ্টা। আলম ভাই একদিন আড্ডায় ‘বাংলার বাণী’র প্রসঙ্গ তুললেন। কথা উঠল ওবায়দুল কাদেরকে নিয়েও। আড্ডায় কেউ একজন ভবিষ্যদ্বাণীর মতো বলেছিলেন, দেখবেন শেষ পর্যন্ত ওবায়দুল কাদের সাংবাদিক হবেন না; জাতীয় রাজনীতিতে জায়গা করে নেবেন। আমরা সবাই একমত হলাম, কারণ, যাদের ছাত্রজীবন রাজনীতির আবহে কাটে, তারা অন্য পেশায় বেশি দিন থাকতে পারে না। এর জন্য অনেক উপমা দেয়া যায়। সাবেক ছাত্রনেতারা জাতীয় রাজনীতিতে ভালো করার নজিরই বেশি।
আজ ওবায়দুল কাদের জাতীয় রাজনীতিতে একটি ধারার মুখপাত্র। এটাও প্রমাণিত সত্য, ছাত্রনেতা থেকে যারা জাতীয় রাজনীতিতে আসেন, তারা কখনো ‘পেশাদার’ রাজনীতিবিদ হন না, তারা রাজনীতিবিদই থেকে যান। বণিকপ্রকৃতির পেশাদারদের শ্রেণীচরিত্র রাজনীতিবিদ হিসেবে বেড়ে ওঠাদের চেয়ে খানিকটা আলাদা। এই গৌরচন্দ্রিকা দেয়ার কারণ, ওবায়দুল কাদের নিত্যদিন সংবাদ শিরোনাম হচ্ছেন। তার প্রধান টার্গেট বিএনপির রাজনীতি। চৌকস ভঙ্গিতে, আক্রমণাত্মক ভাষায় হুল ফুটানো তাৎক্ষণিক বক্তব্য দিয়ে তিনি তার প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে সচেষ্ট থাকেন। ইদানীং তিনি বিএনপি মুখপাত্রদের প্রতিটি বক্তব্যের পাল্টা বক্তব্য দিচ্ছেন। পাল্টা বক্তব্যের ভাষা কখনো কখনো তার স্বভাবগত পরিমিতিবোধকে হার মানাচ্ছে; যা গুণগত রাজনীতির জন্য সুখকর নয়, একধরনের ব্যত্যয়ও বটে।
সব সমালোচনার জবাব দেয়ার গরজ বোধ করা এবং অতিমাত্রায় প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন একধরনের রাজনৈতিক পরাজয়। কারণ, জনগণ নিন্দা ও সমালোচনার চেয়ে ইতিবাচক বক্তব্যে বেশি আকৃষ্ট হয়, প্রভাবিত হয়। ক্ষমতাসীনদের ভাষা হতে হবে সাফল্য বা অর্জননির্ভর; জবাবদিহিতার ও কৈফিয়তের। অন্য দিকে, বিরোধী দলের মুখপাত্রের বক্তব্য হবে প্রতিবাদের সুরে ক্ষমতাসীনদের ব্যর্থতার দালিলিক উপস্থাপনাকেন্দ্রিক। দু’পক্ষেরই মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করা দেশের রাজনীতির জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি জাতীয় নেতাদের জন্য শোভনও নয়। মির্জা ফখরুল ইসলাম এবং ওবায়দুল কাদের প্রধান দুই দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর এই কলামে মন্তব্য করেছিলাম- দু’জনই শিক্ষিত এবং সুশীল প্রকৃতির রাজনীতিবিদ। রগচটা ও ভব্যতাহীন অরুচিকর বক্তব্যের বাইরে গিয়ে তারা রাজনীতির গুণগত চরিত্রে কিছুটা হলেও অবদান রাখবেন; যদি বণিক প্রকৃতির পেশাদার না হয়ে ওঠেন। বাস্তবে ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যে ক্ষমতার উত্তাপ ছড়ায়, যদিও দলীয় পর্যায়ে আত্মসমালোচনার সুরও বাজে। একটা নীতিকথা রয়েছে; তাতে বলা আছে- যারা বেশি কথা বলেন, তারা বাড়িয়ে বলেন কিংবা মিথ্যা বলেন। বক্তা ও কথককেই বুঝতে হবে তিনি কোনটা করেন, কোনটা করেন না। এর ইতিবাচক প্রভাব কতটা, নেতিবাচকটাও কী পরিমাণ।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে ঘায়েল করতেই হবে। এটা গণতন্ত্রের কথা। সেই সাথে প্রতিপক্ষের মোকাবেলায় কৌশলী হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আমরা মনে করি না, আইনসম্মত স্বাধীন মতপ্রকাশে কেউ কাউকে ছাড় দিয়ে কথা বলার কোনো গরজ আছে। রাজনীতির মাঠে শোভন ও সুস্থ বিতর্ক গণতন্ত্রচর্চাকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দেয়। সংসদে সংসদীয় ভাষায় কথা বলার বাইরে রাজনীতির অঙ্গনে বিতর্ক চলুক না; একের বক্তব্য অন্যজন খণ্ডন করুক। কিন্তু জাতীয় নেতা এবং দলের প্রধান মুখপাত্ররা লাগামহীন হতে পারেন না। তাদের পরিমিতিবোধের একটা সীমা আছে, গণ্ডি আছে। বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে মুখপাত্রকে বুঝতে হয়, দলকে ডিফেন্ড করে প্রতিপক্ষকে কতটা কোণঠাসা করা যাবে। সেটা অতিক্রম করলে আমরা হতাশ হই। সব বক্তব্যের জবাব হয় না। কিন্তু দায়িত্বশীলদের ভেবে দেখতে হয়- তার কারণে দলের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে না তো। দেশের মালিক জনগণের কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছে না তো!
দলীয় মুখপাত্রদের বক্তব্য প্রসঙ্গে ছোট্ট দু’টি উপমা টানব। কষ্টদায়ক হচ্ছে, দু’জনই আজ আর পৃথিবীতে নেই। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং মরহুম সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। দু’জনই চৌকস পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। দু’জনই আইনজীবী এবং সংবিধান বিষয়ে প্রাজ্ঞ ছিলেন। দু’জনই রসিয়ে রসিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বক্তব্য দিতে ছিলেন পটু। কিন্তু যার যার ধারার লোকেরা ছাড়া তাদের সব বক্তব্য অন্যরা উপভোগ করতেন না। স্ব স্ব সমর্থকেরা ছিলেন তাদের ভক্ত এবং প্রতিপক্ষের কাছে তারা হয়ে উঠেছিলেন তিরস্কারের মানুষ। এ ধরনের লোকেরা প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির জন্য স্থায়ী কোনো উপমা হয়ে উঠতে পারেন না। এই মন্তব্যের সাথে সবাই একমত হবেন, তা মনে করি না। কিন্তু ধারণা করি, জনমনে স্থায়ী দাগ কাটার জন্য যে রাজনীতিবিদ যতটা চৌকস, পরিমিতিবোধসম্পন্ন ও যুক্তিবাদী, তিনি ততটা স্থায়ী আসন করে নিতে পারেন। আওয়ামী লীগকে বুঝতে হবে ছাত্রলীগের বাড়াবাড়ি ও সম্পদ কামাতে ব্যস্ত নেতাদের সম্পর্কে ওবায়দুল কাদের মোটেও বাড়িয়ে বলেননি। যেকোনো পটপরিবর্তনে তারা যে পালিয়েও বাঁচতে পারবেন না, তা তো অতিকথন নয়।
তা ছাড়া তৃতীয়বার জাতীয় নির্বাচনে জিতে আসার স্বপ্ন দেখা যায়, কিন্তু এটা কতটা সুখস্বপ্ন তা গভীরভাবে চিন্তার বিষয়। ইতোমধ্যে বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে, তিন ভাগের এক ভাগ সংসদ সদস্য জামানত হারাবার মতো অবস্থায় পৌঁছে গেছেন। এ ব্যাপারে ইঙ্গিত করেই ওবায়দুল কাদের হয়তো মন্তব্য করেছেন, জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় এমন কাউকে নমিনেশন দেয়া হবে না। একই সাথে, নেতাদের সম্পদ আহরণের তীব্র প্রতিযোগিতা নিশ্চয়ই তার অগোচরে নেই। তাই বলেছেন, ‘দল না জিতলে এই সম্পদ রেখে পালাতে হবে। আগলে রাখার সুযোগ পাবেন না।’ জানি না এসব মন্তব্য, বক্তব্য দলকে বিব্রত করছে কিনা, তার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তুলছে না তো! একটি জাতীয় দৈনিকে দেয়া সাক্ষাৎকার পড়েছি। তাতে অনেক অকপট বক্তব্য রয়েছে। একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে ওবায়দুল কাদের সম্ভবত রাজনীতির ভাটার টান বুঝতে পারছেন। বিদায়ের করুণ বিউগলের সুরও হয়তো তার কানে বাঁধেছে। অপর দিকে দলীয় জনশক্তিকে সাহস জোগানোর দায়িত্বও তার। তাই রগড়ে কিছু নিন্দাবাদ বিরোধী দলকে করতেই হবে। জবাবি বক্তব্য দিতেই হবে। এ ক্ষেত্রে রাজনীতির শিষ্টাচার ভুলে যাওয়া কারো জন্য কল্যাণকর নয়।
এরপরও দু’দলের দু’সাধারণ সম্পাদকের উচিত নয় এমন কোনো অরাজনৈতিক বক্তব্য দেয়া, যাতে সংলাপ, সমঝোতা এবং আলোচনার শেষ দরজাটাও বন্ধ হয়ে যায়। এবারো রাজনীতিকে অসংযমের দিকে ঠেলে দিলে প্রথমে কপাল পুড়বে রাজনীতিবিদদের। ‘এক-এগারো’ রাজনীতিবিদদের কোথায় পৌঁছিয়ে দিয়েছিল তা দু’নেতাই জানেন। তারা দু’জনই সেই বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করেছেন। তাই রাজনৈতিক সমঝোতার শেষ সুযোগটুকু গ্রহণ করলে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদেরাই লাভবান হবেন; দেশ অসাংবিধানিকতার গহ্বরে পড়বে না। ক্ষমতার হাতবদলের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে, এটা ক্ষমতার লোকদের লাগামহীন ক্ষমতাচর্চার অসাধু অর্জন। বলা চলে, যার যার হাতের কামাই। এ থেকে কেউ পরিত্রাণ পায় না। কখনো প্রতিক্রিয়াটা ভয়াবহ হবে ভেবে ভুল প্রেসক্রিপশন অনুসরণ করে বসলে রোগও সারে না, রোগীও বাঁচে না। সাবধান, রাজনীতিবিদেরা রাজনীতিকে সঙ্কটাবর্তের দিকে ঠেলে দিলে চেনা রাজনীতিবিদেরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। পেশাদাররা ভোল পাল্টাতে সময় নেন না।
এত কিছুর পরও আমরা মনে করি, ক্ষমতার নাটাই কিংবা চাবিটা কোনো বন্ধুরাষ্ট্রের হাতে নয়, এটা জনগণের আঁচলে নয়তো পকেটে গিঁট দেয়া রয়েছে। এটা যে দল যত বেশি বুঝবে এবং ধাতস্থ হবে, তারা তত বেশি লাভবান হবেন। ক্ষমতার চেয়ার এবার ঘুরবে। জনগণই ঘুরাবে। বন্ধুদের আশীর্বাদ-অভিশাপ থাকা সম্ভব, সেটা খেলোয়াড়দের বিষয়, দেশ-জাতি ও জনগণের নয়। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে আঞ্চলিক ও বিশ্বরাজনীতির বোঝাপড়ার একটা ব্যাপার থাকে। সেটা থাকা সম্ভব। তবে ঠেস দেয়া সরকারের ভাগ্য বিপর্যয় কেউ ঠেকাতে এগিয়ে আসে না। কারণ জটিল ও কুটিল কূটনীতির সাথে জনগণের মেলবন্ধন কোনো যুগে হয়নি। আগামী দিনেও হবে না। তার পরও খেলারামরা খেলেই যাবেন।
অনেক সময় রাজনীতিবিদেরা শূন্যে গদা ঘুরান। উপমা হিসেবে সদ্য ভারত ফেরত এরশাদের কথাই ধরা যাক, ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ মানুষ হিসেবে তার কথা সবার জানা। সরকার পরিবর্তনের সময় এসে গেছে বলে তিনি যা বললেন- নতুন করে তার অর্থ কিছুই নয়। ভারত তার হাতে ক্ষমতার চাবি ধরিয়ে দেবে- এটা পাগলেও বিশ্বাস করে না; তবে তার কথার রাজনৈতিক বিশ্লেষণ হওয়া দরকার। এ বার্তার আবেদন আপাতত এতটুকুই। বাস্তবে মানুষ ৫ জানুয়ারির নির্বাচন মেনে নেয়নি। এরশাদ নিজেও জানেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সময় মঞ্চে-নেপথ্যে কত ড্রামা হয়েছে, তিনি কী করেছেন, কিছু তথ্য তিনি নিজেও ফাঁস করেছেন। ভোটারদের মনে পরিবর্তনের তাগিদ সে দিন থেকেই। মানুষ পরিবর্তন চায়- এটাও নতুন কথা নয়। ভারতীয় গ্রিন সিগন্যালের ডঙ্কা বাজিয়ে তিনি নতুন কোনো চাঞ্চল্যের জন্ম দিতে পারেননি। তিনি এই বক্তব্য দিয়ে নিজের ওজন বাড়াতে চেয়েছেন। উল্টো তিনি ওজন কমিয়েছেন। কারণ যেসব কারণে মানুষ পরিবর্তন চায়, তার একটি বড় কারণ ভারতীয় আধিপত্যের রাজনৈতিক স্বরূপটা এবার জনগণ অনেক বেশি প্রত্যক্ষ করেছে। তাই ভারতের আশীর্বাদ জনগণ ফেরি করতে পছন্দ করে না। ভারতের জনগণ আমাদের বন্ধুপ্রতিম। এটা যেমন জনগণ মগজে রাখতে চায়, তেমনি অনাকাক্সিক্ষত দাদাগিরির অভিজ্ঞতাটাও ভুলে যেতে চায় না। জনগণের কাছে ভারতপ্রীতি ও ভীতির কোনো বাড়তি আবেদন নেই। এরশাদ বি টিমের খেলোয়াড়; খেলায় তিনি আছেন, থাকবেন। ‘আমাকে ব্যবহার করুন’- এমন একটি ব্যানার তিনি গলায় ঝুলিয়েই রেখেছেন। এটা বোঝার জন্য প্রাজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
সূত্র: নয়াদিগন্ত
Discussion about this post