দেশে একের পর অপহরণের ঘটনায় দায়ের করা মামলার বেশিরভাগেরই তদন্ত শেষ হচ্ছে না। যারা অপহরণের পর ফিরে আসছেন, তারাও মুখ খুলছেন না বলে জানিয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, এর ফলে এসব অপহরণের কারণও আর জানা যাচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক বি. জে. (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘সব অপহরণের সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার।’
একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করতেন লক্ষ্মীপুরের রাকিবুল হাসান রকি। তাকে গত বছরের ৬ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুর শহরের পুরাতন আদালত রোড এলাকা থেকে ৭/৮ জন লোক তাকে জোর করে একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। এরপর রকির কোনও খোঁজ না পেয়ে তার বাবা তোফায়েল আহমেদ লক্ষ্মীপুর সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। ছয় মাসেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে উদ্ধার করতে পারেনি। অপহরণের ৬ মাস ৬ দিন পর তাকে পৌরশহরের বাঘবাড়ি এলাকার ঢাকা-রায়পুর মহাসড়কের পাশে হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় ফেলে রেখে যায় অপহরণকারীরা। পরে এক রিকশাচালক তাকে দেখে বাড়ি নিয়ে যান।
রকির বাবা তোফায়েল আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ খেটে খাই। আমার ছেলেটা কখনও কারও সঙ্গে কোনও ঝামেলায় ছিল না। তারপরও তাকে কেন অপহরণ করা হলো? অনেকেই দেখেছেন, রকিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে তারা কেউ স্বীকার করেনি। এখনও আমার ছেলে আতঙ্কের মধ্যেই আছে।’ তিনি বলেন, ‘ফিরে আসার পর পুলিশ তাকে নিয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেয়। এরপর আর যোগাযোগ করেনি।’
ফিরে আসার পর রকি কোনও কথা বলেনি। তাকে কে বা কারা কোথায় কেন নিয়ে গিয়েছিল, সে উত্তর মেলেনি আজও। তাকে অপহরণের বিষয়ে লক্ষ্মীপুর সদর থানায় যে জিডি হয়েছিল, জিডির তদন্তের অগ্রগতিও নেই। এ বিষয়ে লক্ষ্মীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) লোকমান হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আসলে ভিকটিমকে উদ্ধারের পর তিনি কিছুই বলতে পারেননি। তিনি যদি কিছু বলতে পারতেন, তাহলে আমরা আরও একটু অগ্রসর হতে পারতাম। আসলে এর পেছেন কী ঘটেছিল, তা জানার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’
এদিকে লক্ষ্মীপুরের চিকিৎসক মুহাম্মদ ইকবাল মাহমুদ গত বছরের ১০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) দুই মাসের একটি প্রশিক্ষণ নিতে ঢাকায় আসেন। এরপর বাড়ি গিয়ে ১৫ অক্টোবর রাতে রাজধানীতে ফেরার পর সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড় থেকে তিনি অপহৃত হন। ঘটনার সাড়ে সাতমাস পর এ বছরের ১ জুন চোখ বাঁধা অবস্থায় লক্ষ্মীপুরে তাকেও ফেলে যায় অপহরণকারীরা। বিষয়টি ধানমন্ডি থানা পুলিশের পাশাপাশি লক্ষ্মীপুর থানা পুলিশও তদন্ত করে। তিনিও অপহরণের বিষয়ে মুখ খোলেননি। ফিরে আসার পর পরিবার ও সাংবাদিকদের ডাক্তার ইকবাল মাহমুদ জানান, তাকে তিন বেলা খেতে দিতো নিয়মিত। এমনকি নামাজের জন্যও সময় দিতো, তবে নির্যাতন করেনি। তাকে অপহরণের রহস্যও উদঘাটন করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
ইকবালের বাবা নুরুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা ছেলে কোনও কিছুই বলতে পারে না। ঘটনার পর আমরা দৌড়াদৌড়ি করেছি। সবার সহযোগিতায় তাকে ফিরে পেয়েছি। সে এখন মোটামুটি ভালো আছে। চলাফেরা করছে।’
এদিকে ডাক্তার ইকবালের অপহরণ মামলাটি ধানমন্ডি থানা পুলিশের পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করে। সর্বশেষ মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সহকারী পুলিশ সুপার রতন কৃষ্ণ নাথ তদন্ত করেন। ইকবাল উদ্ধার হওয়ার পর এই তদন্ত কর্মকর্তাই আদালতে নিয়ে তাকে দিয়ে স্বীকারোক্তি দিয়ে আসেন। এরপর আর এই পরিবারটির সঙ্গে পুলিশের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়নি। মামলারও কোনও অগ্রগতি নেই বলে জানা গেছে।
গত ৩০ জুন বরিশাল নগরীর সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ চৌমাথা বাজার থেকে মিষ্টি কেনার পর রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন স্থানীয় বাসিন্দা জুয়েল। এ ঘটনায় জুয়েলের বড় ভাই এইচএম আব্দুল্লাহ হিমেল গত ১ জুলাই কোতোয়ালী মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। জুয়েল নগরীর দক্ষিণ আলেকান্দা মীরাবাড়ির পোল এলাকার হাবিবুর রহমানের ছেলে। মাত্র দুই মাস আগে বিয়ে করেছিলেন তিনি। এরপর ৬ জুলাই নিজেই ফিরে আসেন। আসার পর পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও এ বিষয়ে সাংবাদিকদের কাছে কিছু বলতে চাননি তিনি। তার বড় ভাই এইচএম আব্দুল্লাহ হিমেলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
গত বছরের ১ ডিসেম্বর রাতে বনানীর কাঁচাবাজার এলাকার নর্দান ক্যাফে থেকে খাবার খেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর একসঙ্গে নিখোঁজ হন সাফায়েত, পাভেল, সুজন ও মেহেদী নামে চার তরুণ। তাদের মধ্যে সাফায়েত ও পাভেল নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সাফায়েত সম্প্রতি লেখাপড়া স্থগিত রাখলেও পাভেল ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স বিভাগের শেষ সেমিস্টারের ছাত্র। তারা চারজনই আলাদাভাবে ফিরে আসেন। তবে তারা কোথায় ছিলেন, তা কেউ বলতে পারেননি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তাদের বিষয়ে কোনও তথ্য দিতে পারেনি।
এদিকে ২০১৪ সালের এপ্রিলে অপহরণ করা হয়েছিল পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) প্রধান নির্বাহী আবু বকর সিদ্দিককে, ২০১৬ সালের মার্চ মাসে প্রযুক্তিবিদ তানভীর জোহাকে। তারা দু’জনেই পরবর্তী সময়ে ফিরে এসেছেন কিন্তু কারা তাদের নিয়ে গিয়েছিল এ বিষয়ে মুখ খোলেননি। এছাড়া ২০১০ সালের জুনে ফার্মগেটের ইন্দিরা রোড থেকে অপহরণ করা হয় সাবেক ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর চৌধুরী আলমকে এবং ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে নিখোঁজ হন বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী। আজ পর্যন্ত তাদের কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। ২০১৪ সালের মার্চের শুরুতে ঢাকার উত্তরা থেকে অপহৃত হন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন। এর প্রায় আড়াই মাস পর ১১ মে ভোরে শিলংয়ের গলফ লিংক এলাকায় উদ্ভ্রান্তের মতো ঘোরাঘুরির সময় লোকজনের ফোন পেয়ে পুলিশ তাঁকে আটক করে। এখনও তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়নি।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী ২০১৪ সাল থেকে জুন ২০১৭ পর্যন্ত রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ বা অপহরণের শিকার হয়েছেন ২৮৪ জন। তাদের মধ্যে ৪৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। নিখোঁজের পর গ্রেফতার দেখানো হয়েছে ৩৬ জনকে এবং পরিবারের কাছে বিভিন্নভাবে ফিরে আসেন ২৭ জন। তবে এখনও ১৭৭ জনের কী অবস্থা, তা জানা যায়নি।
এ প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক বি. জে. (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘প্রতিটি ঘটনার তদন্ত হওয়া দরকার। তদন্ত করে সঠিক ঘটনা না জানা গেলে, সাধারণ মানুষের মন থেকে আতঙ্ক দূর হবে না।’
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
Discussion about this post