এ এক বিরাট রহস্য। বাংলাদেশের ইতিহাসে অতীতে এমন ঘটনা আর ঘটেনি। ভোটের দেড় বছর আগেই শুরু হয়ে গেছে ছায়া প্রচারণা। ভোট বাতচিত চলছে রাজনীতিতে। উঠছে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ। তৎপর বিদেশি অতিথিরাও। সরব নির্বাচন কমিশন সচিবালয়। সেখানে হাজির হচ্ছেন বিদেশি কূটনীতিকরা। বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষার কথা ব্যক্ত করেছেন তারা।
হরেক কিসিমের নির্বাচন দেখেছেন বাংলাদেশের মানুষ। অপেক্ষাকৃত ভালো ভোট যেমন হয়েছে, তেমনি গায়েবি ভোটও কম হয়নি। গণতন্ত্রের সংজ্ঞাও এখানে বদলেছে ক্ষণে ক্ষণে। সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার সঙ্গে বৈঠক করেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট। ওই বৈঠকে বাংলাদেশের অতীতের দুটি নির্বাচন বিশেষ আলোচনায় এসেছে। ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি এবং ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়। এমন নির্বাচন যেন আর না হয় এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূত। সর্বশেষ রোববার নির্বাচন কমিশনার মাহাবুব তালুকদার বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন আত্মমর্যাদার প্রতীক। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করে আত্মমর্যাদা বিসর্জন দেয়ার অবকাশ নেই। লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে নির্বাচন কমিশন কাজ করছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত আগামী নির্বাচন কেমন মডেলে হবে। ওই নির্বাচন কি অংশগ্রহণমূলক হবে? নির্বাচনে কি জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন? তাদের দেয়া ভোট কি গণনা হবে। সাম্প্রতিক কালে দেখা গেছে, বাংলাদেশের জনগণের ভোটের প্রতি আগ্রহ অনেকটা কমে গেছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মূলত ভোটে ভোটারদের মতামতের প্রতিফলন না হওয়াতেই তারা এ ব্যাপারে আগ্রহ হারাচ্ছেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে পুরোদমে ভোটের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। রোববারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘জনগণ উন্নয়নের সুফল ধরে রাখতে নৌকায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করবে।’ আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগ দলীয় অনেক বর্তমান এমপিই টেনশনে রয়েছেন। তাদের ব্যাপারে একাধিক জরিপ পরিচালিত হয়েছে। তবে গত নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের অনেকেই এবার বাদ পড়তে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিএনপি নির্বাচনে আসলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে এমনটা ধরেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ।
বিএনপির ভেতরেও কিছুটা নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। তবে ভোট নিয়ে দলটির মধ্যে এখনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রয়েছে। রোববারও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া অভিযোগ করেছেন, সরকার বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করতে চায়। যদিও এ ধরনের নির্বাচন আর হবে না বলে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। বিএনপিতে নির্বাচনের ইশতেহার তৈরির কার্যক্রম চলছে। প্রার্থী নিয়ে অবশ্য দলটিতে এখনো তেমন কোনো কাজ শুরু হয়নি। আগামী নির্বাচনে জামায়াত ও হেফাজতের অবস্থান কেমন হবে তাও হবে দেখার বিষয়।
বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হচ্ছে, কেমন হবে আগামী নির্বাচন। একতরফা? অংশগ্রহণমূলক? প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই যে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তা হলফ করেই বলা যায়। বিএনপি এরইমধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে এসেছে। দলটি এখন নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের কথা বলছে। তবে সে সরকারের রূপরেখা কেমন হবে সে ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা এখনো পাওয়া যায়নি। ঈদের পর বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সহায়ক সরকারের রূপরেখা উপস্থাপন করতে পারেন। তবে সে দাবি পূরণের সম্ভাবনা ক্ষীণ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে পূর্ণমাত্রায় বহাল রেখে বিএনপি কি নির্বাচনে অংশ নেবে। দলটি কি নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ পাবে। বেগম খালেদা জিয়ার মামলার ভবিষ্যৎ ভাগ্য এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। খালেদা জিয়ার দুটি মামলা দীর্ঘদিন ধরেই চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। মামলা দুটি ঘুরছে। কখন রায় হয় আর কী রায় হয় সেদিকেই দৃষ্টি আপাত রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের। শুধু খালেদা জিয়া নয়, বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতার এসব মামলার বেশিরভাগেরই রায় ঘোষণা হয়নি। এসব মামলায় রাজনীতির ভাগ্য নির্ধারণ হতে পারে। বিএনপির পক্ষ থেকে এরইমধ্যে মামলা প্রত্যাহারের দাবি উঠেছে। কিন্তু সরকারি দলের এক শীর্ষ নেতা অবশ্য সাফ বলেছেন, মামলার সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। নানা থিওরি আলোচিত। বলা হচ্ছে, আগামী নির্বাচন হবে অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। আবার নির্বাচনে বিএনপি কোনরূপে অংশ নেয় বা নেয়ার সুযোগ পায় তাও আলোচনায় রয়েছে। মামলার কারণে বিএনপির সব নেতারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন কি-না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে। আগামী নির্বাচনে জামায়াতের প্রকাশ্যে অংশগ্রহণ থাকবে না। দলটির কোনো কোনো নেতা হয়তো স্বতন্ত্র কৌশলে নির্বাচনে অংশ নেবেন। হেফাজতে ইসলাম কোন পক্ষে থাকবে? সংগঠনটি যেন সরাসরি সরকার বিরোধিতায় না যায় তা নিশ্চিত করতে নানা কার্যক্রম চলছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশি অতিথিরা সবসময়ই তৎপর। তবে গত কয়েক বছরে তাদের তৎপরতা অনেকটাই কমে এসেছে। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে কূটনীতিকরা আগের মতো গুরুত্বও পাচ্ছেন না। তবে আগামী নির্বাচন নিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশি দূতেরা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের পর বৃটিশ হাইকমিশনারও বৈঠক করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোন জুতায় পা ঢুকাবেন সিইসি কেএম নূরুল হুদা। তিনি কি ১৫ই ফেব্রুয়ারির গায়েবি ভোটের দিকে হাঁটবেন? নাকি ১২ই জুনের অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুসরণ করবেন। পর্যবেক্ষকরা অবশ্য বলছেন, নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে সব করা সম্ভব নয়। কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা থাকে কোনদিকে তাও হবে দেখার। কোন মডেলের নির্বাচন আয়োজন করেন কেএম নূরুল হুদা তা দেখতে অপেক্ষায় থাকতে হবে। তবে রাজনীতিতে ভারসাম্য না আসলে তার হয়তো খুব বেশি কিছু করার থাকবে না।
সূত্র: মানবজমিন
Discussion about this post