বাংলাদেশে স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে প্রধানত দুদিক থেকে বাধা আছে। একটি ক্ষমতাসীনদের তরফ থেকে, অন্যটির উৎস ধর্মীয় উগ্রবাদীরা। উগ্রবাদীদের কাছ থেকে কোনো ব্যক্তি নির্যাতনের বা মৃত্যুর ভয়ে থাকলে হয়তো তাঁর সুরক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু সরকারের বিরাগভাজন হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো সুরক্ষা পান না।
শুক্রবার বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের (হোম অফিস) প্রকাশিত হালনাগাদ তথ্যে এ কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশের কোনো নাগরিক প্রাণনাশের ভয়ে যুক্তরাজ্যে আশ্রয় চাইলে সেই আবেদন কীভাবে বিবেচনা করা হবে, তার নির্দেশনা হিসেবে এমন হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করে দেশটি। ‘কান্ট্রি পলিসি অ্যান্ড ইনফরমেশন নোট: জার্নালিস্ট, পাবলিশার্স অ্যান্ড ইন্টারনেট ব্লগার্স’ শীর্ষক নির্দেশনায় বাংলাদেশে গণমাধ্যম ও ইন্টারনেটে ভিন্নমত প্রকাশের ঝুঁকিগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে। শুধু মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ঝুঁকি নিয়ে এটিই প্রথম কোনো নির্দেশিকা, যেখানে সাংবাদিক, সম্পাদক, ব্লগারদের আশ্রয় আবেদন বিবেচনার বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সংগঠনের বরাত দিয়ে বাংলাদেশে স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে আইনি বাধা, আইনের অপব্যাখ্যা করে হয়রানি, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে হুমকি ও সাংবাদিকদের নিপীড়নের অস্তিত্বের কথা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে ৩২ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সুরক্ষা বিষয়ে যেভাবে ঢালাওভাবে মন্তব্য করা হয়েছে, তা বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়; বরং প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম এমনকি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও খোলাখুলিভাবে মতামত প্রকাশ করা হচ্ছে।
উগ্রবাদীদের হাতে ভিকটিম হওয়ার কথা উল্লেখ করে ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, এ বিষয়ে বরং সরকার অনেক সুরক্ষা দিচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সংবিধানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি আছে। কিন্তু অস্পষ্ট শব্দচয়নে তৈরি বিভিন্ন আইনের ধারা ব্যবহার করে সরকার হুমকি, হয়রানি ও গ্রেপ্তারের সুযোগ নেয়। নজরদারিতে রাখে। মানহানি ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনে। কিংবা বাধ্য করে সম্পাদক, প্রকাশক ও সাংবাদিকেরা যাতে নিজ থেকেই সরকারের সমালোচনার পথ এড়িয়ে চলেন (সেল্ফ সেন্সরশিপ)।
এতে বলা হয়, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের বেসরকারি সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। সরকারি বিজ্ঞাপন বণ্টন করে সরকার গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।
এ প্রসঙ্গে দেশের দুটি শীর্ষ দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার-এ বিজ্ঞাপন আটকে দেওয়ার প্রসঙ্গ টেনে বলা হয়, ২০১৫ সালে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে সেনা অভিযান নিয়ে স্পর্শকাতর সংবাদ প্রকাশ করায় বড় বড় কোম্পানিকে এই দুটি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করা হয়।
স্বাধীন গণমাধ্যমকে বশে আনতে মানহানি ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনার নজির তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন ছাপার কারণে ২০১৫ সাল থেকে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান এবং ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বহুসংখ্যক মানহানি ও রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার শিকার হয়েছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব মামলা করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সদস্য ও সমর্থকেরা। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মন্তব্য তুলে ধরে এতে বলা হয়, এসব মামলার অর্থ হলো সম্পাদকদ্বয় সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল আইনি ঝামেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন।
সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের অনুষ্ঠানে কোনো কোনো সংবাদপত্রের কর্মীদের প্রবেশাধিকার কেড়ে নেওয়ার প্রসঙ্গ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মতপ্রকাশের কারণে ২০১৩ সাল থেকে অন্তত ৯ জন ধর্মীয় উগ্রবাদীদের হাতে নিহত হয়েছেন।
যুক্তরাজ্যে আইন পেশায় নিয়োজিত তারেক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আপাতদৃষ্টিতে এই নির্দেশিকা যুক্তরাজ্যে আশ্রয় আবেদনে ইচ্ছুক নিরাপত্তাহীন বাংলাদেশি লেখক ও গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য ইতিবাচক মনে হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যম, সরকার ও দেশের ভাবমূর্তির জন্য এ চিত্র মোটেই শুভ নয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ দেশে একেবারে মুক্ত সাংবাদিকতা সম্ভব হয় না উল্লেখ করে প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষমতাসীনদের তরফ ও উগ্রবাদীদের তরফ ছাড়াও আরও একটি পক্ষ আছে, যারা ‘প্রেসার গ্রুপ’। এই গ্রুপ রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী, প্রশাসনের লোকসহ বিভিন্ন রকম হতে পারে।
তবে তিনি বলেন, সরকারকে অনেক সময় চাপ সৃষ্টি করে সঠিক পথে আনা যায়। কিন্তু উগ্রবাদীরা কোনো কিছু মানে না।
সূত্র: প্রথম আলো
Discussion about this post