অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
১৯৯৭ সালেই ইউনেস্কো সুন্দরবনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করে। সুন্দরবনের সন্নিকটে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের শুরু থেকেই আপত্তি জানিয়ে আসছিল সারাবিশ্বে পরিবেশ রক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনেস্কো। বাংলাদেশ সরকার তাদের আপত্তিকে পাত্তা না দেয়ায় ২০১৬ সালে ইউনেস্কোর একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসে সরেজমিনে রামপাল ও সুন্দরবন পরিদর্শন করে গেছেন।
রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হলে সুন্দরবন ও এর আশপাশের পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হবে বলে সংস্থাটি বাংলাদেশ সরকারকে বার বার বলেছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ফলে সুন্দরবনের কী কী ক্ষতি হবে এনিয়ে একটি রিপোর্টও প্রকাশ করেছে ইউনেস্কো। বিদ্যুৎ প্রকল্পটি রামপাল থেকে সরিয়ে নিতেও তারা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিল। আর ইউনেস্কো ছাড়াও দেশি-বিদেশি পরিবেশবাদী সংগঠন ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বৈজ্ঞানিক যুক্তিসহ দেখিয়ে দিয়েছেন যে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ফলে সুন্দরবনের কী ধরণের ভয়াবহতা হতে পারে।
২০১৬ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত ইউনেস্কোর ত্রিশ পৃষ্ঠার বেশি দীর্ঘ রিপোর্টটিতে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের চার ধরণের ক্ষতির আশংকার কথা তুলে ধরা হয়েছিল।
ইউনেস্কোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে কয়লা পুড়িয়ে। এই কয়লা পোড়ানোর পর সেখান থেকে নির্গত কয়লার ছাইকে সুন্দরবনের পরিবেশের জন্য এক নম্বর হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ইউনেস্কোর এই প্রকল্পে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত বর্জ্য এবং পানিকে দ্বিতীয় হুমকি গণ্য করছে ইউনেস্কো।
এই প্রকল্পকে ঘিরে সুন্দরবন এলাকায় যেভাবে জাহাজ চলাচল বাড়বে এবং ড্রেজিং করার দরকার হবে, সেটিও সুন্দরবনের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
আর সবশেষে বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ঘিরে ঐ অঞ্চলের সার্বিক শিল্পায়ন এবং উন্নয়ন কর্মাকাণ্ড ও সুন্দরবনের পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলবে বলে মনে করে ইউনেস্কো।
ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টার এবং ইন্টারন্যাশনাল কনজার্ভেশন ইউনিয়ন (আইইউসিএন) এর তিনজন বিশেষজ্ঞ সরেজমিনে ঘুরে দেখে এবং বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলে এই রিপোর্টটি তৈরি করেছিলেন।
এতে আরও বলা হয়েছে, যেখানে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে, সেটি সুন্দরবনের অদূরেই। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের এনভায়রনমেন্টাল ইম্প্যাক্ট এসেসমেন্টের (ইআইএ) জন্য আইউসিএন যে নির্দেশনা দিয়েছিল, তা ঠিকমত মেনে চলা হয়নি বলে উল্লেখ করা হয় এই রিপোর্টে।
এছাড়া সুন্দরবনের পরিবেশের জন্য ক্ষতি এড়াতে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যে ধরণের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং যেরকম আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে চলা উচিৎ, সেটাও করা হচ্ছে না বলে মন্তব্য করা হয় রিপোর্টে।
সবশেষে ইউনেস্কো সুন্দরবনের কাছে এই বিশাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ বন্ধ রাখতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছিল। ইউনেস্কো হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিল, এরকম একটি প্রকল্প বাংলাদেশে সুন্দরবনের পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য গুরুতর হুমকি তৈরি করবে। এমন সম্ভাবনা খুব প্রবল যে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দূষণ সুন্দরবনের অপূরণীয় ক্ষতি করবে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি এমন কোন জায়গায় সরিয়ে নেয়া উচিৎ, যাতে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি না হয়।
কিন্তু, হঠাৎ করেই নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করে ফেললো সংস্থাটি। ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির ৪১তম অধিবেশনে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে যে আপত্তি জানিয়েছিল সেটা প্রত্যাহার করে নিয়েছে বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়।
হঠাৎ করে ইউনেস্কোর এই অবস্থান পরিবর্তনে বাংলাদেশের পরিবেশবাদী সংগঠন, পরিবেশ বিশেষজ্ঞসহ সকল শ্রেণি পেশার মানুষই ইউনেস্কোর কর্মকাণ্ড ও নীতি নিয়ে প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। বড় ধরণের কোনো স্বার্থের পাল্লায় পড়ে ইউনেস্কো তাদের আপত্তি প্রত্যাহার করেছে বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ফলে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হলে এর দায়ভার সম্পূর্ণ ইউনেস্কোকেই নিতে হবে বলেও তাদের বক্তব্য।
Discussion about this post