আনাস বিন ইউসুফ
বর্তমান বিশ্বের প্রধান শক্তিধর পরাশক্তির দেশ আমেরিকা৷ বিশ্বব্যাপি একচ্ছত্র কর্তৃত্ব করে যাচ্ছে এই দেশটি৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ-বিগ্রহ পরিচালনা করে দেশটি নিজেদের অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখতে বেশ হিমশিম খেতে হয়৷ নিজেদের অর্থনীতিকে সচল রাখতে আমেরিকার প্রধান ব্যবসা হল অস্ত্র-বাণিজ্য৷ ফলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব এবং অস্থিরতায় সব থেকে বড় ফায়দাটা তুলে নেয় যুক্তরাষ্ট্র৷ যেকোন উপায়ে মিডেল ইস্টের মুসলিম দেশগুলোকে পারস্পরিক লড়াইয়ে ব্যস্ত রাখতে পারলেই তাদের অস্ত্র বাণিজ্যে পূর্নতা পায়৷ পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বে রক্তক্ষরণের ধারাকে আরো তীব্র করে মুসলমানদের শক্তি, সামর্থ ও মানসিক শক্তিকে দূর্বল করে রাখা যায়৷ ফলে সব পক্ষের সাথেই ভিন্ন ভিন্ন চুক্তিতে অস্ত্রের বাণিজ্য চালাতে পারে৷
মধ্যপ্রাচ্য অস্থিরতার অন্যতম কারন সৌদি আরব
একে তো শিয়া-সুন্নী দন্ধের ফলে ইরান, সিরিয়া ও ইয়েমানের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্ক ভাল না৷ ইতিমধ্যে তারা ইয়েমানের সাথে যুদ্ধেও জড়িয়েছে৷ এখানেও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের একক স্বার্থ রয়েছে৷ আর ইরান ও সিরিয়ার সাথে লড়াই করার মত অস্ত্র এই মুহূর্তে সৌদির হাতে নেই৷ ফলে যেকোন উপায়ে আমেরিকার সাথে সৌদির সু-সম্পর্ক বাজায় থকাটা অতীব জরুরী৷ ইরান ও সিরিয়াকে টেক্কা দিতে চাইলে সৌদির যে অস্ত্রের প্রয়োজন পড়বে সেটাও কিনতে হবে আমেরিকার কাছ থেকেই৷ এবং ইতিমধ্যে আমেরিকার সাথে বিশ্বের সবচেয়ে বড় “অস্ত্র-চালান” চুক্তিও সম্পন্ন করে ফেলেছে সৌদি আরব৷
অন্যদিকে সৌদি আরবের রাজতন্ত্র মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটি বড় অভিশাপ৷ তুর্কি খেলাফত ধ্বংসে যে রাজতন্ত্রের জন্ম তারা এখনো মধ্যপ্রাচ্যে যাতে ইসলামী শক্তির উত্থান না ঘটে সে প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে৷ বিশেষত স্বশস্ত্র সংগঠনগুলো যাতে সৌদিতে ঢুকতে না পারে এবং সাধারন জনগনের সমর্থন নিয়ে রাজ পরিবারের ক্ষমতায় কোন আঘাত করে না বসে সে লক্ষে নিজেদের সবকিছুর বিনিময়ে হলেও আমেরিকার সাথে সম্পর্ক ধরে রাখতে চায় সৌদি আরব৷ আর এটাও মধ্যপ্রাচ্য অস্থিরতার অন্যতম প্রধান কারন৷ কেননা আমেরিকার সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখতে গিয়ে সৌদি আরব অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর সাথে বৈরি ও অন্যায় আচরন করে৷ যা বিগত সময়ে দেখে আসছি৷
কাতারের নীতি-আদর্শ কী সে কথায় আসা যাক
যে নীতি বা আদর্শের কারনে মুসলিম বিশ্বের প্রশংসা বা সমর্থন কুড়াচ্ছে কাতার সেটা হল- বর্তমান বাদশা তামিম বিন হামাদ মধ্যপ্রাচ্যের মজলুম জনগনেরর পাশে দাড়িয়েছেন সব সময়৷ এমনকি বিপুল পরিমান ত্রাণ সহায়তা দিয়ে আসছেন যুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশগুলোতে৷ অল্প বয়সী তরুন আমীরের এটি একটি ব্যতিক্রমি ও প্রশংসনীয় নীতি৷
তবে এসব কিছু থেকে এটা ধারনা করার সুযোগ নেই যে, কাতার ইসলামি খেলাফতকে সমর্থন করছে, বা ভবিষ্যতে করবে৷ বরং নিজের দেশে যাতে ইসলামি শক্তির উত্থান না ঘটে সেজন্যও যথেষ্ট পদক্ষেপ রয়েছে কাতারের৷ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশ ও সংগঠনগুলোকে কাতার যে সমর্থন করে এটাকে বড়জোর “গনতান্ত্রিক ইসলাম” টাইপ কিছু বলা যায়৷ আরো সহজ করে যদি বলি, আমাদের দেশের গনতান্ত্রিক যে দলটিকে “ইসলামীয়” বলে আলেমগন যেমন সমর্থন করেন তেমনি কাতারও বিশ্বের মুসলমানদের থেকে সে সমর্থনটা আদায় করে নিচ্ছে৷ আমরাও সমর্থন দিচ্ছি৷
অন্যদিকে আভ্যন্তরীণ এবং নীতিগত দিক থেকে কাতার ইউরোপ-আমেরিকারই প্রতিনিধিত্ব করে আসছে৷ পারস্য উপসাগরের পশ্চিম পাড়ে তেলের উপর ভাসমান এই কাতার ইউরোপে অনেক বড় বড় ইনবেস্টের মালিক৷ এছাড়া কাতারে রয়েছে আমেরিকার শক্তিশালী সামরিক বিমানঘাটি৷ যা ব্যবহার করে ইতিপূর্বে ইরাকের উপর আকাশ ঝড় নামিয়েছিল আমেরিকা৷
মানচিত্রে ইরাকের অবস্থান হল- পারস্য উপসাগরের ঠিক উত্তর পাড়ে৷ অর্থাৎ কাতারের পিছনে (দক্ষিণে) আরব আমিরাত, বামে (পশ্চিমে) সৌদি আরব, সামনে (উত্তরে) বাহরাইন, এরপর সৌদির উত্তর-পূর্ব কোণে কুয়েত৷ এর ঠিক পিছনে ইরাক৷ ইরাকের উপর সহজে বিমান আক্রমনের জন্য কাতারই ছিল উপযুক্ত কেন্দ্র৷ এখান থেকে পারস্য সাগরের উপর দিয়ে সহজেই ইারাকের উপর বিমান হামলা চালানো যায়৷ কাতারকে ব্যবহার করে আমেরিকা সেটাই করেছিল৷
প্রশ্ন হল- আমেরিকা যদি কাতারের মিত্র-ই হয়ে থাকে তাহলে এখন কেন এদের বিরোধিতা করছে? কেন-ই ট্রাম্প চলমান সংকট সৃষ্টির কৃতিত্ব নিজের বলে দাবি করছে? এর উত্তর হল- আমেরিকা এবং ইসরাইল কখনো চায় না অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ কাতার যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া, ফিলিস্তিন সহ অন্যান্য দেশগুলোর নিপীড়িত জনতার পাশে দাড়াক৷ নিজের দলের কেউ প্রতিপক্ষকে সাহায্য-সহযোগিতা করুক- এটা কেউ মেনে নিতে পারে না৷ আমেরিকাও পারে নি৷
ফলে কাতারের সাথে মিত্রতা সত্বেও “উগ্রবাদকে সহযোগিতার কথা” বলে এই টানাপড়েন সৃষ্টি করা হয়েছে৷ এক্ষেত্রে সৌদি সহ ছয়টি মুসলিম দেশকে আমেরিকা ব্যবহার করেছে সু-কৌশলে, বিভিন্ন প্রলোবন কিংবা ভয় দেখিয়ে৷ ছয়টি দেশকে হয়তো “স্ব-শস্ত্র সংগঠনগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে” এমন ভয় দেখানো হয়েছে৷ এরমধ্যেই সৌদিতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব সম্মেলনে “শিয়া-সুনী” ইস্যু নামক আগুনের উননে নতুন করে ঘি ঢেলেছেন ট্রাম্প৷
তবে বন্ধু প্রতিম কাতারে চলমান সংকট তৈরি করে ট্রাম্পের কৃতিত্ব দাবি করাটা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দেউলিয়াত্বের বহিঃপ্রকাশ বৈ কিছু না৷
ওদিকে সৌদি রাজ পরিবারও নিজেদের রাজতন্ত্র রক্ষার জন্য সবকিছুর বিসর্জন দিয়ে হলেও আমেরিকার ফর্মূলা মেনে নিতে প্রস্তুত৷ ফলে উন্নত-সমৃদ্ধ প্রতিবেশি দেশটির সাথেও সম্পর্ক ছিন্ন করতে কুন্ঠাবোধ করে নি৷
মানচিত্রে একবার দৃষ্টি দেয়া যাক
পারস্য সাগরের ঠিক পশ্চিম পাড়ে সৌদি আরবের সাথে ঘেষে মানচিত্রের এক ফোঁটা ভূ-খন্ড “কাতার৷” কাতারের উত্তর পাশে ছোট্ট বাহরাইন, দক্ষিণে সংযুক্ত আরব আমিরাত৷ আর পূর্বে বিশাল বিস্তীর্ণ পারস্য উপসাগর৷ সাগরের পূর্ব পাড়েই ইরানের অবস্থান৷
সম্প্রতি কাতার বয়কটে তিন প্রতিবেশি (সৌদি, বাহরাইন ও আরব আমিরাত) অংশ নেয়ার ফলে কাতারের আকাশপথ পুরোপুরি বন্ধ বলা চলে৷ আন্তার্জাতিক সীমারেখা উন্মুক্ত থাকলেও সে রেখা ব্যবহার করে চলা কঠিন৷ কেননা সেক্ষেত্রে অনেক অর্থ ব্যয় হবে৷ টোটালি অর্থনৈতিকভাবে কঠিন ধ্বসের সম্মুখিন হতে পারে কাতার৷ এছাড়া ইরান হয়ে পারস্য সাগরের উপর দিয়ে বিমান পথ সচল রাখা আরও কঠিন৷ বিশাল অর্থ ব্যয় হয়ে যাবে৷ ফলে কাতারকে কোনঠাসা করতে প্রতিবেশি তিন দেশ বয়কটে অংশ নেয়াটা অতীব গুরুত্বপূর্ন ছিল বটেই৷
কাতার সংকটের নেপথ্য কি?
কাতর সংকটের নেপথ্য কারন খুজতে গিয়ে অনেকেই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও আঞ্চলিক বিষয়গুলোকেই তুলে আনার চেষ্টা করছেন৷ বস্তুতঃ এককভাবে কাতার সংকট বড় কিংবা বিশেষ কিছু না৷ এটা গোটা মুসলিম বিশ্বের একটি সংকট৷ এর গভীরে যে কারনটি রয়েছে সেদিক থেকে আমরা দৃষ্টি এড়িয়ে চলছি৷
সেটা হল- মুহাম্মদ সাঃ তাঁর সাহাবীদেরকে এ অঞ্চলে যে আদর্শিক নেতৃত্বের উপর রেখে গিয়েছেন সে রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে বিচ্যুত হওয়া৷ এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল- উসমানি খিলাফত পতনের সবচেয়ে বড় ব্যানিফিশিয়ারি সৌদ রাজ-পরিবার ও ইসরাইল এবং তাদের দোসর আরব আমিরাত নিজেদের রাজত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে মুসলমানদের চরম শত্রুদের লেজুড়বৃত্তি করে যাচ্ছে৷ যার পরিনতি হচ্ছে মুসলিম বিশ্বের আজকের এই মহা সংকট৷ কাতার তো হল একটি উপসর্গ মাত্র৷ যাদেরকে “উগ্রবাদকে প্রশ্রয় দেয়ার কথা বলে” টার্গেটে পরিনত করা হয়েছে৷ ঠিক যেমন এর আগে ইরাককে টার্গেট করে ধ্বংস করা হয়েছিল এই কাতারকে ব্যবহার করেই৷ সহজ কথায়- এই মুহূর্তে কাতার সংকট নতুন কিছু নয়, বরং এটি মুসলিম বিশ্বের ধারাবাহিক সংকটেরই একটি নতুন অধ্যায়৷ এবং গোটা মধ্যপ্রাচ্যের শ্বাসক গোষ্ঠির পাশ্চাত্য শক্তির পদলেহী নীতির পরিনতি৷
ইসলামি রাষ্ট্রের অবর্তমানে সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী সৌদি রাজপরিবার ও ইসরাইল এবং তাদের অনুগামীদের একটি মাত্র চাওয়া- যেন আরব অঞ্চলের মানুষ আবার জেগে উঠতে না পারে এবং পুনঃপ্রতিষ্ঠা না পায় “খিলাফাত আল- মিনহাজিন নবুওয়াহ!”
কাতারের ভবিষ্যৎ কোন পথে?
এখন পর্যন্ত তুরস্ক কাতারের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে৷ প্রেসিডেন্ট এরদুগান স্পষ্ট বলেছেন, তিনি তার মিত্রদের সাথে নিয়ে কাতারের পাশে থকবেন৷ উগ্রবাদকে আশ্রয় দেয়ার যে অভিযোগে কাতারকে বয়কট করা হয়েছে এরদুগান সেটাকে প্রত্যাখানও করেছেন৷
কাতারের এই দুঃসময়ে ইরাকের অবস্থান স্পষ্ট না৷ বাগদাদে ত্রি-পাক্ষীক আলোচনার কথা খবরে এলেও বর্তমান ইরাকের ভূমিকা কী থাকবে সেটা স্পষ্ট না৷ খবরে কুয়েত কর্তৃক মধ্যস্থতার কথাও এসেছে৷
এ অবস্থায় কাতারের উচিত হবে- মুসলিম দেশগুলোর কাছে সাহায্য চাওয়া৷ অন্যদিকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়িব এরদুগানও যদি তার মিত্র শক্তির দেশগুলোকে নিয়ে কাতারের পাশে দাড়িয়ে যায় তাহলে এই সংকট কাতারকে খুব ভোগাতে পারবে না৷ ইতিমধ্যে আঙ্কারার সংসদে ২৪০ ভোটে “কাতারে তুরস্কের সামরিক ঘাটি নির্মাণ” সংক্রান্ত একটি বিলও পাশ হয়েছে৷ ফলে একথা স্পষ্ট বলা যায়- তুরস্ক যদি সব শক্তি নিয়ে কাতারের পাশে দাড়ায় তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ এবং বেকায়দায় পড়বে আমেরিকার ক্রিড়নক সৌদি রাজপরিবার৷
অন্যদিকে সাগরের পূর্বপাড় থেকে ইরান যদি নৌপথে পুরোদমে কাতারের পাশে এসে দাড়িয়ে যায় তাহলে সৌদি আরবের কপালেও আরো খারাবি আছে৷ অতএব সৌদি বাদশারা যদি উন্মাদনায় বুদ হয়ে না থাকে তাহলে এই মুহূর্তে কাতারে সামরিক আগ্রাসন চালানোর দুঃসাহসও দেখবে না৷
পুনশ্চঃ আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে আমার জ্ঞানের পরিধি একেবারে কম৷ শূন্য বললেও ভুল হবে না৷ সম্প্রতি কাতার ইস্যুটি সামনে এলে আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে কিছু সময় ব্যয় করি৷ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সংকটের গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করি৷ এরপর আমার সামনে যে বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়েছে সেগুলো-ই এনালাইসিস আকারে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি৷
পাঠক! প্রদর্শিত যুক্তির আলোকে আমার সাথে “হা” না বলে নিজেও ভাবার চেষ্টা করুন৷ তথ্যে কোন ভুল থাকলে, অথবা কোন কারেকশন থাকলে আমাকে জানিয়ে উপকৃত করবেন বলে আশা রাখি৷ আপনার কাছ থেকে সচেতন ও গবেষণামূলক মন্তব্যও আশা করি৷
আপনি কি কাতারের পাশে দাড়াবেন, নাকি বিপক্ষে দাড়াবেন সেটা আপনার ব্যাপার৷ চাইলে নিরপেক্ষও থাকতে পারেন৷ তবে মধ্যপ্রাচ্য অস্থিরতার মূল যে কারনটি তুলে ধরেছি সেটা নিয়ে ভাবার চেষ্টা করুন এবং উত্তরনের পথ খুঁজুন!
Discussion about this post